‘কে তুমি মোনালিসা’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

” মোনালিসা ইউরোপের প্রথম রমণী — পুরুষের কাণ্ড দেখে হাসে । ”

মোনালিসার মুখে মৃদু মধুর হাসি ?
না না , ওটা তো মুচকি হাসি বিদ্রুপের । সত্যিই কি হাসছে সে ? ছবির কারসাজি নয় তো , ওই যাকে বলে অপটিক্যাল ইলিউশন ! ভ্রু-পল্লবে ডাক দিলে কীভাবে দেখা হবে চন্দনের বনে ? মোনালিসা তো ভ্রু-পল্লবহীন ! সে কি গর্ভবতী ? তার হাসিতে কি কোনো বিষাদ লুকোনো ? ওকে দেখলে তুমুল আনন্দেও একবুক বিপন্নতা জাগে কেন ? মোনালিসার ছবি সম্পূর্ণ করতে গিয়ে সত্যিই কি একবার মূর্ছা গিয়েছিলেন লিওনার্দো ? মোনালিসায় মত্ত হয়ে কেন আত্মহত্যা করেন এক শিল্পী ?
উত্তর ঘুমিয়ে পড়ে । কিন্তু প্রশ্ন জেগে থাকে , জাগায় , জাগিয়ে রাখে ।

” মোনালিসা , যদি ফিরিয়ে দাও , ব্যর্থ হয়ে যাবে জীবন , তবুও তোমায় নিয়ে কবিতা লেখে বুড়ো নির্মলেন্দু গুণ । ”

লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা পোর্ট্রেট ‘ মোনালিসা ‘ সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আলোচিত চিত্রকর্ম । সবচেয়ে দামি । রহস্যে ভরা ছবি । মোনালিসার ঠোঁট আঁকতেই ১২ বছর সময় নিয়েছিলেন ভিঞ্চি । ছবি সম্পূর্ণ করতে সময় লাগে ১৪ বছরের বেশি । এই ছবির সামনে দাঁড়ালে আজও ঘোর লাগে শিল্পমগ্ন দর্শকদের । পাঁচশো বছর বয়সী মোনালিসার প্রেমে পড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম । ছবির ওপর হামলা হয় অনেকবার । ছবি চুরিও যায় । চোর ধরাও পড়ে । ছবি আবার যথাস্থানে আসে । অদ্ভুত জাদু এই ছবিটি ঘিরে । দূর থেকে দেখলে মনে হয় মোনালিসা হাসছে । কাছে যেতেই নাকি হাসি মিলিয়ে যায় । আরোও কত রহস্য । পাঁচশো বছর আগে তৈরি এই পোর্ট্রেট দেখতে আজও হাজার হাজার মানুষ আসেন ফ্রান্সের ল্যুভ মিউজিয়ামে ।

” তোমার নাম লেখা কবিতার খাতা থেকে বাজারের ফর্দ ,
তবুও তোমাকে আঁকে বজ্জাত
দ্য ভিঞ্চি লিওনার্দো । ”

অনেকেই বলেন লিওনার্দোর মোনালিসা আসলে ফ্লোরেন্সের একজন সিল্ক ব্যবসায়ীর স্ত্রী লিসা গেরারদিনির প্রোট্রেট । আবার অনেকেই আছেন যাঁরা বিশ্বাস করেন এই নারী অন্য কেউ । বেশিরভাগ গবেষক বিশ্বাস করেন ১৫০৩ থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত মোনালিসা নিয়ে কাজ করেন ভিঞ্চি । ছবিটি আঁকতে শুরু করেন ইতালির ফ্লোরেন্সে । এরপর ফ্রান্সের রাজার আমন্ত্রণে ছবিটি নিয়ে লিও হাজির হন ফ্রান্সে ।

‘ লিওনার্দো দি সের পিয়েরো দ্য ভিঞ্চি ‘ লিওনার্দোর পুরো নাম । জন্ম ইতালিতে ১৫ এপ্রিল ১৪৫২ সালে । চিত্রশিল্প নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য প্যারিসে যান লিও । সেখানে গুরু এন্ড্রিও ডেল ভেরুচ্চির কাছে শেখেন নিখুঁত চিত্রকলার সৃজনকর্ম ও শিল্পের চূড়ান্ত উৎকর্ষতার দুরুহ বিদ্যা । মনে করা হয় মোনালিসা ছবিটি আঁকা হয় মোনালিসার দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের সময় ।

