কংগ্রেসকে স্থায়ীভাবে কফিনে ঢোকালেন প্রদেশ নেতারা, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

কংগ্রেস!
বিশেষত প্রদেশ কংগ্রেস!

জলসাঘরের ছবি বিশ্বাসকে গুনে গুনে দশ গোল মারবেন এই দলের নেতারা৷ অসার কিছু রেকর্ডেড বুকনি আর ১৩৬ বছরের ইতিহাসকে পণ্য করে দোকান খুলে বসে আছেন নেতারা৷ আর ক্রমশ হরপ্পার যুগে ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে দলটাকে৷ গত ৪৪ বছরে বাংলার কংগ্রেসকর্মীরা এতখানি লজ্জাজনক দিন দেখেনি, যা একুশের ভোটের ফলপ্রকাশের দিন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো প্রদেশ কংগ্রেসের বর্তমান নেতৃত্ব৷ বাংলা থেকে এবার সত্যিই মুছে গেলো কংগ্রেস ৷

দিল্লিতে ‘জ্যাক’ ফিট করে বড় বড় পদ পাওয়া প্রদেশ কংগ্রেস পদাধিকারীদের একের পর এক ভুল, অযৌক্তিক, আদর্শহীন সিদ্ধান্ত দলকে ধাপার মাঠে পুঁতে দিলো৷ এত দুর্যোগ, বিপত্তির মধ্যেও বাংলায় কংগ্রেসের যে ভোটব্যাঙ্ক ছিলো, তাতে প্রথম আঘাত লেগেছিলো সিপিএমের সঙ্গে জোট করার পর৷ আর একুশের ভোটে সাম্প্রদায়িক আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে মোর্চা করে কফিনে শেষ পেরেকটাও পুঁতে দিলেন অধীর চৌধুরি অ্যাণ্ড কোম্পানি ৷ আব্বাসের থাপ্পড়ের পরেও প্রদেশ নেতারা যেভাবে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে তাঁর পিছনে ঘুরেছে এবং আলিমুদ্দিনের নির্দেশে দল পরিচালনা করেছে, তার সমুচিত জবাব মানুষ দিয়েছে৷ সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, নিষ্ঠাবান কংগ্রেসিরাও এবার ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কংগ্রেসের দিক থেকে৷ প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠছে, যে মুর্শিদাবাদ, মালদহকে সামনে রেখে দিল্লি- কলকাতায় ধারাবাহিকভাবে ‘বার্গেনিং- পলিটিক্স’ চালিয়েছে নেতারা, সেই দুই জেলায় কংগ্রেস এভাবে বেহাল কেন হলো ?
কেন কংগ্রেসের তথাকথিত গড় এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিলো ? এই মুখ ফেরানোর কতখানি তৈরি করা, এসব প্রশ্নও উঠছে৷

কংগ্রেস কর্মীরা দীর্ঘ দিন আগেই বুঝেছেন, গ্রাসরুটে নেতাদের কোনও যোগাযোগই নেই৷ মাঝে মধ্যে টিভির পর্দায় এদের কাউকে দেখা যায়, বাকি সময়টা নেতারা নিজেদের পেশা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন৷ প্রদেশ কংগ্রেসের পদে বসে শূন্যে তরবারি চালিয়ে যাচ্ছেন৷ আছেন এমন দু-চারজন লোক, যারা স্রেফ নিজেদের স্বার্থ কীভাবে চরিতার্থ হবে, তার শলা-পরামর্শ করে দলের কর্মীদের ঘাড়ে ফতোয়া চাপিয়ে দিচ্ছেন৷ সেটাই নাকি দলের নীতি৷ রাজ্যের কংগ্রেসকে শক্তিশালী করতে তথাকথিত কোন কোন পদাধিকারী বা নেতা বা নেত্রীর ভূমিকা বা সক্রিয়তা কতখানি, নেতা-কর্মীরা জানেন৷ তারাই আজ দলটিকে কার্যত তুলে দিলেন৷ জেলাস্তরের বেশকিছু নেতা-কর্মী এবারের ভোটেও প্রাণপাত পরিশ্রম করেছিলেন দলের প্রার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে৷ কিন্তু ‘লবি’ ধরে টিকিট পাওয়া অযোগ্য, বার বার ব্যর্থ হওয়া প্রার্থীদের ভোট দিতেই রাজি হলেন না কংগ্রেসের আদি ভোটাররাও৷
প্রদেশ কংগ্রেসের তথাকথিত নেতারা মনেই রাখেন না যে তাদের চরম সৌভাগ্য, দলে আজও কিছু ‘ডেডিকেটেড’ কর্মী এবং ভোটার রয়েছেন৷ কোনও কিছু পাওয়ার জন্য এনারা কংগ্রেস করেন না৷ এটা তো ঠিকই চার দশক রাজ্যে ক্ষমতায় নেই যে দল, সেই দল দেবেই বা কী ! এই কর্মীরা যে আজও সগর্বে কংগ্রেসের আদর্শ নিয়ে পথে প্রান্তরে ঘুরছেন, সে জন্য কোনও নেতার একআনাও অবদান নেই৷ ব্যক্তিগত ইচ্ছায় এবং আবেগে স্থানীয়স্তরের নেতা ও কর্মীবাহিনী আজ এখনও শত প্রলোভন এড়িয়ে কংগ্রেসের পতাকা বহন করেন৷ এখনও অজস্র মানুষ রয়েছেন যারা ভোটের দিন বুথে গিয়ে ‘হাত’ প্রতীকে ভোট দেন৷ এরা শুধু প্রতীক দেখেন, প্রার্থী নন৷ ওই যে ৫-৬ শতাংশ ভোট পায় কংগ্রেস, সেটাও এই স্বার্থহীন কর্মী-সমর্থক, ভোটারদের সৌজন্যেই কংগ্রেস পাচ্ছে৷ এক্ষেত্রেও এক ফোঁটাও অবদান নেই স্বঘোষিত কোনও নেতার৷

