‘মাসল্ মেমরি, এক সাধনা’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

যাঁরা কান দিয়ে শোনেন তাঁদের কাছে কেবলমাত্র একবার শোনাটা যথেষ্ট না-ও হতে পারে । কিন্তু যাঁরা আত্মা দিয়ে অর্থাৎ সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে কোনোকিছু শোনেন তাঁদের ক্ষেত্রে একবার শোনাটাই যথেষ্ট ।

ঠিক তেমনি যাঁরা শুধুমাত্র চোখ দিয়ে দেখেন তাঁদের দেখায় অসম্পূর্ণতা থেকে যেতেই পারে , কিন্তু যাঁরা আত্মা দিয়ে দেখেন তাঁদের জন্য একবার দর্শনই যথেষ্ট ।

‘ মাসল্ মেমরি ‘ ব’লে একটা কথা আছে । এই কথাটা প্রথমবার শুনি প্রখ্যাত তবলিয়া পণ্ডিত শংকর ঘোষের ক্লাসে । বেশ নতুন রকমের কথা । ভরা ক্লাসে উনি ওনার একজন সেরা ছাত্রকে নির্দেশ দেন বিগত সপ্তাহে শেখানো একটি বোল তেটে-কতা-গদি-ঘেনা-র চলন ও লয় বাজিয়ে দেখাতে । ছাত্রটি বাকি সবকিছু ঠিকঠাক করলেও বিগত ক্লাসে বাজানো নির্দিষ্ট লয়টি কিছুতেই বাজাতে পারছিলো না । তার মনে পড়ছিলো না সেই নির্দিষ্ট লয়টি । তখন গুরু শংকর ঘোষ ছাত্রটিকে বলেন নানা ধরনের লয়ে বোলটি বাজাতে । এবং এও বলেন যে নিবিষ্ট মনে সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে বাজাতে পারলে ‘ মাসল্ মেমরি ‘ তাকে অবশ্যই ফিরিয়ে দেবে বিগত দিনের লয়টি । শুধুমাত্র হাতের আঙুল দিয়ে বাজালে মাসল্ মেমরি ধরা দেবে না কিছুতেই । বাজাতে হবে সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে । আর , কী আশ্চর্য , চোখ বুজে কিছুক্ষন বাজাতেই ছাত্রটি আগের দিনের লয়টি খুঁজে পেলো । তখন তার মুখে যেন ‘ ইউরেকা ইউরেকা ‘ মাখানো ‘ সব পেয়েছি ‘-র উদ্ভাসিত আলো । আর , সিদ্ধিপ্রাপ্ত গুরুর মুখে অনাবিল প্রত্যয়ের মৃদু হাসি ।

মাসল্ মেমরির প্রয়োগ সাধারণ মানুষও করতে পারেন এবং অবশ্যই ফল পাবেন , তবে দারুণ একাগ্র ও নিমগ্ন অনুশীলন চাই এই ফল পেতে চাইলে । সাধারণ তান আর কূটতানের তফাৎ যেমন বুঝতে হয় , ঠিক তেমনি চায়ের কাপের সঙ্গে ঠোঁটের হাজার যোজন দূরত্বটাও বুঝতেই হয় ।

ধরা যাক , কাউকে মনে রাখতে হবে ৯৩৭২৫৮৪৫ সংখ্যাটি । তিনি যদি বাতাসে , অর্থাৎ শূন্যে আঙুল বুলিয়ে বাংলা কিংবা যে কোনো ভাষায় উক্ত সংখ্যাটি বারবার লেখেন তাহলে কয়েকদিন পরে সংখ্যাটি তিনি ভুলে গেলেও তাঁর সেই শূন্যে আঙুল বুলিয়ে বারবার সংখ্যাটি লেখার অনুশীলন তাঁকে ভুলে যাওয়া সংখ্যাটি মনে পড়িয়ে দেবে । এটাই মাসল্ মেমরি । পেশী স্মৃতি ।

কোনো একটি নির্দিষ্ট কাজ বারবার করার ফলে সেই কাজে ব্যবহৃত পেশী সেই নির্দিষ্ট কাজ সংক্রান্ত একটি স্মৃতি ধরে রাখতে পারে । যার ফলে সেই কাজটি পরবর্তীকালে করার সময় অবচেতনভাবে ও অনায়াসে করে ফেলা যায় । ক্রমাগত চর্চা তথা অনুশীলনের মাধ্যমে পেশীর সাহায্যে যেসব কাজ অনায়াসে বা প্রায় বিনা চেষ্টায় করে ফেলা যায় সেই ব্যাপারটিকে বলা হয় পেশী স্মৃতি । চর্চা , অনুশীলন অথবা সাধনা যা-ই বলা হোক না কেন , এই পেশী স্মৃতি কিন্তু বহু পরিশ্রমে অর্জন করতে হয় । কোনো একটি নির্দিষ্ট কাজ বারবার করার ফলে সংশ্লিষ্ট পেশীটি আন্দোলিত করার চিন্তাভাবনা না করেও শুধুমাত্র পেশীর সাহায্যে সেই কাজটি করার ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায় । পেশীর এই নির্দিষ্ট কাজ সংশ্লিষ্ট আচরণজনিত স্মৃতি সংরক্ষণ করে এবং প্রয়োজনের সময় সেই একই আচরণের পুনরাবৃত্তি করতে পারাকেই মাসল্ মেমরি বলা হয় । ক্রমাগত অনুশীলনের মাধ্যমে হাতের ও পায়ের পেশীস্মৃতির উন্নতি ঘটানো যায় ।