কে মোনালিসা ? লিওনার্দোর মা ? বান্ধবী ? কোনো প্রেমিকা ? পরস্ত্রী ? কেউ কেউ বলেন মোনালিসা লিওনার্দোর নিজেরই নারী অবয়ব অথবা কল্পনার নারী । পাঁচশো বছর ধরে জেগে আছে এইসব প্রশ্নমালা । উত্তরহীন । সমাধানহীন । আছে একরাশ বিতর্ক ও অসংখ্য ভিন্নমত ।

পাইন কাঠের টুকরোর ওপর অঙ্কিত মোনালিসা ছবিটির মূল্য ৮৩০,০০০,০০০ মিলিয়ন ডলার ! রহস্যে মোড়া এই ছবিটি এক এক দিক থেকে দেখতে এক এক রকম লাগে । অপরূপ স্নিগ্ধ সৌন্দর্য । চাপা হাসি । তির্যক চাহনি । মোনালিসা যেন এক আশ্চর্য ধাঁধার গোপন চাবিকাঠি ।‌ঠিকঠাক রহস্যভেদ হলেই হয়তো খুলে যাবে অজানা এক জগতের দরজা । যেন ছবি আঁকার ছলে পৃথিবীর দিকে একের পর এক সঙ্কেতের কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন লিওনার্দো । সে এমনই চ্যালেঞ্জ , যার গোলকধাঁধায় আজও হাবুডুবু খাচ্ছেন বিশ্বের তাবৎ শিল্পরসিক ।

” ফিরে এসো অনুরাধা ,
ভেঙে দিয়ে সব বাধা ,
প্রিয়তমা মোনালিসা ,
তুমি আমার ভালোবাসা । ”

ইতালিয় ভাষায় ‘ মোনা লিসা ‘ কথাটির অর্থ ‘ মাই লেডি ‘ । ১৮৫২ সালের ২৩ জুন লুইমাসফেরো নামে এক ফরাসি তরুণ শিল্পী প্যারিসে এক বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন । তাঁর সুইসাইড নোটে তিনি লিখে রেখে যান , ” আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী মোনালিসার হাসি । ”

মোনালিসাকে গড়ে তোলার বছরগুলোতে লিওনার্দো রাত কাটাতেন তাঁর স্টুডিওর কাছে এক হাসপাতালে ।‌ সেখানে তিনি মানুষের ত্বক , পেশী ও স্নায়ু নিয়ে গবেষণা করতেন । এরই প্রভাব সম্ভবত পড়েছে মোনালিসার হাসির ওপর । হাসির সময় পেশীর নিয়ন্ত্রণ , নড়াচড়ার সুক্ষ্ম রসায়ন এই ছবির অবয়বে ফুটে উঠেছে বলে মনে করা হয় । দেশকাল সময়ের সীমা অতিক্রম করে আজও ভীষণভাবে জীবন্ত লিওনার্দোর অনবদ্য সৃষ্টি মোনালিসা । অবিস্মরণীয় । অমর শিল্পকলা ।‌

মহাজগতের কোনো অজানা রহস্যের সন্ধান কি পেয়েছিলেন লিওনার্দো ? তাঁর এই সৃষ্টি যেন অপার্থিব ।
দীর্ঘজীবী হোক মোনালিসার অপার রহস্যময় আবেদন । আত্মতৃপ্তি ও আত্মহননের মাঝে আবহমান মোনালিসায় আবিষ্ট থাকুন পৃথিবীর সর্বকালের সমস্ত শিল্পরসিক ।
সকলের চোখে থাকুক মুগ্ধ বিস্ময়ের মায়াকাজল , আর বুকে থাকুক অন্তহীন প্রেম ।

আরও পড়ুন- রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহাকে ফের তলব রাজ্যপালের

Previous articleরাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহাকে ফের তলব রাজ্যপালের
Next articleইন্দুমতির সভাগৃহে ‘প্রণাম’-এর রবীন্দ্র সন্ধ্যা