Saturday, August 23, 2025
উৎপল সিনহা

দুপুর থেকে সন্ধ্যা রূপকথার গল্প । রাতে রূপান্তরের গান । আরব সাগরের তীরে মায়াবী আলোয় লেখা হলো ক্রিকেটের নয়া ইতিহাস । মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ৭ নভেম্বরের এই ম্যাচ যাঁরা স্বচক্ষে দেখলেন তাঁরা সকলেই ভাগ্যবান ।

গল্পটা সাধারণ কিন্তু অসামান্য । টসে জিতে ব্যাটিং করল আফগানিস্তান । তুললো ৫ উইকেটে ২৯১ রান । ২০২৩ বিশ্বকাপের ৩৯-তম ম্যাচ । সেমিফাইনালে ওঠার লড়াই । জবাবে ৭ উইকেটে ২৯৩ তুলে ম্যাচটা ৩ উইকেটে জিতলো অস্ট্রেলিয়া । এ পর্যন্ত গল্পটা বেশ চেনা চেনা । এমন তো কতই হয় । কেউ জেতে কেউ হারে । কিন্তু এই ম্যাচের মূল কাহিনীর বুকে রয়ে গেলো এমন কিছু চমকপ্রদ ঘটনা , যা সচরাচর ঘটে না ।

ক্রিকেটে উদীয়মান শক্তি আফগানিস্তান । নানা সমস্যায় জর্জরিত তথা দুর্বল ক্রিকেট পরিকাঠামো সত্ত্বেও তাদের এই উত্থান সত্যিই বিস্ময়কর । এই মুহূর্তে ক্রিকেট বিশ্বের যে কোনো শক্তিকে পরাজিত করার ক্ষমতা অর্জন করেছে তারা । চলতি বিশ্বকাপেই একাধিকবার দৈত্য সংহার করে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে আফগানিস্তান ।

বিপক্ষে ছিল পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া । এ ম্যাচে স্পিনার অলরাউন্ডার রশিদ খানের ১৮ বলে ৩৫ রান ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো দু’অঙ্কের রান আফগানদের স্কোরবোর্ডে না থাকলেও একটা তিন অঙ্কের রান আফগান ক্রিকেটের ধ্রুবতারা হয়ে জেগে রইলো । একসময় আফগানরা আড়াইশো ছুঁতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল । সেই অবস্থা থেকে দলকে ২৯১ রানের লড়াকু স্কোরে পৌঁছে দিলেন ইব্রাহিম জাদরান । বয়স মাত্র ২১ । মাত্র ১৪৩ বলে ১২৯ রানের অনবদ্য ইনিংস খেললেন তিনি । ৮ টি চার ও ৩ টি ছক্কায় মাতালেন মাঠ । মনে পড়ালেন তোরাবোরা পাহাড় । শের আফগান । বীর আফগান । ইতিহাস রচনা করলেন জাদরান । বিশ্বকাপের ইতিহাসে তিনিই হলেন প্রথম শতরানকারী আফগান ক্রিকেটার । যদিও এই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া এখনও পর্যন্ত তাদের চিরাচরিত আগ্রাসী মেজাজে নেই । হেরেওছে বেশ কয়েকটি ম্যাচ । তবু হারার আগে কিছুতেই হার না মানা লড়াই ক্যাঙারুদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে । সেই অদম্য দলকে প্রায় একাই খাদের কিনারায় ঠেলে দিলেন মাত্র ২১ বছর বয়সী এক আফগান যুবা । আর ইতিহাসের বরণমালা গলায় ঝুলিয়ে মাথা নিচু করে সুপরামর্শ পাওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন একজনের প্রতি । কে তিনি ? সচিন তেন্ডুলকর । ইতিহাস স্যালুট জানালো ইতিহাসকে । তারপর ?

বিরতির সময় প্রায় সকলের মুখেই শোনা গেল অস্ট্রেলিয়ার আর একটা পরাজয় শুধু সময়ের অপেক্ষা । কিন্তু ক্রিকেট দেবতা বুঝি আড়ালে হাসছিলেন তখন । তিনি কখন কার প্রতি প্রসন্ন হবেন তা শুধু তিনিই জানেন ।

অনিশ্চয়তায় মোড়া ক্রিকেট পণ্ডিতদের বারবার বোকা বানানোর জন্য বিশেষ প্রসিদ্ধ । এখানেও কি তেমন কিছু হবে ? ব্যাট করতে নেমে একের পর এক উইকেট পড়তে লাগলো ক্যাঙারুদের । বিখ্যাত ব্যাটাররা প্রায় সবাই প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন । মাত্র ৪৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে তখন তারা থরহরিকম্প । মাঠে নামলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল । যাঁর ডাকনাম ম্যাক্সি । তখন কে-ই বা জানতো এই ম্যাক্সিই আজ হয়ে উঠবেন ম্যাক্সিমাম !

