Sunday, November 16, 2025
কুণাল ঘোষ

“গণশক্তি”র প্রাক্তন সম্পাদক, সিপিআইএমের মিডিয়া শাখার স্তম্ভ অভীক দত্তর মৃত্যুতে গভীর শোক জানাচ্ছি। পরিবারের প্রতি রইল আন্তরিক সমবেদনা।

২০১৮-তে পার্টির মিটিং চলাকালীন গুরুতর অসুস্থ। আক্রান্ত মস্তিষ্ক। অবশেষে অকালবিদায়ের মধ্যে দিয়ে থাকল লড়াই।

অভীকদা ঠান্ডা মাথার টিম লিডার। প্রয়াত অনিল বিশ্বাস বিশেষভাবে পছন্দ করতেন। “গণশক্তি”কে আধুনিক চেহারায় উত্তরণের প্রশ্নে অভীকদার যেমন ভূমিকা ছিল, তেমনই টিভির যুগে পদার্পনের সময় পার্টির তরফে বেসরকারি চ্যানেল নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে দায়িত্ব দেওয়া হত অভীকদাকেই। ক্রমে শীর্ষনেতাদের পরম আস্থাভাজন, রাজ্য কমিটির সদস্য এবং পার্টির তরফে আরও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়ে অভীকদার উপর।

অভীকদা সিপিআইএম। আমি নই, বরং উল্টো। কিন্তু সম্পর্কটা দীর্ঘদিনের। ১৯৯৬ সালে যখন কেবল টিভিতে সেই প্রথম বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক প্রচারের অভিনবত্ব আনছি এবং অনিলদা পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, তখন অভীকদার উপর দায়িত্ব ছিল জ্যোতিবাবু থেকে সব নেতাকে আমার ক্যামেরার সামনে বসানোর। অভীকদা সবটা একা সামলেছিল।

একবার একটি বই বার করলাম। সব নেতানেত্রীদের জীবনের অন্যরকম কাহিনি, তাঁদেরই লেখা। জ্যোতিবাবুকে বলতে তিনি বললেন,” অভীককে বলো।” অভীকদা দিব্যি জ্যোতিবাবুর একটি লেখার ব্যবস্থা করে দিল।

অনিলদাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম। তাঁর প্রয়াণের পর আমাদের পাড়ার রামমোহন সম্মিলনীর পুজোয় বেনজিরভাবে অনিলদার নানা ছবির প্রদর্শনী করেছিলাম। আমি সিপিআইএম না হয়েও যেমন এটা করেছি; তেমন আমি সিপিআইএম নই জেনেও অভীকদা সব ছবির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বউদি নিজে এসে সব ঘুরে দেখে দেখে গেছেন।

তখন বামেদের রমরমা। খবর সংক্রান্ত নানা প্রয়োজনে সব মিডিয়ারই দরকার পড়ত অভীকদাকে। তখন এসব নেট, ফেস বুক, টুইটের যুগ ছিল না। মাথা ঠান্ডা, গলা ঠান্ডা, অভীকদা মুশকিল আসান। আবার আপত্তির কিছু কাগজে বেরোলে ফোন করত, এটা কী করেছো?

অভীকদার নিজের কলমটিও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুর সঙ্গে বিদেশসফর আর কভারেজ করেছে বহু। অভীকদা সুবক্তাও বটে। গণশক্তিতে একটা সুন্দর টিম তৈরি করেছিল। অভীকদা অসুস্থ হওয়ার পর দেবাশিসদা সম্পাদক, আরেক কৃতী সংবাদকর্মী, যে কোনো দল বা কাগজের সম্পদ।

২০১১ পর্যন্ত গণশক্তি চালানো ছিল যতটা মসৃণ কাজ, নানা কারণে তারপর সেটা ততটাই কঠিন হয়ে যায়। অভীকদা হাল ছাড়ে নি। আমার সঙ্গে কথা হত নির্দিষ্ট দুতিনটি বিষয়ে। যদিও আমি চেষ্টা করেও সেই সাহায্য করে উঠতে পারি নি।

একবার অনেক আড্ডা জমেছিল। ফোনে হচ্ছে না। দেখা করা দরকার। অথচ আমি তখন সাংসদ। অভীকদাও পরিচিত মুখ। পরিচিতদের দেখা হওয়ার স্বাভাবিকতাকে মেনে নেওয়ার পরিবেশ নেই। অতঃপর দুজনের কমন চেনা এক সাংবাদিক তথা লেখকের বাড়িতে দুপুরে দুজনের দেখা আর মধ্যাহ্নভোজ হল। গৃহকর্তাকে আমি দাদা বলি। আর সে অভীকদার বন্ধুসম। সেই দুপুরটা কত গল্প। জরুরি কথাও। আমি নিশ্চিত, গৃহকর্তার আজ বুক ভেঙে আছে।

