
কমিউনিস্টরা আজ, ৪ জুন, অন্তত একবার ওই নারকীয় ছাত্রমেধ-যজ্ঞের সহজ,সরল ভাষায় নিন্দা করুন, শোকপ্রকাশ করুন, পারলে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলুন….

১৯৮৯ সালের মে মাসের শেষ- জুনের প্রথম সপ্তাহ৷ চরম উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে বেজিং শহর৷ প্রবল ছাত্র- বিক্ষোভের মুখে চিনের কমিউনিস্ট সরকার৷ মাসকয়েক মাস ধরে চলতে থাকা ছাত্র আন্দোলন ক্রমশই এক জাতীয় আন্দোলনের চেহারা নিয়েছে। ক্রমেই পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এর পরই কমিউনিস্ট সরকার শক্ত হাতে আন্দোলন দমন করার সিদ্ধান্ত নিলো। প্রশাসনিক নির্দেশে ৩-৪ জুন সুসজ্জিত ট্যাঙ্কবাহিনী রওনা দিলো তিয়েন আনমেন স্কোয়ারের দিকে। চিনের রাজধানী বেজিং শহরের প্রাণকেন্দ্রে তিয়েন আনমেন স্কোয়ার৷এই স্কোয়ারের উত্তরদিকে ‘তিয়েন আনমেন’ নামে একটি ‘সিংহদরজা’ রয়েছে। ‘তিয়েন আনমেন’ কথার অর্থ ‘স্বর্গের দরজা’। স্বর্গ-ই বটে৷ ওই ‘সিংহদরজা’র সাথে মিলিয়ে চত্বরের নামকরণ করা হয় তিয়েন আনমেন স্কোয়ার৷
চিনের ইতিহাসে অসংখ্য ছোট-বড় আন্দোলনের স্মৃতিকে সঙ্গী করে দাঁড়িয়ে আছে এই চত্বর। কিন্তু সবধরনের আন্দোলনের ইতিহাস ছাপিয়ে ’৮৯ এর ছাত্র আন্দোলন তিয়েন আনমেন স্কোয়ারকে বধ্যভূমি বানিয়ে স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়৷ ওই স্কোয়ারে তখন বিগত দু’মাস ধরে চিনের ছাত্রসমাজের আন্দোলন চলছে৷

৩১ বছর আগে, ১৯৮৯ সালের জুনের ৪ – ৫ তারিখ৷ চিনের বেজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের সেই ছাত্রবিক্ষোভকে কেন্দ্র করে একটা ছবি বিংশ শতাব্দীর মর্মস্পর্শী ছবিগুলোর একটি হয়ে উঠেছিল৷ বিশ্বজুড়ে সুপার-ভাইরাল হয় সেই ছবি৷
৫ জুন প্রকাশিত ওই ছবিতে দেখা যায়, লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেনাট্যাঙ্কের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছেন এক ছাত্র৷ তিয়েন আনমেন স্কোয়ারের দিকে মুখ করা ৪টি সেনাট্যাঙ্কের যাত্রাপথে একাই পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়ে আছেন ছাত্রটি৷ তাঁর হাতে দুটি শপিং ব্যাগ৷ তিনি ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে সেগুলিকে তিয়েন আনমেন স্কোয়ারের দিকে যেতে বাধা দিচ্ছেন৷ একটি ট্যাঙ্কও সামনে এগোতে পারছে না। পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে এক অকুতোভয় ছাত্র। কী সাংঘাতিক সাহস এই ছোকরার! যে ট্যাঙ্ক বাহিনীর ভয়ে শক্তিশালী সেনাদল পর্যন্ত থর থর করে কাঁপে, আজ এক নিরস্ত্র সাধারণ ছাত্র সেই দর্পিত ট্যাঙ্ক বাহিনীর পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছেন৷ সামনের ট্যাঙ্ক একটু পিছিয়ে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করলো। মুহুর্তে সেই ছাত্রও জায়গা বদলে ফের দাঁড়ালো ট্যাঙ্কের সামনে৷ এখানেই শেষ নয়। সেই ছাত্র হাত নেড়ে ট্যাঙ্কবাহিনীকে ইশারা করলো পিছু হটে যেতে। সম্ভবত ওই ছাত্রের সাহস দেখে বিস্মিতই হয়েছিলেন ট্যাঙ্কবাহিনীর কমান্ডার। গোটা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে দেখলো সেই দৃশ্য৷ খানিক পর দুই ফৌজি তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যায়।
পরে তাঁর কি হয়েছে, কেউ জানে না৷ হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে৷ কিন্তু ততক্ষণেই তিনি হয়ে ওঠেন বিক্ষোভের এক প্রতীক৷ দুনিয়া ওই ছাত্রের নাম দেয় “ট্যাঙ্ক-ম্যান”৷
চিনের তথা বিশ্বের ছাত্র আন্দোলনের প্রতীক সেই নাম না জানা ছাত্রের বীরত্বে সেদিন পৃথিবী দেখেছিল নতুন এক চিনকে।

