Sunday, November 9, 2025
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে ধনী দেশ, “স্বপ্নের দেশ”। আমেরিকায় করোনাভাইরাস ও লকডাউনে রাতারাতি কর্মহীন প্রায় দু কোটি আমেরিকান। এটা শুধু সরকারি হিসেব। এই আলোচনাটার এখন আদৌ কোনো দরকার আছে কি? এই প্রশ্ন হয়তো অনেকেই করবেন।

বলবেন, এই সঙ্কটের সময়ে রাজনীতির আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। এখন শুধু প্রয়োজন মানুষের জীবন বাঁচানোর। অনেকে বলবেন, যেমন সবসময়েই বলে থাকেন, আপনি আমেরিকায় থেকে আমেরিকা সম্পর্কে সবসময়ে নেগেটিভ কথা লেখেন কেন? এতোই যদি আমেরিকা-বিদ্বেষ, ডলার কামানো ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে এলেই তো পারেন।
(এই মুহূর্তে অবশ্য ডলারও কামানো সম্ভব হচ্ছে না, কারণ প্রভুদের দয়ায় আমার চাকরিটাও রাতারাতি গেছে। যাক সে কথা।)
ঠিক যেমন এখানে আমার ইংরিজি লেখাগুলো পড়ে মার্কিন বন্ধুদের মধ্যেও কয়েকজন বলে থাকেন, এতোই যদি আমেরিকার সমালোচনা, তাহলে এখানে পড়ে না থেকে কেটে পড়লেই তো হয়। এসব আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। গরিব ঘরে জন্মেছিলাম তো, অনেক লড়াই করেছি বেঁচে থাকার জন্যে। গায়ের চামড়া গণ্ডারের মতো হয়ে গেছে। এসব কথায় আমার কোনো প্রতিক্রিয়া এখন আর হয় না।
ভারতে থাকলে ভারতীয় শাসকশ্রেণীর ও জনবিরোধী শাসনের কঠোর সমালোচনা করলে যেমন ভারতবিদ্বেষী, দেশদ্রোহী হওয়া বোঝায় না, ঠিক তেমনই আমেরিকায় থেকে আমেরিকার অত্যাচারী, সভ্যতাবিরোধী রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার চালিকাশক্তি ওয়াল স্ট্রিট, মিডিয়া ও যুদ্ধ কর্পোরেশনগুলির বিরুদ্ধে কথা বললে আমেরিকাবিদ্বেষ বোঝায় না।
প্রকৃতপক্ষে, সত্যের ওপর নির্ভর করে অত্যাচার, অনাচার, মিথ্যা, ঘৃণা, হিংসা এবং দেশের সম্পদ ও শ্রমকে লুঠপাট করার প্রকাশ্য ও গোপন ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেওয়া হল আসল দেশপ্রেম এবং মানুষকে যাচাই করা সত্য ও তথ্যনির্ভর শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হল শুধু দেশপ্রেম নয়, ঈশ্বরপ্রদত্ত ব্রত ও কর্তব্য।
সুতরাং, আজকের এই মহাসঙ্কটের দিনে মানবসভ্যতার অশনি সংকেতের কারণ অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করা আমার কাছে আসল ধর্ম ও বিবেক।
আমেরিকার কেন এই শোচনীয় দশা?
এই আজকেও, এই মৃত্যুর মিছিলের মধ্যেও, আমাদের ব্রুকলিনের বাড়ির সামনে দিয়ে মাঝে মাঝে কিছু লোক হেঁটে যাচ্ছে। তাদের মুখে কোনো মাস্ক নেই। কিছু কিছু গাড়ি মাঝে মাঝে যাচ্ছে। এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেও কোনো সাবধানতা অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে না তাদের। জানলার কাচ নামানো। চালকের মুখে মাস্ক নেই।
এই দেশটাই এমন। কেউ জানে না। আমেরিকা সম্পর্কে এমন একটা মায়াজাল সৃষ্টি করা হয়েছে বহুকাল ধরে যে মানুষ জানেই না এদেশের আসল চেহারাটা কেমন। এই করোনাভাইরাসের মৃত্যুর মিছিল তাই তাদের একটু হলেও ভেতর থেকে শক দিয়েছে। কট্টর আমেরিকাপন্থীরাও একটু মুশকিলে পড়ে গেছে তাদের নিজের কাছে, পরিবারের কাছে, বন্ধুদের কাছে ব্যাপারটার কারণ ব্যাখ্যা করতে। কোনো যুক্তিই খাটছে না।
সুতরাং, “এখন রাজনীতি করার সময় নয়” — এই হলো তাদের এখনকার মাস্টারমশাইদের বেত। সবচেয়ে পপুলিস্ট যুক্তিগুলো যা তারা সবসময়ে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে তা হল এই-

(১) আমেরিকার সমস্যার মূলে হলো মেক্সিকান ও অন্যান্য দেশের ইমিগ্রেন্টরা। (ঠিক যেমন আমাদের দেশে হিন্দুত্ববাদীদের বাংলাদেশী বা পাকিস্তানী ইমিগ্রেন্ট সম্পর্কে অপপ্রচার।)

সেটা এখন খাটছে না, কারণ পাশের দেশ ক্যানাডায় ঠিক আমেরিকার মতোই পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক সিস্টেম, এবং সারা পৃথিবী থেকে ইমিগ্রেন্টরা সেখানেও এসেছে বিশাল সংখ্যায়।

কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে আজ পর্যন্ত মৃতে সংখ্যার চেয়ে ক্যানাডায় সংখ্যাটা অনেকই কম। আর এক সমান্তরাল দেশ অস্ট্রেলিয়াতে আরও কম।

(২) আমেরিকার সমস্যার মূলে হলো “কালুয়া” বা “কাল্লুদের” অলসতা ও বসে বসে ওয়েলফেয়ার চেক নেওয়ার প্রবণতা। (ঠিক যেমন আমাদের দেশে গরিব “নিম্নবর্ণের” মানুষদের সম্পর্কে সবসময়ে বলা হয়ে থাকে।)

অথচ, ঠিক আমাদের দেশের ওই দলিত বা নিচু জাতের মানুষদের সবচেয়ে নিচুতলার কাজগুলো না করলে যেমন আমাদের মতো সুখী লোকেদের চলবে না — আমরা শুধু চন্ডীপাঠ করতে পারি, কিন্তু জুতো সেলাই বলুন বা মলমূত্র সাফ করা বলুন, এমনকী মৃতদেহ সৎকার বলুন- ওই নিচু জাতের লোকেদের ছাড়া আমাদের “সভ্যতা” অচল। ঠিক তেমনই আমেরিকায় ওই গরিব কালো মানুষগুলোর এবং এখনকার দিনে মেক্সিকো বা বাংলাদেশ বা কলম্বিয়া কী গুয়াতেমালা থেকে আসা মাইগ্রেন্ট শ্রমিকদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম ছাড়া আমাদের বা আমাদের থেকেও সুখী আমেরিকানদের একদিনও চলবে না। কিন্তু তাদের শ্রমের মূল্য সুখী আমেরিকানরা কোনোদিনও দেয়নি, আর আজও দিচ্ছে না। অনাহারে কেউ হয়তো আমেরিকায় খুব একটা থাকে না, কিন্তু অর্ধাহারে অনেকেই থাকে। অসংখ্য লোক থাকে — বিশেষ করে ওই কালোরঙের আর বাদামি রঙের গরিব লোকগুলো আর তাদের পরিবার। অগন্তি, অসংখ্য।
তাদের মধ্যেই কিন্তু করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি, পিজ্জা হাট, পপআই’স চিকেন, সনিক, চেকার্স আর নানা জাঙ্ক ফুড খেয়ে, আর কোক পেপসি এবং এই ধরণের বিষাক্ত পানীয় যুগ যুগ ধরে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে মানুষগুলোর প্রতিরোধক্ষমতা একেবারেই শেষ। ওরা কেউ ইচ্ছে করে এসব খাবার খায় না। বাধ্য হয়ে খায়। কারণ, সস্তা। কারণ, বাড়িতে রান্না করে খাওয়ার সময় নেই — সারাদিন রাস্তায় কাজ করে বেড়াচ্ছে তারা জীবনধারণের তাগিদে।
এই হলো আমেরিকা। তার সঙ্গে যোগ করুন আকাশছোঁয়া অশিক্ষা, ধর্মান্ধতা ও বিজ্ঞান বিরোধিতা। আমেরিকার গুজরাট, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র আর ছত্তিসগড় — অর্থাৎ কেন্টাকি, মিসিসিপি, টেক্সাস, লুইসিয়ানা, অ্যালাবামা, জর্জিয়া বা ক্যারোলাইনা — সেসব জায়গায় এখনো বহু চার্চ খোলা। মানুষের বিন্দুমাত্র সচেতনতা নেই।
এই সেদিনই এক ধর্মযাজক “গড উইল সেভ মি, আই এইন্ট নো ফিয়ার” বুক বাজিয়ে চার্চে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। তিনি এখন ওপরে — যীশুর কোলে। এরকম লোক আমেরিকায় কয়েক কোটি আছে।

Related articles

পশ্চিমবঙ্গই সেরা পারফর্মার: এসআইআর-এ রাজ্যের সাফল্যে সন্তুষ্ট নির্বাচন কমিশন

রাজনৈতিক সংঘাত ও প্রশাসনিক টানাপোড়েনের মধ্যেও এসআইআর সংক্রান্ত সামগ্রিক কাজ এবং এনুমারেশন ফর্ম বিলির ক্ষেত্রে সবার আগে পশ্চিমবঙ্গ।...

রবিতেও ঠাকুরনগরে এলো অ্যাম্বুল্যান্স: ২১ অনশনকারীর মধ্যে অসুস্থ ৯

এসআইআর-এর প্রতিবাদে আমরণ অনশনে মতুয়া পরিবারের সদস্যরা। মতুয়া দলপতিদের অনশনের সিদ্ধান্তে সমর্থন জানিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল সাংসদ মমতাবালা...

কংগ্রেসকেও সমর্থন করতে পারত RSS: অরাজনৈতিক সাজার চেষ্টা মোহন ভাগবতের!

একশো বছর উদযাপন ঘিরে রাতারাতি প্রচারের আলোয় অনেক বেশি করে আসছে আরএসএস। সেই সঙ্গে এবার প্রকাশ্যে হিন্দুত্ববাদী চিন্তাধারাকে...

সহপাঠীকে গুলি একাদশ শ্রেণির দুই ছাত্রের, ফ্ল্যাটে উদ্ধার অস্ত্রের সম্ভার

শনিবার রাতে গুরুগ্রামের সেক্টর ৪৮-এ এক অভিজাত আবাসনে ডিনারে ডেকে এনে সহপাঠীকে গুলি করার অভিযোগ উঠল একাদশ শ্রেণির...
Exit mobile version