সোমবারর রান্নাপুজো। কথাটি অনেকের জানা, আবার অনেকে বিস্তারিত জানেন না।

ভাদ্রে রান্না, আশ্বিনে খাওয়া ভাদ্র সংক্রান্তির রাত্রে সবাই মিলে সারা রাত কুটনো, বাটনা, রান্না। পর দিন মা মনসাকে নিবেদন করে খাওয়া। এই হল রান্নাপুজো।


সনাতন ধর্ম অনুযায়ী , শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসটাই বাপ-বেটির মাস। চৈত্রসন্ন্যাসী-চড়ক নীলের উপোসে গেলেন তো শ্রাবণসন্ন্যাসী এলেন বাঁক-কাঁধে মাসভর জল ঢালতে। আর এই এত এত জল ঢালায়, নদী-নালা-পুকুরে যেমন কলকল করে জল উপচে এল, তেমনি খলবল করে বাইতে লাগলেন ‘তাঁরা’ সন্ধেবেলা যাঁদের লতা বলে। তাঁদের তো বাসায়, গর্তে, কোটরে জল, অতএব আস্তানা ছেড়ে কখনও উনুনের ভেতর, কখনও ধানের গোলায়, নয়তো চাল বেয়ে, আশেপাশে খোঁদলের খোঁজে। এই নাগনাগিনীর দলই গেরস্থের বাড়িতে, মা মনসার জ্যান্ত রূপ।

শিবকন্যা সরস্বতী-লক্ষ্মীর মতোই এঁরও আদর কম নয়। পূর্ববঙ্গে মাসভর ভাসানের গান আর পশ্চিমবঙ্গে ভাদ্র সংক্রান্তিতে মনসা পুজো। এ-দেশিদের কারও ঘরে আবার ধান্যলক্ষ্মীর চার বারের পুজোয়, এক বার অর্থাৎ ভাদ্র মাসে লক্ষ্মী-মনসার একসঙ্গে আরাধনা। আলপনায় কমল, গাছ-কৌটো, প্যাঁচা, ধানের গোলার সঙ্গেই বিশেষ উপস্থিতিতে সাপ। আর এরই বোধহয় পল্লি-রূপটি হল রান্নাপুজো। না, খাস ঘটিবাড়ির গোটাসেদ্ধ-র সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলা চলবে না, যা পঞ্চমীতে রেঁধে শীতলষষ্ঠীতে খাওয়া হয়, সরস্বতী পুজোর পর দিন। কারণ, রান্নাপুজো মানে রান্না পুজো এবং না-রান্নাও। অরন্ধন।


বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন ভাদ্র সংক্রান্তিতে সাধারণত অমাবস্যার অন্ধকারই থাকে। সেই ঘোর অন্ধকারে বাড়ির সবাইকে জুটিয়ে সারা রাত ধরে কুটনো, বাটনা, রান্না। আর পর দিন মা মনসাকে নিবেদন করে তবে খাওয়া। লোকে বলে, ভাদ্রে রেঁধে আশ্বিনে খাওয়া। এর পর যা কিছু উৎসব সবই হবে মহালয়ার পর থেকে, সুপর্বে। যে জন্য দেবী দুর্গার অন্যতম নাম ‘সুপর্বা’।

রান্নাপুজোয় সারারাত বিভিন্ন পদের আয়োজন হয়। ছোলা-নারকেল দিয়ে কালো কচুর শাক এবং একই সঙ্গে আরও এক পদ ইলিশের মাথা দিয়ে। নানা রকম সব্জি ভাজা, বিশেষত গাঁটি কচু, শোলা কচু আর চিংড়ি-ইলিশ থাকতেই হবে। খেসারির ডাল বেটে শুকনো ঝুরি, চুনোচানা মাছের পুঁইশাক চচ্চড়ি। বলতে থাকে যে, এই সব কুটনোবাটনা চলতে চলতেই তারা আশপাশ থেকে ফোঁস-ফোঁস, হিস্-হিস্ও শুনতে পায়। সরে-নড়ে চলে যান তাঁরা। বাস্তুসাপ বেরোবে জেনেই সিঁদুর ফেলে রাখা হয় উনুনের পাড়ে, গোয়ালঘরে। সধবা নাগিনীটির ফণাতেই নাকি সিঁদুরের ফোঁটাটি দেখা যায়। সব রান্নার পর শেষরাতে ভাত বসে, মাটির হাঁড়িতে। ফ্যান ফেলে, যখন জল ঢালা হয়, তখন নাকি তারার আলো নিভিয়ে সূর্যকে জায়গা করে দিতে থাকে চাঁদ। মেয়ে-বউরা উষারম্ভের আগেই স্নান সেরে কাচা কাপড় পরে মায়ের থানে ভোগ দিয়ে আসে। কবিতার সংসারে ‘থান’ মানে বাড়ির পাশে ‘ময়দা কালীমন্দির’-এর পুকুর, যেখানে মনসার ঘটপুজো হয়।

প্রতিবছরের ন্যায় এবছরেও নিমন্ত্রণ পেয়েছি, খান তিনেক বাড়িতে। আমাদের পারিবারিক নিয়মে নেই, তাবলে কি স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে। তাই আমার বাড়িতে আগামীকাল আরন্ধন।