আরও পড়ুন-হার নিশ্চিত বুঝেই দশদিন আগে ‌নিরুদ্দেশ হন শাহ

আর এই সুযোগটাই নেন নেতারা৷ এবারের নির্বাচনে কারা প্রার্থী হয়েছিলেন ? কত ভোট পেলেন নেতাদের স্নেহধন্য এই সব প্রার্থীরা ? সব ধরনের নির্বাচনে পর পর হেরেই চলা জনাকয়েকের নাম এই তালিকাতেও জ্বলজ্বল করেছে৷ ঘুরে ঘুরে এরাই প্রার্থী হন আর বছর বছর শুধুই হারেন৷ হারেন মানে তৃতীয় বা চতুর্থ হন৷ তাঁরাই ফের প্রার্থী হন৷ মানুষ যে এই মুখগুলোকে আর দেখতেই চাননা, বার বার প্রত্যাখ্যান করছেন, তা বোঝার ন্যূনতম বোধও নেতাদের নেই, প্রার্থীদের তো নেই-ই৷ ভোট এলেই প্রার্থী হতে এদের মন আকুলি- বিকুলি করে৷ ‘জ্যাক’ ধরে প্রার্থীও হয়ে যান৷ এরা নিজেদের কততো বড় নেতা ভাবেন, তা বোঝা যায় কেন্দ্র বাছাই দেখে৷ এমন প্রার্থীও আছেন, যারা এক একটি ভোটে এক এক জেলা থেকে প্রার্থী হচ্ছেন আর লজ্জাজনক ভোটে হারছেন৷ ভাবখানা এমন, যেন বাংলাজুড়েই এদের প্রভাব- প্রতিপত্তি রয়েছে, যে কোনও জেলায় এরা প্রার্থী হওয়ার যোগ্য৷ অথচ বার বার এনারাই সুযোগ পাচ্ছেন৷ প্রার্থী তালিকা দেখে কেন্দ্র ধরে ধরে উল্লেখ করা যায়৷ কিন্তু সেই আলোচনার যোগ্য নন এরা৷ দলের প্রতি, কর্মীদের প্রতি কোনও কনট্রিবিউশন’ই এদের নেই৷ অথচ প্রতিটা দিন দলের কাজ করছেন, পথে নেমে দল করছেন, বহু প্রলোভন হেলায় উপেক্ষা করে, আজও কংগ্রেস করছেন, এমন মানুষও আছেন৷ অথচ প্রার্থী বাছাইয়ের সময় এদের নাম আলোচনাতেই আসেনা৷ এই দলকে টানা ভ্যাকসিন দিয়ে গেলেও আর উঠে বসবে না৷

এআইসিসি ইদানিং বাংলার কংগ্রেসকে কোন নজরে দেখছে, তা বোঝা যায় দলের ‘মহা’ তারকা প্রচারকদের গতিবিধি দেখেই৷ দিল্লির ক’জন নেতা এবার এসেছিলেন ভোটপ্রচারে ? অথচ দফায় দফায় স্টার-প্রচারকদের তালিকা প্রকাশ করেছে এআইসিসি৷ কেন এলেন না রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ? ডঃ মনমোহন সিং থেকে নবজ্যোত সিধু, মহম্মদ আজহারউদ্দিন, কোথায় ছিলেন ? অধীর চৌধুরির মতো একজন ডাকসাইটে নেতা, যার সঙ্গে প্রতি মুহুর্তে মাটির যোগাযোগ আছে, যিনি জানেন, দলের দুঃসময়ের কর্মীদের মর্যাদা দিতে, তিনিও এই গড্ডালিকায় গা ভাসালেন কেন ? এককভাবে তিনি এই ভোটে যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন, কিন্তু একুশের ভোটে প্রদেশ কংগ্রেসকে স্থায়ীভাবে হিমঘরে পাঠানোর দায় কিছুতেই এড়াতে পারবেন না অধীর চৌধুরি৷

Advt

Previous article‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা’ বলে কিছুই ছিলো না
Next article‘বাঙালি জিতে আবারও প্রমাণ করল যে তাঁদের কেনা যায় না’, মন্তব্য নচিকেতার