শহিদ মিনারে অমিত শাহ বলেছেন, “কোনও ভূমিপুত্রই বাংলার পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হবেন। মাটি থেকে উঠে আসা নেতাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসবেন”। শাহের এই মন্তব্যের পর রবিবার সন্ধ্যা থেকেই বঙ্গ- বিজেপির অন্দরে একদিকে যেমন শুরু হয়েছে জোর জল্পনা, অন্যদিকে চালু হয়েছে ইঁদুর দৌড়-ও! নিজেদের ‘ভূমিপুত্র’ প্রমান করতে

গেরুয়া-অন্দরের হেভিওয়েটদের অন্যরকম ব্যস্ততা চালু হয়ে গিয়েছে৷

অমিতজি বলে গিয়েছেন, একুশে রাজ্যে ক্ষমতায় আসছে বিজেপি৷ দলের মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন, তার ইঙ্গিত অবশ্য দেননি শাহ। এতো আগে তা বলে দেওয়ার মতো কাঁচা খেলুড়েও শাহ নন৷ তবে তিনি বুঝিয়েছেন, কেমন মুখ্যমন্ত্রী চায় তাঁর দল৷ তাঁর ইঙ্গিতপূর্ণ ‘ভূমিপুত্র’ শব্দটিই দলের মধ্যে নতুন এক চোরাস্রোত তৈরি করছে৷

মুখ্যমন্ত্রী হতে কে না চান ? স্রেফ এটুকু চাইতে আপত্তি’ই বা কোথায় ? তাই বঙ্গ-বিজেপির শীর্ষ নেতারাও মুখ্যমন্ত্রী হতে চান৷ এই চাওয়াটা একদমই অন্যায়, অসঙ্গত বা অসমীচিন নয়৷ যে কোনও রাজনৈতিক নেতানেত্রী এমন ইচ্ছা পোষন করতেই পারেন৷

এতদিন চাপা ছিলো এই ইচ্ছা৷ অমিত শাহ সেই ঢাকনা সরিয়ে বিষয়টি আলোচনার স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন রবিবার। তাই বঙ্গ-বিজেপিতে যে আলোচনা ফিসফিস করে হতো, তা এবার খুল্লাম-খুল্লা৷

এই মুহুর্তে বঙ্গ-বিজেপির ‘ফ্রন্ট-রাণার’ দিলীপ ঘোষ, মুকুল রায়, বাবুল সুপ্রিয়, রাহুল সিনহা, স্বপন দাশগুপ্ত, দেবশ্রী চৌধুরি, লকেট চট্টোপাধ্যায়,রূপা গঙ্গোপাধ্যায়রা৷ যতই প্রথম সারির নেতা হোন,

শাহ’র কথানুযায়ী ,”মাটি থেকে উঠে আসা নেতা”-র ট্যাগ গায়ে না থাকলে এদের সবাইকেই ছিটকে যেতে হবে মুখ্যমন্ত্রীর দৌড় থেকে৷ ‘মাটি থেকে উঠে আসা নেতা’ বলতে শাহ ঠিক বলতে চেয়েছেন, তাও স্পষ্ট হয়নি নেতাদের কাছে৷ তবে এ নিয়ে যেহেতু ঝুঁকি নেওয়া যায়না, তাই ঝুঁকি নিতে কেউই রাজিও নন৷ এটা বাস্তব যে, বঙ্গ- বিজেপির অন্দর এখন সুস্থ- স্বাভাবিক নেই৷ সে খবর চাপার শত চেষ্টা চললেও ফাঁক গলে প্রায়ই তা প্রকাশ্যে চলে আসছে৷

আড়াআড়ি ফাটল এখনও দৃশ্যমান না হলেও, রাজ্য বিজেপি এখন একাধিক ‘উপদল’-এ বিভক্ত৷ রবিবার থেকে গেরুয়া- শিবিরে সেই উপদল- ভিত্তিক অঙ্ক কষা শুরু হয়ে গিয়েছে৷

দলের অনেকেই বলা শুরু করেছেন, ‘মাটি থেকে উঠে আসা নেতা’ বলতে বঙ্গ-বিজেপিতে একমাত্র দিলীপ ঘোষ৷ এই অংশের যুক্তি, ‘দিলীপদা-ই একমাত্র এই গোত্রের নেতা৷ রাজ্য সভাপতি, বিধায়ক, সাংসদ হলেও একমাত্র তাঁর গায়েই আজও মাটির গন্ধ লেগে আছে। প্রত্যন্ত জেলার এক সাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে দিলীপদা উঠে এসেছেন।’ তবে, বঙ্গ-বিজেপিতে এই মুহুর্তে ‘ওপেন-সিক্রেট’, যোগ্য বা দক্ষ হোন বা হোন, কিছু নেতা ইদানিং জোট বেঁধেছেন বিধানসভা ভোটের আগেই দিলীপ ঘোষকে লাইনের বাইরে ছিটকে দিতে৷

