নারদ-মামলায় মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রীর হলফনামা গ্রহণ করার বিষয়ে বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানি শেষ হয়েছে৷ ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, আগামীকাল, বুধবার এ সংক্রান্ত রায় ঘোষণা করা হবে৷

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে সোমবারই হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে নির্দিষ্ট আবেদন পেশ করেন মুখ্যমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী৷ এদিন নারদ-মামলায় ওই আবেদনের শুনানি হয় পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে৷
মঙ্গলবারের শুনানিতে বৃহত্তর বেঞ্চের দুই বিচারপতির প্রশ্নের মুখে পড়েন CBI-এর কৌঁসুলি দেশের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহেতা৷

মেহেতাকে এদিন বিচারপতি হরিশ ট্যাণ্ডন প্রশ্ন করেন, “ওই দিনের (১৭ মে’র) ঘটনা সম্পর্কে যে তথ্য রাজ্যের কাছে আছে তা যদি আদালতের কাছে হলফনামা আকারে পেশ করতে চায়, সেক্ষেত্রে CBI- এর আপত্তি কোথায়” ? এর ঠিক পরই বিচারপতি সৌমেন সেন প্রশ্ন করেন, “শুধুমাত্র CBI অভিযোগ করেছে বলেই মানুষের জমায়েতের তত্ত্ব মেনে নিতে পারে না আদালত।”

গত শুক্রবার শীর্ষ আদালতে বিচারপতি বিনীত সারিন ও বিচারপতি দীনেশ মাহেশ্বরীর এজলাসে মুখ্যমন্ত্রীর তরফে সওয়ালে বলা হয়, কলকাতা হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে চালু থাকা নারদ- মামলায় CBI তাঁকে পক্ষভুক্ত করেছে৷ অথচ তাঁর হলফনামা জমা নেয়নি হাইকোর্ট। গত ৯ জুন তাঁর হলফনামা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে বৃহত্তর বেঞ্চ। যে বিষয়টি সামনে এনে CBI নারদ- মামলায় তাঁকে পক্ষভুক্ত করেছে, সে বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজের বক্তব্য পেশ করতে চান হলফনামার মাধ্যমে৷ নিজের বক্তব্য জানানোর সুযোগ থেকে, তাঁকে বঞ্চিত করেছে বৃহত্তর বেঞ্চ৷ বৃহত্তর বেঞ্চে তাঁকে হলফনামা পেশ করার অনুমতি দেওয়া হোক৷ এই একই আর্জি জানিয়ে শীর্ষ আদালতে আবেদন জানান রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক এবং রাজ্য সরকারও৷ একইসঙ্গে সব আবেদনের শুনানি হয় বিচারপতি সারিন ও বিচারপতি মাহেশ্বরীর এজলাসে৷ দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর দেশের শীর্ষ আদালত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেদন গ্রহণ করে জানায়, নারদ- মামলায় হলফনামা জমা নেওয়ার জন্য কলকাতা হাইকোর্টে নতুন করে আবেদন জানাতে হবে মুখ্যমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং রাজ্য সরকারকে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সেই আবেদন খতিয়ে দেখার জন্য কলকাতা হাইকোর্টের পাঁচ বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চকে নির্দেশও দেয় শীর্ষ আদালত ৷ সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চের নির্দেশে বলা হয়েছে,

(১) হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং রাজ্য সরকার, তিন পক্ষকেই নতুন করে আবেদন পেশ করে জানাতে হবে, ‘ইতিমধ্যেই দাখিল করা আমাদের হলফনামা গ্রহণ করা হোক৷’ এই আবেদন করতে হবে আগামী ২৮ জুন৷

(২) এই আবেদনের কপি আগাম পাঠাতে হবে CBI-সহ সব পক্ষকে৷

(৩) CBI প্রয়োজন মনে করলে এই আবেদনের জবাব দিতে পারবে৷

(৪) হাইকোর্টে বিচারাধীন নারদ-কাণ্ডের মূল মামলা শোনার আগেই বৃহত্তর বেঞ্চকে মুখ্যমন্ত্রী-সহ বাকিদের তরফে পেশ করা নতুন আবেদনের নিষ্পত্তি করতে হবে ২৯ জুন৷

সর্বোচ্চ আদালতের এই নির্দেশের ভিত্তিতেই বৃহত্তর বেঞ্চে সংশ্লিষ্ট আবেদন দাখিল করেছেন মুখ্যমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রী৷ মঙ্গলবারের সব পক্ষই নিজেদের বক্তব্য আদালতে পেশ করেন৷

