“আট হাজারের মা”, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

শোনা যায় চল্লিশ বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন সন্তান ধারণ করতে পারেন নি এই আক্ষেপে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত মরা আর হয়ে ওঠে নি তাঁর । তাঁর স্বামী কিন্তু এ নিয়ে তাঁকে গঞ্জনা দেন নি , দোষারোপ করেন নি কখনও । বরং সমর্থন জুগিয়েছেন তাঁর সব কাজে । সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে তাঁর পছন্দের কোনো কাজ বেছে নিতে । সেইমতো তিনি তাঁর প্রিয় কাজ হিসেবে বেছে নেন বৃক্ষরোপণ । চল্লিশ বছর বয়সে যিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে চেয়েছিলেন তিনি আজও বেঁচে আছেন শতাব্দী অতিক্রম করে । এখন তাঁর বয়স ১১৩ ।

তিনি সালুমারাদা থিম্মাক্কা । যিনি আলা মারাদা তিম্মাক্কা নামেও পরিচিত , কর্ণাটক রাজ্যের একজন প্রসিদ্ধ পরিবেশবিদ । হুলিকাল এবং কুদ্দুরের মধ্যে রাজপথের ৪ কিলোমিটার জায়গা বরাবর ৩৮৫ টি অশ্বত্থ জাতীয় গাছ লাগিয়ে এবং তাদের লালন পালন করে তিনি জনপ্রিয় ও স্বনামধন্য হয়ে ওঠেন । এছাড়া অন্যান্য গাছ লাগিয়েছেন প্রায় ৮০০০ । চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সংকল্পের অন্য নাম তিনি । একদিন সন্তানধারণের অক্ষমতা ভুলতে যা ছিল তাঁর সান্ত্বনা , তা আজ তাঁর সন্তানসম । তাঁর সুদীর্ঘ জীবন জুড়ে শুধু গাছ আর গাছ । গাছেদের বড়ো করে তোলার মধ্যেই তিনি পেয়েছেন প্রকৃত মাতৃত্বের স্বাদ । সালুমারাদা থিম্মাক্কার জন্ম ১৯১১ সালে , গুব্বি তালুক , টুমাকুরু জেলায় , কর্ণাটকে । তিনি প্রথাগত কোনো শিক্ষা পান নি । একটি খাদানে দৈনন্দিন শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন ।

কর্ণাটকের টুমাকুরু জেলার এই মেয়েটির বিয়ে হয় ওই রাজ্যেরই রামনগর জেলার মাগদি তালুকের হুলিকাল গ্রামের অধিবাসী চিক্কাইয়ার সঙ্গে । তাঁদের কোনো সন্তান হয় নি ।‌ সেই দুঃখ ভুলতেই স্বামীর প্রেরণায় গাছ লাগানো শুরু করেন থিম্মাক্কা । তাঁর এই কাজকে সম্মান জানিয়ে তাঁকে সালুমারাদা ( কন্নড় ভাষায় গাছের সারি ) নামে ডাকা হয় । থিম্মাক্কার গ্রামের কাছে প্রচুর ডুমুর গাছ ছিল , এগুলো অশ্বত্থ জাতীয় গাছ ।

তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে এই গাছ থেকে কলম করে চারাগাছ তৈরি শুরু করেন । প্রথম বছরে ১০ টি , দ্বিতীয় বছরে ১৫ টি এবং তৃতীয় বছরে ২০ টি কলমচারা রোপণ করা হয়। নিজেদের সামান্য রোজগার পর্যন্ত তাঁরা এসবের পিছনে খরচ করে ফেলতেন । এই দম্পতি ৪ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত চারটি বালতি করে জল বহন করে নিয়ে যেতেন গাছে জল দেবার জন্য । গাছগুলোর চারপাশে তাঁরা কাঁটাঝোপের বেড়া দিয়েছিলেন গবাদি পশুদের মুখ থেকে গাছগুলো রক্ষার জন্য । গাছপালা বেশিরভাগ রোপণ করা হয় বৃষ্টির মরশুমে , যাতে গাছগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পায় । সব মিলিয়ে ৩৮৪ টি গাছ লাগানো হয়েছিল , যেগুলোর সম্পদমূল্য প্রায় ১.৫ মিলিয়ন টাকা । এখন এই গাছগুলোর দায়িত্ব নিয়েছে কর্ণাটক সরকার । তারাই এগুলোর রক্ষনাবেক্ষণ করে ।

১৯৯১ সালে থিম্মাক্কার স্বামী মারা যান । তাঁর স্বামীর স্মরণে গ্রামে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করার স্বপ্ন দেখেন থিম্মাক্কা বনভূমি সৃজন থেকে শুরু করে বহু সামাজিক কাজে যুক্ত এই বৃক্ষমাতা । সারা দেশ , সারা বিশ্ব থেকে ডাক আসে তাঁর । তাঁর কাজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত ও বহুল প্রশংসিত । জীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন । বিবিসি ২০১৬ সালে তাঁকে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণাদায়িনী মহিলা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে । বিশ্বপ্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় তাঁর এই জীবনব্যাপী কাজের জন্য তিনি ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কার পান ২০১৯ সালে ।

আরও পড়ুন- আরজি কর কাণ্ডের জের, মহিলা নিরাপত্তায় ১৫ দফা নির্দেশিকা লালবাজারের

প্রকৃতি থেকে যখন ক্রমেই বিলুপ্ত হচ্ছে সবুজ , যখন বিশ্ব উষ্ণায়ন এই গ্রহের সবচেয়ে বড়ো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে , যখন বাড়ছে বিষাক্ত গ্যাস এবং কমছে জীবনদায়ী অক্সিজেন , সেই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে বয়সের ভারে রুগ্ন মা থিম্মাক্কা সারা পৃথিবীকে শিখিয়ে চলেছেন প্রকৃতি চেতনার সারকথা । বৃক্ষনিধন নয় , দিচ্ছেন বৃক্ষরোপণের অতীব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ পাঠ । গাছ বাঁচলে তবেই বাঁচবে পৃথিবী , তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে এই কথাটাই সারা বিশ্বকে বুঝিয়ে চলেছেন গাছেদের মা ।

 

 

Previous articleসইয়ের অনুমতি আনোয়ারকে, আজ রাতে শহরে আসতে চলেছেন ভারতীয় ডিফেন্ডার : সূত্র
Next articleবিজেপির ওড়িশায় বিপদে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা, ফেরানোর উদ্যোগ মমতার