ইউক্রেনের জনসংখ্যা ৪১ মিলিয়ন। খনিজ সম্পদের ভান্ডারে সমৃদ্ধ ইউক্রেন। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতার পর রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চললেও ২০১৪ সালে তাতে বড় ধরনের ফাটল তৈরি হয়, যার ছিদ্র পথ দিয়ে প্রবেশ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। এই সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সামরিক সম্পর্কে সব জায়গায় প্রাধান্য পেতে থাকে পশ্চিমারা। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অতিমাত্রায় দহরম-মহরমে প্রমাদ গুনছিল রাশিয়া।

গম উৎপাদনে শুধু শ্রেষ্ঠত্বই নয়, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যে ভাসছে ইউক্রেন।রাশিয়ার এশিয়া অংশ বাদে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাসের মজুত রয়েছে দেশটিতে। ইউরোপে সবচেয়ে বেশি নরওয়েতে ১ দশমিক ৫৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাসের মজুত রয়েছে। এরপরই ১ দশমিক ০৯ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাসের মজুত আছে ইউক্রেনে। রাশিয়ার সঙ্গে মিলে ইউরোপের ৫০ শতাংশ গ্যাসের চাহিদা মেটায় কিয়েভ।
নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইন দিয়ে রফতানি হয় এই গ্যাস। ইউক্রেনের ওপর দিয়েই ইউরোপে গ্যাস রফতানি করে রাশিয়া। নর্ড স্ট্রিম-২ নামে আরেকটি পাইপলাইন নির্মাণ করেছে মস্কো। তবে, এটি চালুর আগেই ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে জার্মানি। এছাড়া সাড়ে ১৩ কোটি টন তেল ও ৩৭০ কোটি টন শেল তেলের মজুত রয়েছে ইউক্রেনে।

কয়লার মজুতে বিশ্বে সপ্তম ও ইউরোপে দ্বিতীয় ইউক্রেন, যার পরিমাণ প্রায় ১১৫ বিলিয়ন টন। এই কয়লার ৯২ শতাংশের অবস্থান দোনবাসে, যার দুটি অংশ লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক। ইউক্রেনে হামলার আগে অঞ্চল দুটিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় রাশিয়া। বিপুল এই কয়লার মজুতের ৩০ শতাংশ রান্নার কাজে ব্যবহৃত কয়লা। বছরে যার উৎপাদন ১০ কোটি টন।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামী সাড়ে পাঁচশো বছর এই মজুত দিয়ে চলতে পারবে ইউক্রেন। চিনের কলকারখানা ও ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদনে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই তালিকায় আছে রাশিয়াও। আকরিক লোহার রফতানিকারকদের তালিকায় বিশ্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছে ইউক্রেন। দেশটির রফতানি পণ্যের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আছে এই খনিজ।

গুরুত্বপূর্ণ খনিজের আরেকটি হলো লিথিয়াম, যা গাড়ির ব্যাটারির অন্যতম উপাদান। তাই বিশ্বজুড়ে অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো এই উপাদান সংগ্রহে বিশেষভাবে আগ্রহী থাকে। ইউক্রেনের কিরোভোরাদ, দোবরা ও দোনেৎস্ক অঞ্চলে রয়েছে লিথিয়ামের খনি। তবে এখনও সেখান থেকে লিথিয়াম উত্তোলন শুরু হয়নি। রাশিয়ার হামলার আগে অস্ট্রেলিয়া ও চীনের দুটি কোম্পানি কাজ পেতে দর কষাকষির মধ্যে ছিল।

ওজনে হালকা কিন্তু অত্যন্ত শক্ত ধাতু টাইটানিয়াম। মূলত উড়োজাহাজ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এটি। বিশ্বের ২০ শতাংশ টাইটানিয়ামের মজুত রয়েছে ইউক্রেনে, যার প্রধান তিন ক্রেতা চিন, রাশিয়া ও তুরস্ক। খনি থেকে তুলে ক্রেতার চাহিদামতো পণ্য তৈরির কারখানাও রয়েছে দেশটিতে।

ইউরোপের সবচেয়ে বড় আকরিক ম্যাঙ্গানিজের মজুতও রয়েছে সেখানে। বছরে সাড়ে ৭ লাখ টনের বেশি উত্তোলিত হয় এই খনিজ, যার সোয়া লাখ টন রপ্তানি হয়। মোট মজুতের ৬৬ শতাংশের অবস্থান, ভেলিকো-তোকমাপকোয়ে এলাকায়। এছাড়া স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, বিটুমিনেরও ভালো মজুত রয়েছে ইউক্রেনে। বিশেষ করে ইতালি, রাশিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ স্টিল রফতানি করে দেশটি।

যে কোনও শক্তিশালী দেশই প্রাকৃতিক সম্পদের এই প্রাচুর্য পেতে চাইবে। প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় এই সম্পদের ব্যবহার যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার মতো মনোভাব নেই পুতিনের রাশিয়ার। এছাড়া, বন্ধু রাষ্ট্র চিনের কলকারখানার জন্য কয়লা, গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির চাহিদা বাড়ছে, যার কিছুটা পূরণ হতে পারে ইউক্রেনের প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে। তাই বিগত কয়েক বছর ধরে শীতল যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে ফিরিয়ে আনছে রাশিয়া।
