Saturday, May 3, 2025

‘প্রমিথিউসের আগুন’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

‘ ওরা প্রমিথিউস , ওরা অগ্নিযুগের গান ‘ , লিখেছেন গীতিকার সাধন দাশগুপ্ত। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় ‘ আগুনের ঠিকঠাক ব্যবহার ‘ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত রয়েছে। আবার জয় গোস্বামীর কবিতায় বেণীমাধবকে ‘ আগুন জ্বলে কই ‘ প্রশ্নে বিদ্ধ করেছেন সেলাই দিদিমণি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন লেখায় আগুনের জয়গান গেয়েছেন ।

এতগুলো শতাব্দী পেরিয়ে যাবার পরেও মানবজাতি কেন আগুনের যথাযথ ব্যবহার শিখতে পারলো না , তা নিয়ে চিন্তাশীল মানুষের আক্ষেপ আজও রয়ে গেছে। এ কথা কিন্তু কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না যে আগুন হলো আধুনিক সভ্যতার প্রাণবায়ু । আগুন ছাড়া মানুষ প্রকৃতপক্ষেই অনাধুনিক , এও চরম সত্য । আগুন এক ধাক্কায় সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছে লক্ষ মাইল । আগুনের পরশমণির স্পর্শে সফল ও সার্থক হয়ে উঠেছে মানবজনম ।

গ্রীক পুরাণে আছে , দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করে মানবজাতিকে উপহার দেওয়ার জন্য কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল প্রমিথিউসকে । আগুনের চেয়ে মূল্যবান উপহার আর কি-ই বা হতে পারে ! আহা , অসামান্য আগুন । ফুলকে দিয়ে মানুষ বড়ো বেশি মিথ্যা বলায় ব’লে পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কখনোই ফুলের প্রতি কোনো মোহ ছিল না । তিনি পছন্দ করতেন আগুনের ফুলকি , যা দিয়ে কখনও মুখোশ তৈরি করা সম্ভব নয় ।

প্রমিথিউস নামের অর্থ পূর্বচিন্তা , তাই তিনি চিন্তা- ভাবনা , পরিকল্পনা , পদক্ষেপ গ্রহণ ও রূপায়ণের প্রতীক । যদিও তিনি আগুনের সাথে যুক্ত একমাত্র দেবতা ছিলেন না , তিনি প্রায়শই প্রাচীন শিল্পকর্ম ও চারুকলার সঙ্গে চিত্রিত হন। মানবজাতির সৃষ্টি এবং তাদের আগুন-আবিষ্কার ও বিকাশের প্রতীক প্রমিথিউস । গ্রীক ভাষায় ‘ মিথিউস ‘ মানে চিন্তা , তাই ‘ প্রমিথিউস ‘ মানে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের আগে তার পরিণতি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা ।

গ্রীক পুরাণে টাইটান ধ্বংস প্রবণতার দেবতা। প্রমিথিউস ছিলেন দ্বিতীয় প্রজন্মের টাইটান , গ্রীক দেবতাদের একজন , যিনি মানবজাতিকে সাহায্যের জন্য তাঁর জ্ঞাতিভাই জিউসকে প্রতারণা করেছিলেন । গ্রীক পুরাণ অনুসারে প্রমিথিউস মানবজাতির প্রতি সহানুভূতিশীল এক আগুন চোর ‘ ,যিনি মানুষকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে আগুনকে লালন-পালন ও ব্যবহার করতে হয়। ধাতুর ব্যবহার থেকে শুরু করে কাঁচা মাংস খাওয়া ছেড়ে মাংস রেঁধে খাওয়ার শিক্ষাও নাকি মানুষকে দিয়েছিলেন এই প্রমিথিউস । প্রমিথিউস এবং এপিমিথিউসকে জীবন্ত সৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীকে পূর্ণ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন জিউস । তিনি চেয়েছিলেন যে , তারা তাদের সৃষ্টিকে বুদ্ধি ও প্রতিভা দান করে নতুন বাসভূমিতে বেঁচে থাকা নিশ্চিত করবে । এপিমিথিউস গ্রহের সমস্ত প্রাণী সৃষ্টি করেছিলেন এবং উড়ে যাওয়া ও শিকার ধরার অনন্য ক্ষমতা ও প্রতিভায় তাদের উন্নিত করেছিলেন । প্রমিথিউস মানুষকে তৈরি করেন শ্রম দিয়ে । কাদামাটি ও জলের সাহায্যে ঢালাই করেন তাদের এবং তখনই মানুষকে আগুনের ব্যবহার শেখানোর ভাবনা তাঁর মাথায় আসে ।‌ তাই বিজ্ঞানের দেবতাও ভাবা হয় তাঁকে । আগুনের হাত ধরেই তো দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞান ।

প্রমিথিউস মাউন্ট অলিম্পাসের দেব-দেবীদের কাছ থেকে আগুন চুরি করায় জিউস ভীষণ বিরক্ত হন । প্রমিথিউস মৃৎশিল্প এবং ধাতব কাজের গ্রীক দেবতা হেফেস্টাসের কর্মশালায় লুকিয়ে থাকার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি উঠোনে একটি সোনার নাশপাতি ছুঁড়ে দিলেন যাতে লেখা ছিল , ‘ সকলের সবচেয়ে সুন্দরী দেবীর জন্য ‘ । এতে বিভ্রান্ত হয়ে দেবতাদের দৃষ্টি সেদিকেই ঘুরে যায় । সেই বিশৃঙ্খলার সুযোগে প্রমিথিউস হেফেস্টাসের কর্মশালার চুল্লি থেকে আগুন চুরি করেন । এই চুরির কথা জানতে পেরে জিউস সিদ্ধান্ত নেন যে , প্রমিথিউসকে চরম শাস্তি দেওয়া হবে।

