
একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে লকডাউন শিথিল করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ দেশে চালু করেছেন আনলক-১ পর্ব৷ আর ‘আনলক’ ঘোষণার পর দেশে প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন প্রায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ৷ মৃত্যুর সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে৷ শুক্রবার, ১২ জুন, কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ১০,৯৫৫ জন৷ মোট আক্রান্ত ২ লক্ষ ৯৭ হাজার৷ ২৪ ঘন্টায় মৃত্যু হয়েছে ৩৯৬ জনের৷ ভারতে মোট মৃত্যু হয়েছে ৮,৪৯৮ জনের৷

এই পরিসংখ্যানের পরেও মোদিজি নীরব৷ শাহজি রাজ্যে রাজ্যে ভোটপ্রচার করছেন৷ ভক্তরা মোদি-মাহাত্ম্যে মুগ্ধতা প্রকাশ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাণী দিচ্ছেন৷ আর এই পরিসংখ্যান বুঝিয়ে দিচ্ছে ভারতে কোনও সরকার থাকা বা না-থাকা, দুই-ই সমান৷ তিনমাস ভারতবর্ষকে তালাবন্দি করেও সংক্রমণ রুখতে দেশের সরকার ব্যর্থ ৷ সেই ব্যর্থতা যখন দেশকে, দেশবাসীকে গিলে খাচ্ছে, তখনও মোদিজি ভার্চুয়ালি লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দিচ্ছেন৷ অমিত শাহ ব্যস্ত বাংলা, বিহারের ভোট নিয়ে৷ দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়ে বঙ্গ- বিজেপির কোন্দল সামলানো এখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে করোনা সামলানোর থেকেও জরুরি৷ ‘Statistics- friendly’ সরকারের একের পর এক ‘শুনতে ভালো’ স্ক্রিপ্ট-ই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করবে, এমন ধারনা নিয়েই দেশের সরকার বসে আছে৷ অথবা এই মুহুর্তে করোনা ভাইরাসের ওপরই নির্ভর করে অপেক্ষা করেছে, সে নিজে কখন নিস্তেজ হবে৷

এসব ছেলেখেলা বন্ধ করে এখনই দেশজুড়ে সম্পূর্ণ লকডাউন চালু না করলে দিনের পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য৷ একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে টিম-মোদি দেশবাসীকে হিটলারের গ্যাস- চেম্বারের থেকেও ভয়াবহ এক ‘ভাইরাস-চেম্বারে’ বন্দি করে রেখেছে৷ কেন্দ্রে কোনও সরকার না থাকলেই বা আর কত খারাপ পরিস্থিতি হতো ? কেন্দ্রীয় সরকারের চরমতম ব্যর্থতার মাশুল কেন দিতে হবে দেশবাসীকে ? কোন সাইজের থালা বাজালে অথবা হ্যারিকেন জ্বালালে করোনা দেশ ছাড়বে, ব্ল্যাক ম্যাজিকের সহায়তায় সেই তথ্য সম্ভবত এখনও প্রধানমন্ত্রী জেনে উঠতে পারেননি৷ দেশে করোনা আক্রান্তের দৈনিক সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই দু-একদিনের মধ্যে ১৫ হাজার ছুঁয়ে ফেলবে৷ অথচ প্রধানমন্ত্রীকে এখনও কার্যকর কোনও পদক্ষেপের কথা বলতে শোনা যাচ্ছে না৷ এ কেমন সরকার ? কাদের হাতে ১৩০ কোটি মানুষের নিরাপত্তা?

ওদিকে, সিকিউরিটিজ রিসার্চ ফার্ম Nomura সংস্থার সাম্প্রতিক সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনা আক্রান্তের নিরিখে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিবহুল ১৫টি দেশের মধ্যে ঢুকে পড়েছে ভারত৷

Nomura সমীক্ষা চালিয়েছে বিশ্বের ৪৫টি বড় দেশের অর্থনীতির উপরে৷ লকডাউন তোলার ফলে করোনা আক্রান্ত কতটা হারে বাড়ছে, তার উপরেই সমীক্ষাটি চালানো হয়৷ রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভের ঝুঁকি প্রবল, এমন দেশগুলির তালিকায় প্রথম সারিতেই রয়েছে ভারত৷ ওই রিপোর্ট বলছে,
◾ অর্থনীতির বড় অংশ খুলে দেওয়া হয়েছে, এমন ১৭টি দেশে সংক্রমণের “সেকেন্ড ওয়েভ” বা দ্বিতীয় ঢেউ আসার লক্ষণ নেই৷
◾১৩টি দেশের ক্ষেত্রে সেকেন্ড ওয়েভের সম্ভাবনা থাকলেও ঝুঁকি তুলনায় অনেক কম৷

◾ ১৫টি দেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সেকেন্ড ওয়েভের ঝুঁকি প্রবল থেকে প্রবলতর৷ আর তারই মধ্যে রয়েছে ভারত৷

সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, লকডাউন ওঠার ফলে ভালো-খারাপ, ২টি দিকই সমান সক্রিয় আছে৷ ভালো বিষয়টি হলো, দেশবাসী উজ্জীবিত হয়ে মূলস্রোতে ফিরছে৷ গতিশীলতাও ফিরে আসছে৷ সংক্রমণের হার যেহেতু কম, তাই মানুষের মনের আতঙ্কও কমছে৷ এবং এই গতিশীলতার জেরে করোনা-পূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরে আসছে দেশের অর্থনীতি৷ আর খারাপ চিত্রটি হচ্ছে, অর্থনীতির চাকা ঘুরছে বটে, তার সঙ্গে নতুন আক্রান্তের সংখ্যাও লাফিয়ে বাড়ছে৷ ফলে মানুষের মনে আতঙ্কও আগের থেকে বাড়ছে৷ এই আতঙ্কের পরিবেশ কখনই দেশের অর্থনীতিকে স্বস্থানে ফেরাতে পারেনা৷

দেশের এই মুহুর্তের করোনা সংক্রমণের গ্রাফ কী কথা বলছে, তা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন হয়না৷ মোদি নীরব থাকতেই পারেন, কিন্তু বাস্তব এটাই, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে ভারতের৷ ওই সমীক্ষায় ৪৫টি দেশকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে৷
◾(১) অন ট্র্যাক অর্থাত্ সব কিছু স্বাভাবিক৷ অন ট্র্যাক বা ঝুঁকি প্রায় নেই, এমন গোষ্ঠীতে রয়েছে, ফ্রান্স, ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়া৷

◾(২) ওয়ার্নিং সাইনস বা সতর্কতার লক্ষণ৷ জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো দেশগুলি এই হালকা ঝুঁকিপ্রবণ গোষ্ঠীতে রয়েছে৷
◾(৩) ডেঞ্জার জোন বা দ্বিতীয় ঢেউয়ের ঝুঁকি প্রবল৷ অশনি সংকেত, ভারত পড়ছে ওই বিপজ্জনক ৩ নম্বর জোনে৷ ভারতের সঙ্গে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত আয়ের জনসংখ্যার দেশগুলির মধ্যে এই বিপজ্জনক জোনে আছে ইন্দোনেশিয়া, চিলি, পাকিস্তানের মতো দেশগুলি৷ এই গোষ্ঠীতে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলির মধ্যে রয়েছে সুইডেন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা ও কানাডা৷
মোদিজি দেশে আনলক চালু করেছেন অর্থনীতির দোহাই দিয়ে৷
অথচ তাঁর কৃতিত্বেই করোনা সংক্রমণের ঢের আগেই দেশের অর্থনীতি তলিয়ে গিয়েছে৷ দেশজুড়ে জাঁকিয়ে বসা করোনা আতঙ্ক, নাগরিকদের স্বাভাবিকভাবে কাজে মন দেওয়ার সাহস দিচ্ছে না৷ স্রেফ হুকুম তামিল করতে মানুষ কাজে যোগ দিয়েছে৷ ফতোয়া জারি করে ‘আতঙ্কিত’ কর্মীদের কাজের জায়গায় টেনে আনা অবশ্যই যায়, কিন্তু তাতে দেশের পক্ষে ইতিবাচক উন্নতি কতখানি হচ্ছে, সেটা দেখার দায়িত্ব কার ? তা ছাড়া ঝুঁকি নিয়ে বাস- ট্রাম- অটো- ফেরিতে কর্মস্থলে যাতায়াত করে নিজের তো বটেই, বাড়ির লোকজনকেও সংক্রমিত করার এই ছেলেখেলা চালিয়ে কার লাভ হচ্ছে ? অর্থনীতির দোহাই দিয়ে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করার দায় রাষ্ট্রকে নিতেই হবে ৷


এই পরিস্থিতি বদলে দেওয়ার পথ এখন একটাই৷ এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে আজ, এখনই দেশজুড়ে সম্পূর্ণ লকডাউন চালু করতে হবে৷ সব কিছু বন্ধ করে মানুষকে ফের ঘরে পাঠাতে হবে৷ অফিস- কাছারি, ব্যবসাক্ষেত্র, দোকান-বাজার সব বন্ধ রাখতেই হবে৷ বেছে বেছে সংসদ ভবন, কেন্দ্রের কিছু দফতর, বিশেষ কিছু ভবনের জন্য এক ধরনের বিধি, আর গোটা দেশের জন্য অন্য রকম, এ কেমন দ্বিচারিতা ?

দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর অনেক আগেই যারা দায়িত্ব নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে বারাণসী’র গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছে, তাদের মুখে অর্থনীতির দোহাই দিয়ে ১৩০ কোটি মানুষের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করার অধিকার কতটুকু আছে, তা দেশের মানুষকে ভেবে দেখতেই হবে৷
