মুখ্যমন্ত্রীকে একবার সামনে থেকে দেখতে উৎসুক কোচবিহার রাস উৎসবের রাসচক্র নির্মাতা আলতাফ

তোর্সা নদীর তীরে একচালা টিনের ঘর। ছেলে-বৌমা আর ছোট্ট নাতিকে নিয়ে অভাবের সংসার। সারা বছর ছোটখাটো কাঠের কাজ করে দিনগুজরান হয়। নামটা গোটা কোচবিহারের মানুষের অজানা নয়, তবে সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে ক’জন চিনবেন সন্দেহ আছে। আসলে তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে সকলে পরিচিত, মুখের সঙ্গে নয়। তিনি নিজেও আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন। অথচ, কোচবিহারের রাস উৎসবে তাঁর এক সৃষ্টির ছোঁয়ায় লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থীর পুণ্য অর্জন হয়। তাঁর হাতেই তৈরি হয় বিখ্যাত রাসচক্র। যে চক্র কে কেন্দ্র করে জগৎবিখ্যাত কোচবিহারের রাস উৎসবের সূচনা হয়।তিনি আলতাফ মিঞা। কোচবিহারের হরিনচওড়া গ্রামে তোর্সা নদীর বাঁধ সংলগ্ন এলাকায় একচিলতে ঘরে পরিবার নিয়ে বাস তাঁর। বানের জল কখনও কখনও তাঁর এই ছোট্ট ঘরের মধ্যেও ঢুকে পড়ে।

বংশপরম্পরায় ঐতিহ্যবাহী এই রাসচক্র নির্মাণ করে আসছে আলতাফের পরিবার৷ সেই রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের আমলে শুরু হওয়া রাস উৎসবের জন্য রাসচক্র তিন পুরুষ ধরে নির্মান করে আসছে এই মুসলিম পরিবারটি। গত ৩২ বছতে ধরে বংশের এই রীতি সামলাচ্ছেন বছর পঞ্চান্নর আলতাফ।

প্রতিবার লক্ষ্মীপুজোর পর থেকেই পারিবারিক রীতি মেনে একমাস ধরে রাসচক্র নির্মাণ করেন আলতাফ। উৎসব সূচনার আগেই মদনমোহন মন্দিরে পৌঁছে দিতে হয় সেই রাসচক্র৷ তাই এই কয়েকটা দিন নাওয়া-খাওয়ারও সময় থাকে না আলতাফ মিঞা ও তাঁর পরিবারের৷

রাজার অনুরোধে তাঁর ঠাকুরদা পান মহম্মদ মিয়াঁ এই রাসচক্র তৈরির কাজ সর্বপ্রথম শুরু করেন ৷ পান মহম্মদকে ডেকে কোচবিহারের মহারাজা রাসচক্র নির্মানের জন্য বলেন। সেই থেকে শুরু। শুধু চক্র নির্মাণই নয়, রীতিমত নিষ্ঠাভরে উপোস করে নির্মাণের কাজ শুরু হয়৷ এই ক’দিন মিঞা পরিবারের সবাই নিয়ম করে নিরামিষ ভোজন করেন। নিয়মের কোনও বাধ্যবাধকতা অবশ্য নেই। তবে যেহেতু এটা একটা হিন্দু ধর্মের আচার, তাই আলতাব মিঞা ও তাঁর পরিবারের সকলেই নিজেদের ইচ্ছাতেই এমনটা করে থাকেন। তাতে মনে শান্তি মেলে বলেই দাবি করেছেন আলতাফ।

ফি-বছরের মতো এবারেও মদনমোহন মন্দিরে রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের সূচনা হবে ১১ নভেম্বর সোমবার রাতে। জানি এখন সাজো সাজো রব মদনমোহন মন্দির ও বিশাল রাস মেলা প্রাঙ্গণ। প্রায় দুই হাজারেরও বেশি দোকান বসবে এই মেলাকে কেন্দ্র করে। সমাগম হবে দেশ-বিদেশের লক্ষাধিক পুণ্যার্থী ও পর্যটকের। আসছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। যা নিয়ে মন্দির কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্তাদের ঘুম ছুটেছে। সুস্থভাবে সব কিছুর আয়োজন করাটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তাঁদের কাছে।

এদিকে দিনভর উপোস করে পুরোহিতের পাশে বসে বিশেষ পুজো করবেন কোচবিহারের জেলাশাসক পবন কাদিয়ান। জেলাশাসক হওয়ার পর এটাই তাঁর প্রথম উৎসব। পুরোহিতের নির্দেশ মেনে মন্ত্রোচ্চারণের পর রীতি মেনে রাসচক্র ঘুরিয়ে রাস উৎসবের সূচনা করবেন তিনি। তারপর ওই রাসচক্র ঘোরানোর সুযোগ পাবেন দর্শনার্থীরা।

আরও পড়ুন – মোদি-মমতা কথা, মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসায় রাজ্যপাল