এরপর প্রমিথিউসকে ককেশাস পর্বতে একটি পাথরের স্তম্ভে বেঁধে ফেলা হয় অনন্তকালের জন্যে । সেখানে প্রতিদিন একটি ঈগল এসে প্রমিথিউসের লিভারটি ( কলিজা ) ঠুকরে খেয়ে যেতো । কিন্তু প্রমিথিউসের অমরত্বের কারণে পরদিন আবার লিভারটি পুনঃস্থাপিত হতো । এইভাবে অনন্ত যন্ত্রণা ভোগ করে দিন কাটাতে হতো তাঁকে । এমনভাবে হাজার হাজার বছর শাস্তিভোগের পর একসময় প্রমিথিউস মুক্তিলাভ করেন । জ্ঞান , বুদ্ধি , বিজ্ঞান , প্রযুক্তি এবং সৃজনশীলতার প্রতীক হিসেবে পৌরাণিক প্রমিথিউস মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক সশ্রদ্ধ নাম । প্রমিথিউসের মাহাত্ম্য ও ত্যাগের উদাহরণ পাশ্চাত্য সাহিত্য , সঙ্গীত ও সংস্কৃতিতে বিরল ও বিশিষ্ট স্বাতন্ত্রে বিরাজমান । প্রখ্যাত ইংরেজ কবি শেলি প্রমিথিউসের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘ মুক্ত প্রমিথিউস ‘ নামে একটি গীতিনাট্য লেখেন । সেখানে তিনি প্রমিথিউসকে একজন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে কল্পনা করেন , যিনি শৃঙ্খল ভেঙে ‌মানুষের কাছে মুক্তির বার্তা নিয়ে আসেন। আবার মেরি শেলির উপন্যাস ‘ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’-এর সাবটাইটেল-এ পাওয়া যায়’ দ্য মডার্ন প্রমিথিউস ‘। আর বিশ্ববিশ্রুত এস্কাইলাসের প্রাচীন গ্রীক মহান ট্র্যাজেডি আধারিত সৃষ্টি ‘প্রমিথিউস বাউন্ড’।

‘সবই , যা আমি আগে জানতাম, যা হওয়া উচিত ‘ , মানবতা রক্ষা করতে হলে ‘ যা করার , তা করতে হবে , তার পরিণতি যা-ই হোক না কেন ‘ ,এই ছিল দুঃসাহসী প্রমিথিউসের স্থির প্রজ্ঞা । স্থুল অচলায়তন নৈতিকতার বেড়া ভেঙে ছলে-বলে-কৌশলে যে ভাবেই হোক মানুষকে বাঁচাতে হবে । নিতে হবে প্রাণের ঝুঁকি । উপেক্ষা করতে হবে সঙ্কটের সমস্ত কল্পনাকে । শুকনো গাঙে জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক আনতে হলে সবার আগে ত্যাগ করতে হবে প্রাণ হারানোর ভয়। ভাঙনের জয়গান না গাইতে পারলে নতুন তরঙ্গ আসবে কীভাবে ?

আরও পড়ুন- Bangladesh Election: ভোট দিলেন তারকাপ্রার্থী শাকিব আল হাসান ও অভিনেতা ফিরদৌস

 

spot_img

Related articles

প্রকাশিত হল হাই-মাদ্রাসা-আলিম- ফাজিল পরীক্ষার ফল, শুভেচ্ছা পোস্ট মুখ্যমন্ত্রীর 

মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলপ্রকাশের পরের দিন হাই-মাদ্রাসা, আলিম এবং ফাজিল পরীক্ষার ফলাফল(High Madrasah, Alim and Fazil Result) প্রকাশিত হল।...

শনির সকালেও জম্মু-কাশ্মীরের লাইন অফ কন্ট্রোলে গোলাগুলি পাক সেনার  

পহেলগাম রক্তাক্ত (Pahelgam attack) হওয়ার পর থেকে যেকোনও মুহূর্তে পাকিস্তানের উপর ভারতের প্রত্যাঘাতের সম্ভাবনা যত জোরালো হচ্ছে, ততই...

আজ দক্ষিণবঙ্গের সাত জেলায় কালবৈশাখীর পূর্বাভাস!

শনিবার দক্ষিণবঙ্গ (South Bengal Weather) জুড়ে ঝড় বৃষ্টির দুর্যোগ। আলিপুর আবহাওয়া দফতর (Alipore Weather Department) জানিয়েছে, এদিন বিকেলের...

গোয়ার শিরগাঁও মন্দিরে দুর্ঘটনা, পদপিষ্ট হয়ে ৬ জনের মৃত্যু! আহত একাধিক

গোয়ার শিরগাঁও গ্রামের লাইরাই দেবী মন্দিরে শতাব্দী প্রাচীন প্রাচীন বার্ষিক শোভাযাত্রা উপলক্ষ্যে বহু মানুষের ভিড়ে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনায়...