রাজ্য সরকারের পক্ষে অ্যাডভোকেট জেনারেল (AG) এদিন বলেন,

◾AG কিশোর দত্ত – ৫ জুন এবং ৭ জুন বৃহত্তর বেঞ্চে হলফনামা দিতে চেয়েছিলেন আইনমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী ।

◾AG – ২৭ মে থেকে রাজ্য এই মামলায় রয়েছে৷ ২ জুন CBI সওয়াল শেষ করেছে। ৭ জুন আমরা হলফনামা জমা দেওয়ার আবেদন জানাই। ঘটনার সব তথ্য রাজ্য সরকারের কাছে রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়। নিরাপত্তার বিষয়টিও রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত। তাই আমাদের হলফনামা জমা দেওয়া প্রয়োজন।
পাশাপাশি ৪ হেভিওয়েটকে রাজ্য সাহায্য করছে বলে যে অভিযোগ CBI করছে, তার বিরোধিতাও আমরা করছি। সেই কারণেও আমাদের হলফনামা দেওয়া প্রয়োজন। ( নিজের যুক্তির পক্ষে বেশ কিছু নির্দেশনামা পেশ করেন অ্যাডভোকেট জেনারেল)

◾ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি : মিঃ AG, এখন কেন হলফনামা জমা করতে চায় রাজ্য ? রাজ্য তো প্রথম দিন থেকেই এই মামলায় ছিলো, তবুও কেন সঠিক সময়ে হলফনামা জমা করেননি ?

◾AG – রাজ্য ২৭ মে থেকে এই মামলায় যুক্ত আছে। আইন অনুযায়ী হলফনামা জমা দেওয়ার জন্যে আমরা ৪ সপ্তাহ সময় পাবো। আমরা ৭ জুন হলফনামা পেশ করার আবেদন করেছিলাম। আমাদের হলফনামা পেশ করার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যায়নি।
◾ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি – মিঃ দত্ত, মনে করুন যে ৪ সপ্তাহের মধ্যে শুনানি শেষ হয়ে গেলো। সেক্ষেত্রে কি শুনানি শেষ হওয়ার পরেও হলফনামা গ্রহণ করতে হবে ?
◾বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় (AG উদ্দেশ্য করে) – আপনাদের এই আবেদনের শুনানি যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে। আপনাদের হলফনামা নেওয়ার আবেদন আমরা খারিজ করলাম, মামলা সুপ্রিম কোর্টে গেলো, সেখান থেকে আবার এখানে ফেরত পাঠানো হলো। এই বিষয়ে শুনানি বেশিদিন চলতে পারে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে ভুল বার্তা যাবে৷
◾AG – আইন শৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়, তাই আমাদের হলফনামা নেওয়া হোক।
রাজ্যের সওয়াল শেষ । সওয়াল শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রীর আইনজীবী রাকেশ দ্বিবেদি।
◾রাকেশ দ্বিবেদি – শুধুমাত্র বিলম্বের কারণে মামলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিতে অস্বীকার করতে পারে না আদালত।
রাকেশ দ্বিবেদি – এটা শুধুমাত্র একটা স্থানান্তরের মামলা নয়। এই মামলায় অনেক গুরুত্বপূর্ন বিষয় যুক্ত আছে। এটা কোন দেওয়ানি মামলাও নয়, তাই CBI আমাদের হলফনামা জমা দেওয়ার বিরোধিতা করতে পারেনা।
◾রাকেশ দ্বিবেদি – মুখ্যমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রী এই মামলায় অভিযুক্ত নন। মানুষের জমায়েত ও বিক্ষোভের কারণ দেখিয়ে তাঁদের এই মামলায় যুক্ত করা হয়েছে। তাই এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য রয়েছে৷
মুখ্যমন্ত্রীর আইনজীবী রাকেশ দ্বিবেদি’র সওয়াল শেষ। CBI-এর তরফে দেশের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহেতা’র সওয়াল শুরু৷
◾সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহেতা – ঘটনার দিন, ১৭ মে থেকেই মুখ্যমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
◾বিচারপতি হরিশ ট্যাণ্ডন – ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে যে তথ্য রাজ্যের কাছে আছে তা যদি আদালতের কাছে হলফনামা আকারে পেশ করতে চায়, সেক্ষেত্রে CBI- এর আপত্তি কোথায় ?
◾বিচারপতি সৌমেন সেন – মিঃ মেহেতা, শুধুমাত্র CBI অভিযোগ করেছে বলেই মানুষের জমায়েতের তত্ত্ব মেনে নিতে পারে না আদালত।
◾মেহেতা – পরিকল্পিতভাবেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হলফনামা জমা দেননি মুখ্যমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রী।
এর পরই সওয়াল শেষ করেন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহেতা। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি জানালেন, শুনানি শেষ,আগামীকাল বুধবার রায় ঘোষণা করা হবে।