7 বছর পার, কবে বিচার পাবে কামদুনি? কণাদ দাশগুপ্তের বিশেষ কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

তেলেঙ্গানায় বিচারের আগেই গুলি করে মেরে দেওয়া সমর্থন করছেন না অনেকেই৷ যারা ওই এনকাউন্টার সমর্থন করছেন না তাঁদের বক্তব্য, কোনও সভ্য দেশই এ ধরনের এনকাউন্টারকে সমর্থন করেনা৷ এটা বিচার নয়৷ এই ধর্ষণ-কাণ্ডের তদন্ত চালিয়ে যাওয়ারও দাবি জানিয়েছেন অনেকেই৷ তাহলেই নাকি প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে৷ অনেকের বক্তব্য, তাহলে এ দেশে বিচারব্যবস্থা চালু রাখার আর দরকার নেই৷ পুলিশই সব সিদ্ধান্ত নিক৷

এনকাউন্টারের পক্ষে- বিপক্ষে মতামতের এই জোয়ারে গা না ভাসিয়ে বরং রাজ্যের এক বহু আলোচিত ধর্ষণের ঘটনা এবং সেই ঘটনার বিচারের দিকে দৃষ্টি ঘোরানো যাক৷

সেই ঘটনা এবং ঘটনা পরবর্তী ঘটনা আজও তো স্মৃতিতে টাটকা৷

2013 সালে উত্তর 24 পরগণার কামদুনি এলাকায় 21 বছরের এক তরুণীকে গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় এ রাজ্যে ঝড় তুলেছিলো৷ প্রতিবাদ- বিক্ষোভে সেদিন উত্তাল হয় বাংলার পথ-প্রান্তর৷ রাজনৈতিক তরজায় প্রায় ঢাকা পড়তে চলেছিলো মূল অপরাধ এবং অপরাধী৷

2013 সালের 7 জুন৷ সেদিন কলকাতা থেকে প্রায় 50 কিলোমিটার দূরে উত্তর 24 পরগনা জেলার বারাসতের কামদুনি অঞ্চলে ঘটে ওই ঘটনা।

কামদুনির বিএ দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে সংলগ্ন এক খামারে টেনে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে খুন করা হয় এবং পরদিন সকালে ওই খামারে তাঁর বিকৃত মৃতদেহ মেলে।

এই ঘটনায় গোটা রাজ্যে সাড়া পড়ে যায়৷ ওই কলেজ ছাত্রীকে গণধর্ষণ ও হত্যার দায়ে নিম্ন আদালত অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করে 3 জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং আরও 3 জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয়।

তেলেঙ্গানার প্রতিক্রিয়ায় রাজ্য যখন উত্তেজিত তখন জানা দরকার, কামদুনির ঘটনার পর প্রায় 7 বছর পার হলেও ওই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে আজও কারো শাস্তি হয়নি৷ ধর্ষিতা এবং তাঁর পরিবার আজও বিচার পায়নি৷ ঘটনার এত বছর পরেও আদালতে মামলা বিচারাধীন৷ তাই এখনও দিব্যি বহাল তবিয়তে রয়েছে আছে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীরা৷

কারণ, নিম্ন আদালতের শাস্তির রায়কে চ্যালেঞ্জ করে 2016 সালে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় অভিযুক্তদের পরিবার। তারপর সেই 2016 থেকে আজ পর্যন্ত হাইকোর্টে এখনও বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে এই মামলা।

2016 সালের 29 জানুয়ারি কামদুনি-ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ চিহ্নিত করে নগর দায়রা আদালতের বিচারক সঞ্চিতা সরকার 2016 সালে গণধর্ষণ ও হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন সইফুল আলি, আনসার আলি ও আমিনুল আলিকে এবং তাঁদের মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দিয়েছিলেন৷ একইসঙ্গে গণধর্ষণ, ফৌজদারি ষড়যন্ত্র এবং প্রমাণ গায়েবের চেষ্টার অভিযোগে ইমানুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম ও ভোলা নস্করকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলো আদালত। ধর্ষণ-বিরোধী আইনের আওতায় রাজ্যে ওটাই ছিলো প্রথম মামলা এবং প্রথম মামলাতেই প্রথম দোষী সাব্যস্ত করা হয় সইফুল আলি, আনসার আলি, আমিনুল আলি,ইমানুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম ও ভোলা নস্করকে৷

সেই বিচার আজও চলছে হাইকোর্টে৷ আজও বিচার পাননি কামদুনির সেই ছাত্রী৷ এটা ধরেই নেওয়া সঙ্গত যে কামদুনির ফৌজদারি আপিল মামলার নিষ্পত্তি হতেও হয়তো আরও বছর কয়েক লেগে যাবে। কেন সময় লাগবে, তার কারনটাও জানা দরকার সবার, এবং অবশ্যই তেলেঙ্গানা-প্রতিবাদীদের৷ 2019-এর 30 নভেম্বর পর্যন্ত শুধুমাত্র কলকাতা হাইকোর্টের পরিসংখ্যান বলছে, ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা 2,07,523টি। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা 1,68,422টি এবং ফৌজদারি মামলা 39,101টি। ফৌজদারি আপিল মামলা  12,250টি। রাজ্যে বিচারাধীন মামলার সংখ্যাও বেশ কয়েক লক্ষ। কোন ম্যাজিকে কামদুনি-ধর্ষিতা দ্রুত বিচার আশা করছেন ?

তেলেঙ্গানা-এনকাউন্টারের প্রতিবাদীরা এই সমস্যা সমাধানের দাবিতে পথে নামতে পারেন না ?

বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারন মানুষের আস্থা আজও অটুট৷ এমন থাকাই উচিত৷ কিন্তু আজ যারা বলছেন তেলেঙ্গানা-
এনকাউন্টার সমর্থন করছেন না, যারা বলছেন, কোনও সভ্য দেশই এ ধরনের এনকাউন্টারকে সমর্থন করেনা, এটা বিচার নয়, বিনীতভাবেই তাঁদের কাছে প্রশ্ন, দূরের তেলেঙ্গানা ভুলে মূল্যবান সময় ‘নষ্ট’ করে ঘরের পাশের কামদুনির সেই হতভাগ্য ছাত্রীর কথা,তাঁর পরিবারের কথা একবার দয়া করে ভেবে দেখবেন৷ সেই ছাত্রী, তাঁর পরিবার কবে পাবেন বিচার ?

বিচার-ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার বহি:প্রকাশে তেলেঙ্গানা-এনকাউন্টার জাতীয় “বিতর্কিত” ঘটনা কি আমরাই এ রাজ্যে ডেকে আনছিনা ?

যদি তেমন কোনও ঘটনা এ রাজ্যে সত্যিই কোনওদিন ঘটে যায়, সে বড় সুখের সময় হবে কি ?