ওদিকে, কিছু নেতার ধারনা, দিল্লির নেতারা বাংলার পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে স্বপন দাশগুপ্তর কথাই ভেবে রেখেছেন৷ কারন তিনি উচ্চশিক্ষিত এবং ওয়েল-কানেকটেড৷ তাই গায়ে মাটির গন্ধ থাক বা না থাক, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সাংসদ

স্বপন দাশগুপ্তই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের পছন্দের নাম৷ ঠিক সময়েই চমক দেবে দিল্লি৷ তবে এই অংশ মানছেন, স্বপন দাশগুপ্ত দিল্লির বাসিন্দা৷

চুপ নেই দলের অভ্যন্তরের

বাবুল সুপ্রিয় অনুগামীরা৷

এদের কথা, বাবুল সুপ্রিয় পুরোদস্তুর বাংলার ভূমিপুত্র। তিনি কেন মুখ্যমন্ত্রী হবেন না? বাবুল তো দফায় দফায় লড়াই করেই রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতিতে নিজেকে প্রমান করেছেন৷
ওদিকে কথা শুরু হয়েছে এমনও, বাংলায় যখন
বিজেপি শূন্য ছিলো, তখন একক চেষ্টায় বঙ্গ- বিজেপিকে এ রাজ্যে ফ্যাক্টর বানিয়েছেন রাহুল সিনহা৷ তাঁর একটাই মাইনাস-পয়েন্ট, পরের পর ভোটে দাঁড়িয়েছেন আর হেরেছেন৷ তাই বলে কী দলে দাম পাবেন না ?। দিল্লি এমন কখনই করবে না৷
ওদিকে, সব কিছু দেখে, শুনে এবং পরিস্থিতি আঁচ করে বিজেপির আর এক নেতা মুকুল রায় আগেই ঘোষণা করে দিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কোনও দৌড়েই তিনি নেই। তবে দৌড়ে তিনি না থাকলেও রবিবার শহিদ মিনারের মঞ্চ থেকে অমিত শাহ যেভাবে মুকুল রায় প্রসঙ্গে বলেছেন, “জিনকে কনভেনার রহেতে ভারতীয় জনতা পার্টি ৪২ মে সে ১৮ সিট প্রাপ্ত করা, অ্যায়সে হামারে মুকুল রায়জি”, এতে অনেকেই নতুন অঙ্ক কষতে খাতা-পেন্সিল নিয়ে বসে পড়েছেন৷ দিলীপবাবুরা এখন ঠিক পছন্দ করছেন না মুকুল রায়কে৷ কিছুদিন আগে সংবাদমাধ্যমে খোদ দিলীপবাবুই বলেছিলেন, মুকুলবাবুর তুলনায় কোচবিহারের সাংসদ নিশীথ প্রামাণিকের এলেম বেশি। তবে বিজেপি ও আরএসএসের একাংশ আজও মনে করেন, লোকসভা নির্বাচনে কোচবিহার, উত্তর মালদহ, বনগাঁ, বিষ্ণুপুর এবং পশ্চিমাঞ্চলে বিজেপি প্রার্থীর জয়ের নেপথ্য কারিগর মুকুলবাবু৷ কিন্তু দিলীপবাবুরা এ কথা একদমই মানতে চান না।
মুকুল রায় মুখ্যমন্ত্রীর দৌড়ে না থাকার ঘোষনাকে অনেকে আবার ‘হাই-লেভেল কৌশল’ বলে মনে করেন৷
ভাবনার তো আর শেষ নেই৷ রাজ্য- বিজেপির অনেকে আবার ভাবতে শুরু করেছেন, মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা হিসাবে বিজেপিও কোনও মহিলানেত্রীকেই এগিয়ে আনতে পারে।
মোটের ওপর রবিবারের শাহি-মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বঙ্গ-বিজেপি নেতারা গায়ে
‘মাটির ছাপ’ লাগাতে উঠে পড়ে লেগেছেন, তা সে ভোটের ফল যাই হোক৷
আরও পড়ুন-ভাষা ভদ্র হলে ‘গোলি মারো’ স্লোগানে আপত্তি নেই দিলীপ ঘোষের