শেষ দেখা অভীকদা অসুস্থ হওয়ার কিছুকাল আগে। দিল্লি বিমানবন্দরে। বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত কোনো কাজে অভীকদা দিল্লি গেছিল। ফেরার পথে দেখা। কতদিন পর, কত গল্প হল।

শুধু একটি বিষয় আজ এখানে লেখার নয়।

চোখের উপর ভাসে আলিমুদ্দিনের তিনতলায়, পরে নতুন বাড়ি, গণশক্তির টিম। আমার তখন শুরু। রোজ বিকেলে যেতাম। অনিলদা শেষ ঘরে। মৃদুলদা চিফ রিপোর্টার। অভীকদা, অতনুদা, দেবাশিসদা, অনিরুদ্ধদা, ব্রততী, প্রয়াত অনিকেতদা, হরিলালদা, অজয়দা, পার্থদা, সুপ্রিয়দা, ভবতোষ, দীপঙ্করদা। তখন রঞ্জনদাও ছিল। পরে অনেক নতুন মুখ। চন্দন থেকে আজকের সুদীপ্ত। অভীকদাকে দেখতে যেদিন মল্লিকবাজারের হাসপাতালে গেলাম, আলাপ হল ঝকঝকে অর্কর সঙ্গে।

আসলে অনিলদা আর অভীকদারা দেখিয়ে দিয়েছেন একটি সংগঠিত রাজনৈতিক দলের কেন দৈনিক মুখপত্র থাকা জরুরি। কীভাবে সেটা একসুরে বাঁধার কাজ করে। রাজনৈতিক লাইন বাদ দিন, আমরা একমত না হতেই পারি, গণশক্তির আন্তর্জাতিক ও বিজ্ঞানের পাতা ছিল বাংলার সেরা। আর অভীকদা নিজে শুধু সাংবাদিকতা নয়, উঠে এসেছিল সংবাদপত্র পরিচালনা ও পার্টির গুরুত্বপূর্ণ জনসংযোগের কাজে। কখনও সে কাগজে ব্যস্ত; কখনও বিজ্ঞাপন বা প্রশাসনিক কাজে; শোনা যেত পার্টি সরকারে থাকাকালীন পুলিশ প্রশাসন ও বণিককূলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার দায়িত্ব যে তিনজনের উপর ছিল, তার মধ্যে অভীকদা একজন। পার্টি সরকারে থাকলে কাজ যতটা সহজ; দুঃসময়ে ততটাই কঠিন।

দিল্লি বিমানবন্দরে বসেই শুনছিলাম ক্ষমতায় পার্টি থাকাকালীন যে শিল্পগোষ্ঠী বা শিল্পপতি অনায়াসে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন; এখন তাঁদের ফোনে পাওয়াটাই কত কঠিন কাজ। জীবনের নিয়ম। তবু অভীকদা তার টিম নিয়ে লড়ে যাচ্ছিল।

সেদিনই বিমানবন্দরে কলকাতা নেমে আলাদা হওয়ার আগে শেষ কথা হয়েছে- তাহলে আবার একদিন বসা হোক!

সেই বসাটা আর হয় নি। হবে না।

অভীক দত্ত অকালপ্রয়াত।

অভীকদা, প্রণাম। চিরশান্তিতে থেকো।

Related articles

গিলকে নিয়ে মাঠের বাইরে সংঘাত, কেমন আছেন ভারত অধিনায়ক?

পছন্দের পিচ বানিয়েও ইডেনে বুমেরাং হয়েছে ভারতের। হারের হতাশার মধ্যেই একরাশ আতঙ্ক ভারতীয় শিবিরে। কারণ দলের অধিনায়ক শুভমান...

জঘন্য পিচ হতশ্রী ব্যাটিং, নিজেদের মর্জি ফলাতে গিয়ে লজ্জার হার ভারতের

ম্যাচের শেষে দর্শকের চোখ ছিল গৌতম গম্ভীরের অভিব্যক্তির দিকে। ইডেন গার্ডেনসের চেনা পিচের চরিত্র বদলে দিতে বাধ্য করেছিলেন...

২৪ ঘণ্টা পার: উত্তরপ্রদেশে পাথরখনি ধসে আটকে ১৫ শ্রমিক! মৃত ২

নিয়ম না মেনে খনিতে বিস্ফোরণ ঘটানো। তার জেরে বড় সড় ধস উত্তরপ্রদেশের শোনভদ্রের পাথর খনিতে (stone quarry)। শুক্রবার...

লালকেল্লার কাছে বিস্ফোরণস্থলে সেনা কার্তুজ উদ্ধার! উৎস নিয়ে বাড়ছে ধোঁয়াশা 

দিল্লির লালকেল্লার কাছে গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনায় (Car blast near Red fort) এবার এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে এল। রবিবার...
Exit mobile version