আমরা দেখলাম ম্যাক্সির শান্ত দুটি চোখে স্বপ্নের দূরবীন । মাথা লেটুস পাতার মতো ঠাণ্ডা । আর বুকের ভেতরটা নিশ্চয় অস্ট্রেলীয় অস্মিতায় আগুনময় । মুখে স্মিত হাসি । আচরণে বরাবর নম্র । তিনি ক্রিজে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো কয়েকটি উইকেট পড়লো । ১৮.৩ ওভারে আউট হলেন মিচেল স্টার্ক । অজিরা তখন ৭ উইকেটে মাত্র ৯১ । নামলেন প্যাট কামিন্স । গোটা ক্রিকেটবিশ্ব ধরে নিয়েছে অজিদের হার অবধারিত । কিন্তু ম্যাক্সির আচরণে অটল প্রত্যয় । যদিও তাঁর শরীরে ক্লান্তি যথেষ্ট । মনে রাখতে হবে ব্যাট করতে আসার আগে প্রায় চার ঘণ্টা টানা ফিল্ডিং করেছেন ম্যাক্সি এবং ১০ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৫৫ রানের বিনিময়ে ১ টি উইকেটও পেয়েছেন । ৯১ রানে ৭ উইকেট হারানোর পর মনকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রাখা ভীষণ শক্ত । দীর্ঘদূর যাত্রাপথে মাত্র কয়েকজন বোলার সঙ্গী । তাই নিয়েই শুরু করলেন অসম এক লড়াই । প্রায় একক লড়াই ।

এমন দুঃসময়ে আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো উপস্থিত হলো আরেক বিপদ । একপায়ে টান ধরলো ম্যাক্সির । পেশীর টান , মাসল ক্র্যাম্প । খোঁড়া পা নিয়েই খেলতে লাগলেন । এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে তালগাছের মতো আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছেটা কিছুতেই মরতে দিলেন না ।

দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত ওয়াংখেড়ে ভেসেছিল ‘ জাদরানি ‘ ঝোড়ো হাওয়ায় । রাতে তছনছ হয়ে গেলো ‘ ম্যাক্সি ‘ ঝড়ের তাণ্ডবে । অসহ্য যন্ত্রণা চেপে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাত্র ১২৮ বলে ২০১ রানের মহাকাব্য রচনা করে দেশকে ৩ উইকেটে জিতিয়ে বীরদর্পে মাঠ ছাড়লেন ম্যাক্সি । রেখে গেলেন সোনায় মোড়া ২১ টি চার ও ১০ টি ছয় । জিতলো ক্রিকেট । অস্তরাগে রচিত রূপকথা কয়েক মুহূর্তের জন্য ম্রিয়মান হলো রাতের মায়াবী অরূপগাথার ইন্দ্রজালে । মূলতান যেন কিছুটা বিপন্ন বোধ করলো ইমনের অপরূপ মূর্ছনায় । আর এই মায়ার খেলায় মুগ্ধ বিস্ময়ে আট ঘণ্টা মজে রইলো ক্রিকেট দুনিয়া ।

ক্রিকেট তো মাত্র এক বলের খেলা । কিন্তু ক্রিকেট কি একজনের খেলা ? আমরা তো অস্ট্রেলিয়ার ৯১ রানে ৭ উইকেট পড়ার পর থেকে মাঠে এক ও একমাত্র ম্যাক্সি ছাড়া আর কাউকেই প্রায় দেখতে পাচ্ছিলাম না । যেদিকে তাকাই শুধু ম্যাক্সি আর ম্যাক্সি । আহা , দু’চোখ ভরে দেখলাম ‘ ম্যাক্সওয়েল শো ‘ ! ভুলবো না ।

খেলায় হারজিত থাকবেই । আফগানিস্তান পরাজিত । অস্ট্রেলিয়া জয়ী । কিন্তু ক্রিকেটপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায় চিরদিনের জন্য রয়ে যাবে দুই অনন্য ক্রিকেটযোদ্ধার যৌথ বীরগাথা , যার স্রষ্টা যথাক্রমে ইব্রাহিম জাদরান এবং গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ।

আরও পড়ুন- ১৩০ কিমি বেগে ছুটছে পুরুষোত্তম এক্সপ্রেস, আচমকা ঝা.কুনি! তারপর…

 

Related articles

পূর্ব ভারতের ইতিহাসে প্রথম! হাড়ের ব্যাঙ্ক চালু হচ্ছে SSKM হাসপাতালে

আরও এক ধাপ এগোল বাংলা। পূর্ব ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম। চালু হচ্ছে হাড়ের ব্যাঙ্ক। এসএসকেএমের অ্যানেক্স শম্ভুনাথ পণ্ডিত...

জুতোর কারখানায় আগুন, আতঙ্ক আনন্দপুরের গুলশন কলোনিতে

আনন্দপুরের গুলশন কলোনিতে একটি কারখানায় আগুন (factory fire) লাগার ঘটনায় চাঞ্চল্য শনিবার সকালে। ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় প্রথমেই আগুন...

অমানবিক! যোগীর রাজ্যে মৃত নবজাতককে ব্যাগে ভরে বিচারের চেয়ে জেলাশাসকের কাছে বাবা

চূড়ান্ত অমানবিক ঘটনা যোগীরাজ্যে। টাকা অঙ্ক বাড়ানোর নিয়ে দর কষাকষিতে প্রসবে দেরির অভিযোগ। পরিণতিতে প্রাণ হারায় সদ্যোজাত। বিচার...

ঝাঁপ বন্ধ হচ্ছে ২১৫ জামাত-এ-ইসলামের স্কুলের, সিদ্ধান্ত কাশ্মীর সরকারের

সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় পর্যটকদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে আবার নিজেদের নিরাপদ আশ্রয়ে সেঁধিয়ে গিয়েছিল পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা। চোর...
Exit mobile version