১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কোচবিহারের মহারাজারা বংশানুক্রমে এই রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের সূচনা করেছেন। মেলা চলা পর্যন্ত রাসচক্র ঘোরাতে উপচে পড়ে ভিড়। আর বংশানুক্রমিকভাবে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী রাসচক্র তৈরির কাজের দায়িত্ব সামলাচ্ছে একটি মুসলিম পরিবার।

গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই মুসলিম পরিবারটির উত্তরসূরি আলতাফ মিঁঞার দায়িত্বে নির্মিত হয়েছে রাসচক্র। এখন বিশ্ব বাংলা সংবাদ-এর মুখোমুখি হয়ে রাসচক্র নির্মাণের ইতিহাস তুলে ধরলেন আলতাফ নিজেই। জানালেন, বাঁশ কেটে বাতা তৈরি করে শুকিয়ে কাগজের কারুকার্য, পাট দিয়ে গড়া ৩২ দেবদেবীর ছবি আটকানো সবটাই নিজের হাতে। এই ২২ ফুট উঁচু কোচবিহারের দুধসাদা রাসচক্র সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক বলেই মনে করেন আলতাফ। তাঁর কথায়, ‘‘বহু বছর ধরে আমি রাসচক্র গড়ছি। ছেলেকেও শেখাচ্ছি। আমার আগে দাদু পান মহম্মদ মিঁঞা, বাবা আজিজ মিঁঞা এই কাজ করেছেন। পরম্পরাটা ধরে রাখতে চাই।’’

আলতাফের আশা, তাঁর ভবিষ্যত প্রজন্মও রাসচক্র বানাবে নিষ্ঠাভরে৷ তাঁর ছেলে আমিনুর এখন তাঁর সঙ্গেই কাজ করেন৷ এছাড়াও তাঁর নাতি ৫ বছরের রাজু হোসেনও ঠাকুরদা ও বাবার সঙ্গে চক্র নির্মাণের কাজে হাত লাগিয়েছে৷ একটা সময় যেমন আলতাফ বাপ-ঠাকুরদাদের সঙ্গে চক্র নির্মাণের কাজে হাত লাগাতেন।

কুচবিহারের এই ঐতিহাসিক ও প্রসিদ্ধ রাসমেলা এক করে দেয় হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান-শিখ সম্প্রদায়কে৷ রাসচক্রে সম্প্রীতির ছাপ স্পষ্ট। এটিতে যে নকসা করা হয়, তা অনেকটাই মহরমের তাজিয়ার মত দেখতে বলে মনে করেন অনেকেই৷ চক্রজুড়ে ৩২ দেবদেবীর ছবি হিন্দু ধর্মের প্রতীক। আর চক্রের উপরে যে গম্বুজ, তা সকল ধর্মের ধর্মস্থানের স্থাপত্যের আদলের নিদর্শন বহন করে। রাসচক্রই যে কোচবিহারের রাস উৎসবের মূল আকর্ষন, তা স্বীকার করে মদনমোহন মন্দির কর্তৃপক্ষও। মন্দিরের বড়বাবু জয়ন্ত চক্রবর্তীও ঐতিহ্যবাহী রাসচক্রের ইতিহাস ও তার গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন সর্বধর্ম সমন্বয় বলেই। এবং তিনি জানিয়েছেন, রাসচক্র ছাড়া রাস উৎসব অসম্পূর্ণ। আর সেই কারণেই তো রীতি মেনে মদনমোহন মন্দিরে এই চক্র ঘুরিয়ে উৎসবের সূচনা হয় কোচবিহারে।

এবার কোচবিহারের রাস উৎসবে শামিল হবেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যা এই উৎসবের জৌলুস ও তাৎপর্যকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আগামী ১৩ নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রী কোচবিহার আসবেন। এবং পূজা দেবেন মদনমোহন মন্দিরে। রাস উৎসবের সময় এই প্রথম বাংলার কোনও মুখ্যমন্ত্রী এখানে আসছেন।

আলতাফের ইচ্ছা, একবারটি সামনে থেকে মমতাময়ী মুখ্যমন্ত্রীর দর্শন লাভ। তাঁর কথায়, “আমার কিছু চাইনা। আমার কোনও দাবি নেই। খোলা আকাশের নিচেই মাটিতে পা রেখেই আমি থাকতে চাই। তবে যে মুখ্যমন্ত্রী বাংলার মানুষের জন্য এত কিছু করছেন, সেই মমতাময়ী মানবিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একবার যদি সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাই নিজেকে ধন্য মনে করব। জানিনা, এত মানুষের ভিড়ে, আমি সেই সুযোগ পাবো কিনা।”

                                                                                                       ছবি – বিকাশ মণ্ডল

আরও পড়ুন – প্রথমে কন্ট্রোল রুমে, পরে ভোররাত পর্যন্ত ফোনে নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী

Previous articleগুরুর শরণাপন্ন রোহিতদের ‘হেডস্যার’
Next articleফিনল্যান্ডের সমুদ্রতটে বরফ ডিম!