সেলিমের আব্বাসপ্রীতি নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা, বিপর্যয়ের পর তুলকালাম সিপিএমে

২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের পর থেকে যে বিপর্যয়ের শুরু, তার বৃত্ত সম্পূর্ণ হল ২০২১-এর মে মাসে। একটা সময়ে টানা ৩৪ বছর ধরে বাংলা (Bengal) এবং বামফ্রন্ট (Left front) কার্যত সমার্থক ছিল। আর আজ এই মুহূর্তে বাংলার কোনও লোকসভা ও বিধানসভা আসনে তাদের কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই। বিরোধী হিসাবেও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সিপিএমের (cpim) একটাও এমএলএ থাকবে না, এমন দৃশ্য তাদের অতি বড় রাজনৈতিক শত্রুও কল্পনা করতে পারেনি। বাংলার বিধানসভা আজ আক্ষরিক অর্থেই বামশূন্য।

গতকাল বিপর্যয়ের (debacle) পূর্ণাঙ্গ চিত্রটি সামনে আসার পর প্রত্যাশিতভাবেই বিদ্রোহের কামান দাগা শুরু হয়েছে সিপিএমের সদর দফতর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের দিকে। বছরভর বৃহত্তর বামশক্তিকে শক্তিশালী করার কথা বলে ভোটের আগে সংযুক্ত মোর্চা গঠনের নামে কুৎসিত সাম্প্রদায়িক প্রচার করা মুসলিম মৌলবাদীদের দল আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে জোট করার পর ভবিষ্যতে কীভাবে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল বলে দাবি করবেন সিপিএম নেতারা? এটা শুধু সাধারণ বামকর্মীদেরই প্রশ্ন নয়, এবারের নির্বাচনে পরাজিত একাধিক প্রার্থী ও নেতা বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে দলের নীতি-নির্ধারক নেতৃত্বকে তুলোধনা করে এই প্রশ্ন তুলছেন। আব্বাসের মত এক উগ্র ধর্মীয় প্রচার করা পীরজাদার সঙ্গে এই জোট করার নেপথ্য নায়ক ছিলেন সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। ফলে তিনিই এখন সমালোচকদের তিরবিদ্ধ হচ্ছেন। আমূল নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর সেলিমের আব্বাসপ্রীতি ও মোর্চা গঠনের ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে জেলায় জেলায় ক্ষোভ-অসন্তোষ-সমালোচনা উগরে দিচ্ছেন বহু প্রতিষ্ঠিত নেতাও। তাঁদের বক্তব্য, জনসংযোগহীন কিছু নেতা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থপূরণের অঙ্কে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে দলকে শূন্যে পৌঁছে দিলেন। এই বিপর্যয়ের দায় দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থক, পার্টির প্রতি নিবেদিতপ্রাণ সদস্য বা মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার করা একঝাঁক নতুন মুখের নয়, এই বিপর্যয়ের সম্পূর্ণ দায় ভুল সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া নেতাদের। বৃহত্তর বাম ঐক্য গড়ে তোলার অবস্থান থেকে সরে এসে কেন এক কট্টর মৌলবাদীকে মাথায় তোলা হল এবং কার্যত তাঁর কাছে একটা বামপন্থী দলকে আত্মসমর্পণ করতে হল, তার ব্যাখ্যা চাইছেন পরাজিত প্রার্থীরা।

আরও পড়ুন:৫ মে নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

গতকাল উত্তর দমদম কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক ও পরাজিত প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্য এবিপি আনন্দ চ্যানেলের অনুষ্ঠানে বসে প্রকাশ্যেই দলের ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন। নাম না করলেও সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের আব্বাসপ্রীতি ও তাঁর সঙ্গে জোট করার সিদ্ধান্তকে তুলোধনা করেন তন্ময়। স্পষ্ট বলেন, যারা অন্যদের মতামত না নিয়ে উপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছেন, তাঁদেরই এই বেনজির হারের দায়িত্ব নিতে হবে। এই বিপর্যয়ের জন্য সিপিএমের নিচুতলার কর্মীরা কোনওভাবেই দায়ী নন। বরং তাঁরা গোটা নির্বাচনী লড়াইয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে জনসংযোগ করেছেন। উপরতলার ভুল নীতির খেসারত দিতে হয়েছে প্রার্থীদের। কেন আব্বাসের মত এক ধর্মান্ধ ব্যক্তির সঙ্গে জোট, তা মানুষকে বোঝানো যায়নি। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট তবু মানা যায়, কিন্তু আইএসএফের মত সাম্প্রদায়িক দলের হাত ধরে আর যাই হোক ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি বিশ্বাসযোগ্য হয় না। তন্ময়ের সুরেই দলকে বিঁধে রাজ্য নেতৃত্বের একাংশের বিরুদ্ধে ঘনিষ্ঠমহলে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন শিলিগুড়ির পরাজিত প্রার্থী অশোক ভট্টাচার্য। তাঁর আক্ষেপ, সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগহীন নেতারাই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন! তার প্রভাব পড়ছে একের পর এক নির্বাচনী ব্যর্থতায়। কামারহাটির গতবারের বিধায়ক মানস মুখার্জি সোশ্যাল মিডিয়ায় লম্বা পোস্ট করে দলকে তুলোধনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, এই সিপিএম দলটা আর করব কিনা ভাবতে হবে! মানসের বিস্ফোরক পোস্ট ও তন্ময়ের প্রকাশ্য বিস্ফোরণের পর নড়েচড়ে বসেছে আলিমুদ্দিন। শোনা গিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়ে আত্মসমালোচনার ডাক দেওয়া হয়েছে। রাজ্য সম্পাদকমন্ডলী বৈঠকে বসে বেসুরো তন্ময় ভট্টাচার্যকে শো-কজ করার পথে হাঁটছে। বিধানসভায় সর্বস্ব খুইয়ে এখন ভুল নীতির দায় সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত বলে চালাতে নেমেছেন উপরতলার মুষ্টিমেয় কিছু নেতা। কিন্তু এতে জেলায় জেলায় বিদ্রোহের জ্বালামুখ বন্ধ করা যাবে, এমন আশা কম।

Advt

Previous articleকরোনা পরিস্থিতি সামলাতে প্রয়োজনে লকডাউন জারির পরামর্শ দিল শীর্ষ আদালত
Next articleখানাকুলে খুন তৃণমূলকর্মী, অভিযোগ বিজেপির বিরুদ্ধে