মনে করা যাক ব্রাজিলের খ্যাতকীর্তি ফুটবলার রবের্তো কার্লোসের সেই অবিস্মরণীয় ফ্রি-কিক , যা সর্বকালের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফ্রি-কিক হিসেবে অমরত্ব লাভ করেছে ।

গোলবক্সের অনেকটা বাইরে থেকে সাত-আটজন ডিফেন্ডারের মানবপ্রাচীর ভেদ করা সেই আশ্চর্য গোলটি চেষ্টা করেও ভোলা যায় না । ঠিক কী ঘটেছিল সেই বিরল কয়েকটি মুহূর্তে ?

বহুদূর থেকে ছুটে এসে বাঁ পায়ে আউটসুইং রেখে প্রচণ্ড জোরে শট নিলেন কার্লোস । বলটা প্রচণ্ড গতিতে বাঁক খেয়ে মানবপ্রাচীরের বাঁদিক ঘেঁসে দ্বিতীয় পোস্ট কভার করে দাঁড়ানো গোলকিপারকে হতবাক করে প্রথম পোস্টে হালকা চুমু খেয়ে জালে জড়িয়ে গেলো । সারা স্টেডিয়াম কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধবাক । যেন মন্ত্রমুগ্ধ । তারপর গোটা গ্যালারি উঠে দাঁড়ালো । কয়েক মিনিট ধরে বয়ে চললো হাততালির তুমুল ঝড় । পেশীস্মৃতির সার্থক উদাহরণ এই গোলটি । বোঝা যায় হাজার বার এই ফ্রিকিকটি মারার অনুশীলন করেছেন ফুটবলসাধক মহামান্য কার্লোস ।

এবার আসা যাক ক্রিকেট সাধক কপিলদেব নিখাঞ্জের কথায় । কথিত আছে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অনুশীলনে কোনো এক সিনিয়র ক্রিকেটার কপিলের কাছে জানতে চান ওভারের ছ’টি বলে ছ’বারই মিডল স্টাম্প ছিটকে দেওয়া কি সম্ভব ? এই প্রশ্নের জবাবে বল হাতে নিয়ে কপিল বলেন , ‘ মিডল স্টাম্পটি রেখে বাকি দুটি উইকেট সরিয়ে নাও ‘ । এরপর সবাই দেখতে থাকে কপিলের চমৎকার । কপিল বল করতে শুরু করেন এবং সবিস্ময়ে সকলে দেখতে থাকেন পরপর ছ’টি বলে ছ’বারই মিডল স্টাম্প ছিটকে দিচ্ছেন কপিলদেব । হতবাক সকলেই এর রহস্য জানতে চাইলে কপিল বলেন যে মাত্র ছয় কেন , এমনকি ছ’শো বার বল ক’রে ছ’শো বারই মিডল স্টাম্প ছিটকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন তিনি । এর পিছনেও সেই পেশী স্মৃতির করিশ্মা । নিরন্তর অনুশীলন , চূড়ান্ত অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রম ছাড়া পেশী স্মৃতি আয়ত্বে আসে না। এটা আয়ত্ব করতে হলে সাধক হতেই হয় ।

এই পেশী স্মৃতি প্রয়োজনে এমনই এক চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে যা মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকেও রক্ষা করতে পারে । ভোলা যায় না সার্কাসে ট্রাপিজের খেলা দেখানো সেই দরিদ্র মেয়েটির গল্প । দুঃস্থ পরিবারের ভরনপোষণের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন দর্শকদের খেলা দেখাতে দেখাতে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত যে মেয়েটি একদিন আত্মহননের পরিকল্পনা করেছিল । কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও সে আত্মহত্যায় বিফল হয়েছিল । পেশী স্মৃতি বারবার তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল । মেয়েটির মনের গোপন বাসনাকে পরাজিত করে এখানে মেয়েটির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিল পেশী স্মৃতি । সেই মুহূর্তে মেয়েটির জীবনরথের সারথী হয়ে উঠেছিল দীর্ঘ অনুশীলনসঞ্জাত অমিতবৈভব পেশী স্মৃতি ।

আরও পড়ুন- জামিন পেলেন তুনিশা হ*ত্যাকাণ্ডের মূল অভি*যুক্ত শীজান খান