Thursday, November 6, 2025

শতবর্ষ পেরিয়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Date:

শতবর্ষ পার করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (Dhaka University)। ঢাকার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টির আজ জন্মদিন। জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হয়ে আজ ১০১ বছরে পা দিল এ জাতির বাতিঘর। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে অবহেলিত এ অঞ্চলে একটি উচ্চশিক্ষিত শ্রেণি তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।

এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (Sheikh Mujibur Rahman) জন্মশতবর্ষ। তাই এই আনন্দঘন মুহূর্তে এবার দেশ এবং প্রবাসে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরাজ করছে বাড়তি উচ্ছ্বাস-উল্লাস। তবে করোনা মহামারি এই উল্লাস প্রকাশের পথে অনেকটাই বাদ সেধেছে। তাই নানা পরিকল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত কাটছাঁট করা হয়েছে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায়।

আজ থেকে একশ বছর আগে আত্মপ্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অসাধারণ শিক্ষক ও মানসম্পন্ন পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে এটি হয়ে ওঠে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’। পরবর্তীকালে এই অঞ্চলের মানুষের অধিকার আদায়ের কেন্দ্রবিন্দুতেও পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে জন্ম নিয়েছে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত নানা সমস্যা ও সংকট পেরিয়ে এ প্রতিষ্ঠান এ দেশের মানুষের সামনে খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। সাফল্যের সঙ্গেই আজ এই বিশ্ববিদ্যালয় পার করছে প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ।

ব্রিটিশ শাসনামলে প্রতিষ্ঠার শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়েছিল। এ ছাড়া ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এর ফলে পূর্ব বাংলার মানুষ হতাশা প্রকাশ করে। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সরকারের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্বান জানান। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন গভর্নর জেনারেল এ বিলে সম্মতি দেন। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ৮৪৭ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে।

সে সময়ে ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রমনা Ramna  এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশের পরিত্যক্ত ভবনাদি এবং ঢাকা কলেজের Dacca college (বর্তমান কার্জন হল) ভবনগুলোর সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার এই দিনটি প্রতিবছর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।

শুরুতে তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পথ চলতে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ডিগ্রি ক্লাসে অধ্যয়নরত ছাত্রদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু হয়। শুধু ছাত্র নয়, শিক্ষক এবং লাইব্রেরির বই ও অন্যান্য উপকরণ দিয়েও এই দুটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করে।

এই সহযোগিতার কৃতজ্ঞতা হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলের নামকরণ করা হয় ঢাকা হল (বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল) ও জগন্নাথ হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ১৯৬১ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের সরকার প্রবর্তিত অর্ডিন্যান্স বাতিলের জন্য ষাটের দশক শিক্ষকরা আন্দোলন শুরু করেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সেই অর্ডিন্যান্স বাতিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডার-১৯৭৩ জারি করে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় এই আইনেই পরিচালিত হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনার বিকাশ ঘটতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটতে থাকে। ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে গঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ। ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেই গৃহীত হয়। ভাষাশহীদ আবুল বরকত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ‘৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গভীরভাবে সম্পৃক্ত। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেই প্রথম আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। সংগ্রামী মনোভাবের কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিলেন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর চক্ষুশূল।

মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় ধরে তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্রাধিক ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীকে হত্যা করা হয়। ছাত্রদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি বিশ্নেষণ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে বলা হয়ে থাকে যে সাধারণত একটি দেশ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ তৈরি করেছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনও এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতারই অংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বাঙালি ও বাঙালিরই ইতিহাস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।

এখানে এখন নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৯ হাজার ছাড়িয়েছে। শিক্ষার্থী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবাসন সুবিধা না বাড়ায় সময়ের স্রোতে দেশের সর্বোচ্চ এ শিক্ষায়তন আবাসিক চরিত্র হারিয়েছে।

কর্মসূচি :চলমান করোনা মহামারি পরিস্থিতি বিবেচনায় আজ বৃহস্পতিবার সীমিত পরিসরে অনলাইনে প্রতীকী কর্মসূচি পালিত হবে। এর অংশ হিসেবে উপাচার্য আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে আজ বিকেল ৪টায় এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে মূল বক্তা হিসেবে সংযুক্ত থাকবেন বিশিষ্ট ভাষাসংগ্রামী, কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবী আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। তিনি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ : ফিরে দেখা’ শীর্ষক মূল বক্তব্য দেবেন। |https://www.facebook.cok/ থেকে এ আলোচনা সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।

আরও পড়ুন- পিএনবি কাণ্ডে বড় সাফল্য ইডির, টাকা ফেরালেন নীরব মোদি-র বোন

 

Related articles

হরিয়ানায় ভোটার জালিয়াতি: প্রকাশ্যে এসে ব্রাজিলিয়ান ‘মডেল’ বললেন, ভারতেই যাইনি কোনওদিন

হরিয়ানায় ভোটার জালিয়াতিতে যার ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল বলে অভিযোগ, সেই ব্রাজিলিয়ান মডেলের (Brazilian  Model) নাম 'ল্যারিসা'। এবার...

লালবাজারে কাছে গাড়ির টুলসের গোডাউনে আগুন, ঘটনাস্থলে দমকলের ৫ ইঞ্জিন

শহর কলকাতায় ফের অগ্নিকাণ্ড (Fire breaks Out in Kolkata)। বৃহস্পতিবার সকালে লালবাজারের কাছে ২১ নম্বর আর এন মুখার্জি...

সকালে শীতের আমেজ, রাতে পারদ পতনের সম্ভাবনা!

শীতের (Winter) অফিশিয়াল ঘোষণা হোক বা না হোক নভেম্বরের গোড়া থেকেই সকাল রাতে প্রকৃতির হিমেল ছোঁয়ায় শিহরিত হচ্ছে...

তারাসুন্দরীর মঞ্চে ম্যাজিক দেখালেন গার্গী

কুণাল ঘোষ বাংলার নাট্যমঞ্চে ইতিহাসের পাতাকে পুনরুজ্জীবিত করেই এক নতুন ইতিহাস লেখা হল। লিখলেন অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরী (Gargi Raychowdhuri),...
Exit mobile version