Sunday, August 24, 2025

‘জেনেশুনে বিষপানে প্রজাপতি’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

কত অল্প আয়ু নিয়ে আসে , কিন্তু কী খেলাটাই না ওইটুকু সময়ে দেখিয়ে যায় প্রজাপতি ! অথচ অপূর্ব হয়ে ওঠার আগে যে তিনটি পর্ব অতিক্রম করতে হয় প্রজাপতিকে , তা ভাবলে বেশ অবাক হতে হয় । তাক লাগানো সৌন্দর্য সৃষ্টির আগে প্রকৃতি ঘুণাক্ষরেও কাউকে টের পেতে দেন না যে , কী আশ্চর্য কাণ্ড ঘটতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে । রূপহীন ডিম , তারপর কদর্য শুঁয়োপোকা বা লার্ভা , পরবর্তীতে রীতিমতো অসুন্দর পিউপা অবস্থা এবং ঠিক তার পরেই নয়নাভিরাম সুন্দরতম প্রজাপতি ! যা দেখলে সহজে আর চোখ ফেরানো যায় না । তবে এও সত্য যে , অসুন্দর , রূপহীন , কুৎসিত অথবা অপরূপ , সবই তো মানুষের দৃষ্টিতে , যেখানে প্রতিনিয়ত ভালোমন্দের চুলচেরা বিশ্লেষণ বর্তমান । মানুষ ছাড়া তথাকথিত বোধ ও চেতনাহীন অবশিষ্ট প্রাণীজগতে খাদ্য ও খাদকের অপার সাম্য বিরাজ করছে ।

‘ যে জীবন ফড়িঙের , দোয়েলের , মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা … ‘ , লিখে গেছেন কবি জীবনানন্দ । প্রজাপতি নিয়ে কত কবিতা , কত গান , কত না আদিখ্যেতা মানুষের । রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ,
‘ তাই ফুল একদিন মেলি দিল ডানা , প্রজাপতি হ’ল , তারে কে করিবে মানা ? ‘
নজরুল লিখলেন ,

‘ প্রজাপতি , প্রজাপতি , কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা ? ‘
সলিল চৌধুরী তৈরি করলেন অসামান্য গান ,
‘ ও প্রজাপতি প্রজাপতি পাখনা মেলো , আমার এই মনের আঁধার কোনে কোনে
রঙে রঙে রংমশাল জ্বালো ‘ ।

প্রজাপতি ফুলে ফুলে মধু পান করে একথা সত্যি । তবে , এমন প্রজাপতিও রয়েছে যারা মধু নয় , বিষ পান করে । তাও আবার জেনেবুঝে ! প্রাণের আশা ছেড়ে প্রাণ সঁপে দিতে এদের জুড়ি নেই । মোনার্ক বাটারফ্লাই বা মিল্কউইড নামে এরা পরিচিত। বিজ্ঞানীরা মোনার্ক প্রজাপতির সেই জিন সিকোয়েন্স বের করেছেন , যার জন্য এরা বিষপানে সক্ষম । এই প্রজাতির প্রজাপতি শুধু মিল্কউইডের রস পান করে । যে সব গুল্ম দুধের মতো রস নিঃসরণ করে তাদের মিল্কউইড বলে । এই রস বেশ বিষাক্ত , এতে প্রজাপতির মৃত্যু হওয়ার কথা । কিন্তু তা হয় না । বরং মোনার্ক প্রজাপতি নির্লিপ্তভাবে এই বিষ পান করে । মিল্কউইডের বিষাক্ত রস তার প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে । বিশেষত পাখির আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে এটি এই গুল্মের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা । শুধুমাত্র মোনার্ক প্রজাপতিকে এই গুল্ম নিরস্ত করতে পারে না । সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জেনেছেন যে , বিবর্তনের পথে তিনটি বিশেষ জেনেটিক রূপান্তরের কল্যাণে এই প্রজাতির প্রজাপতিরা নিজেদের মধ্যে এই সক্ষমতা তৈরি করতে পেরেছে । মাত্র তিনটি জেনেটিক রূপান্তরের মাধ্যমে মোনার্ক প্রজাপতি বিষাক্ত রস প্রতিরোধী হ’য়ে উঠেছে ।

আজ থেকে ৪০ কোটি বছর আগে থেকেই পতঙ্গের খাদ্যের উৎস হয়ে আছে উদ্ভিদ । আর এটিই উদ্ভিদের মধ্যে অনেক ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিবর্তন ঘটিয়েছে । এরমধ্যে অনেক ধরনের প্রাণঘাতী রাসায়নিকও রয়েছে । এমনই একটি উদ্ভিদ মিল্কউইড , যা এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে বিষাক্ত রাসায়নিক কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড ব্যবহার করে । এই বিষের মাত্র একটি ডোজ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে দিতে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে অবশ করে দিতে পারে । আফ্রিকার শিকারীরা হাজার বছর ধরে তাদের তিরের ডগায় ব্যবহার করে আসছে এই বিষ ।‌ এমনকি অগাথা ক্রিস্টির রহস্য উপন্যাসেও এই বিষের উল্লেখ আছে । কিন্তু এই সবকিছুকে তুচ্ছ ক’রে মোনার্ক প্রজাপতি এই বিষ গ্রহণ করে চলেছে নিয়মিত । শুধু তাই নয় , নারী প্রজাপতি এসব বিষাক্ত উদ্ভিদের শরীরেই ডিম পাড়ে ।‌ আর প্রজাপতির ডানা মেলার আগে পর্যন্ত শুঁয়োপোকাটি যতটা সম্ভব পান করে এই বিষ , যা সঞ্চিত হয় এর বর্ণিল ডানায় ।