১৯৮৯-এর মে মাসের শেষ সপ্তাহে বেজিংয়ে জারি করা হয় মার্শাল ল৷ ৩-৪ জুন তিয়েন আনমেন স্কোয়ারের দিকে এগোতে শুরু করে চিনা সেনাবাহিনী৷ ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে হাজার হাজার সেনা ট্যাঙ্ক-পর্যন্ত নিয়ে ঘিরে ফেলে স্কোয়ারের চারদিক৷ নির্বিচারে গুলি চালায় আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর৷ সব কিছু ভেঙেচুরে ছাত্রদের তাজা, গরম রক্তে ধুয়ে দেয় আন্দোলনের চিহ্ন৷
আজও কারো জানা নেই, তিয়েন আনমেন স্কোয়ারের ছাত্র বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার ‘অপরাধে’ চিনের কমিউনিস্ট সরকার কতজনকে হত্যা করেছে৷
১৯৮৯ সালে জুনের শেষ নাগাদ, চিন সরকার জানিয়েছিল, অসামরিক কিছু লোক এবং সেনা মিলিয়ে বিক্ষোভে ২০০ জনের মতো নিহত হয়েছে। চিরাচরিত কমিউনিস্ট-সুলভ এই তথ্যে সারা পৃথিবী হেসেছে৷ ২০১৭ সালে এক ব্রিটিশ কূটনৈতিক নথিতে জানা যায়, সে সময় চিনে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার অ্যালান ডোনাল্ড যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, সেখানে তিনি বলেছিলেন ওই ঘটনায় চিনে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের ৮০ শতাংশই ছাত্র৷

তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা আজও চিনে অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়, অপরাধও বটে। ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে, ছবি বক্তব্য বা পোস্ট ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিয়মিত সরিয়ে দেওয়া হয়৷ সরকার নিজেই কঠোরভাবে এই ‘সরিয়ে দেওয়ার’ কাজটি নিয়ন্ত্রণ করে।

চিনের এখনকার প্রজন্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ জানেই না তিয়েন আনমেন স্কোয়ারের সেদিনকার ঘটনা৷ কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা ভুলিয়ে দিয়েছে ওই ছাত্রমেধ যজ্ঞের ইতিহাস৷ কমিউনিস্ট শাসকরা তো কোনও কালে কোনও দেশেই সমালোচনা সহ্য করতে পারেনি৷ প্রতিটি সমালোচনার জবাব দিয়েছে রক্তনদী তৈরি করে৷

একটু সময় লেগেছে, কিন্তু এ ধরনের পৈশাচিক মনোবৃত্তির জবাবও একটু একটু করে দুনিয়ার মানুষ দিয়েছে৷ একের পর এক নিশ্চিহ্ন হয়ে চলেছে কমিউনিস্ট-বিশ্ব৷ দ্বীপের মতো কিছু জায়গায় ভেসে আছেন কমিউনিস্টরা৷ ভারতেও একই ছবি৷
কমিউনিস্টদের অস্তিত্ব আজ টিঁকে রয়েছে শুধুই বইপত্রে, বিবৃতিতে৷ ‘জলসাঘর’- ফোটোকপি আজ দেখা যাচ্ছে বিশ্বজুড়েই৷