প্রজাপতি লেপিডোপ্টেরা বর্গের অন্তর্গত এক ধরনের কীট ।‌ এদের শরীর উজ্জ্বল রঙের এবং দেখতে আকর্ষণীয় । প্রজাপতির বেশিরভাগ প্রজাতিই দিবাচর । এদের মাথায় রয়েছে গোলাকার পুঞ্জাক্ষী । এদের দেহ দশ খণ্ডে গঠিত । শেষের দু’তিনটি খণ্ড প্রজনন কেন্দ্র । কয়েক হাজার প্রজাতির প্রজাপতি আছে পৃথিবীতে । এদের ডানায় এত যে রঙের বাহার , এত যে জটিল আঁকিবুকি এদের শরীরে , তারও কিছু কারণ রয়েছে । এগুলোর মাধ্যমে প্রজাপতি আত্মরক্ষা করে , অন্য প্রজাপতিদের সাহায্য করে , সেইসঙ্গে বিপরীত লিঙ্গের প্রজাপতিদের আকর্ষণ করে ।

প্রজাপতি মূলত উদ্ভিদের রস , প্রাণীর মলমূত্র ইত্যাদি খাবার হিসেবে গ্রহণ করে । কোনো কোনো প্রজাতির প্রজাপতি আবার প্রাণীদের মৃতদেহ খুঁটে খায় । পচা চিংড়ি ও কাঁকড়াও এদের খাদ্য । প্রজাপতির প্রধান কাজ উদ্ভিদের পরাগায়ণে সাহায্য করা । প্রজাপতির পাখায় সৌর উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে । মানুষের অশান্ত ও অস্থির মনের অন্যতম শুশ্রূষা হলো প্রজাপতি দর্শন । দেখামাত্র মনে আনন্দের সঞ্চার হয় । হৃদয় পুলকিত হয় । এই কীট পরিবেশ বান্ধব। পরিবেশের ক্ষতিকারক জীবাণু নাশ করে এরা ।‌ বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে প্রজাপতির আগমনকে শুভ ব’লে ধরা হয়। অপূর্ব সুন্দর এই নিষ্পাপ পতঙ্গটি মানুষকে ভালোবাসতে শেখায় । প্রাত্যহিক অসুবিধাগুলিকে জয় করতে শেখায় ।

প্রজাপতি একাধারে দৃষ্টিনন্দন ও গবেষণার বিষয় । এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও কম নয় । প্রজাপতি আমদানি ও রপ্তানি করে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার ব্যবসা চলে সারা বিশ্বে । প্রজাপতি পরিবেশ বিপর্যয়ের আগাম সঙ্কেত দিতে পারে । প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রেও এদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ । সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রজাপতি সংরক্ষণের গুরুত্বও ক্রমেই বেড়ে চলেছে । আধুনিক নগরোন্নয়ন , অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার ও নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংসের কারণে প্রজাপতির জীবনচক্র আজ বিপন্ন । মানব সম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রজাপতিদের বাঁচিয়ে রাখার কথাও ভুলে গেলে চলবে না ।
আহা প্রজাপতি , থাকো যদি আরো দুদণ্ড তাতে কার ক্ষতি !

আরও পড়ুন- রাজ্যে হজযাত্রা শুরু ২১ মে, যাত্রীদের জন্য একাধিক পদক্ষেপ নিচ্ছে নবান্ন

spot_img

Related articles

পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্পে নাম নথিভুক্তি শুরু

পরিযায়ী শ্রমিকদের সুবিধার্থে এবার আরও এক পদক্ষেপ রাজ্য সরকারের। ‘আমাদের পাড়া আমাদের সমাধান’ কর্মসূচির আওতায় দুয়ারে সরকার শিবিরেও...

‘নিখুঁত ভুলগুলি’, উৎপল সিনহার কলম

একটা দুঃখের কথা পথে ও বিপথে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে গান হয়ে ওঠে ...একটি দুঃখের কথা পথে ও বিপথে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে গান...

ষোলতেই ১৩০ কেজি! ছেলের খাবার জোগাতেই নাজেহাল বাবা-মা

মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি থানার কাবিলপুর পঞ্চায়েতের মথুরাপুর গ্রাম। এখানেই থাকেন দিনমজুর মুনশাদ আলি। তাঁর ছোট ছেলে জিশান আলি...

কবে থেকে শুরু জয়েন্টের কাউন্সেলিং? দিনক্ষণ জানিয়ে দিল বোর্ড

ফলপ্রকাশের পর এবার ১৫ দিনের মধ্যেই কাউন্সেলিং প্রক্রিয়া তথা ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করবে জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড। এবার কাউন্সেলিং...