Saturday, May 3, 2025

“আট হাজারের মা”, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

শোনা যায় চল্লিশ বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন সন্তান ধারণ করতে পারেন নি এই আক্ষেপে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত মরা আর হয়ে ওঠে নি তাঁর । তাঁর স্বামী কিন্তু এ নিয়ে তাঁকে গঞ্জনা দেন নি , দোষারোপ করেন নি কখনও । বরং সমর্থন জুগিয়েছেন তাঁর সব কাজে । সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে তাঁর পছন্দের কোনো কাজ বেছে নিতে । সেইমতো তিনি তাঁর প্রিয় কাজ হিসেবে বেছে নেন বৃক্ষরোপণ । চল্লিশ বছর বয়সে যিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে চেয়েছিলেন তিনি আজও বেঁচে আছেন শতাব্দী অতিক্রম করে । এখন তাঁর বয়স ১১৩ ।

তিনি সালুমারাদা থিম্মাক্কা । যিনি আলা মারাদা তিম্মাক্কা নামেও পরিচিত , কর্ণাটক রাজ্যের একজন প্রসিদ্ধ পরিবেশবিদ । হুলিকাল এবং কুদ্দুরের মধ্যে রাজপথের ৪ কিলোমিটার জায়গা বরাবর ৩৮৫ টি অশ্বত্থ জাতীয় গাছ লাগিয়ে এবং তাদের লালন পালন করে তিনি জনপ্রিয় ও স্বনামধন্য হয়ে ওঠেন । এছাড়া অন্যান্য গাছ লাগিয়েছেন প্রায় ৮০০০ । চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সংকল্পের অন্য নাম তিনি । একদিন সন্তানধারণের অক্ষমতা ভুলতে যা ছিল তাঁর সান্ত্বনা , তা আজ তাঁর সন্তানসম । তাঁর সুদীর্ঘ জীবন জুড়ে শুধু গাছ আর গাছ । গাছেদের বড়ো করে তোলার মধ্যেই তিনি পেয়েছেন প্রকৃত মাতৃত্বের স্বাদ । সালুমারাদা থিম্মাক্কার জন্ম ১৯১১ সালে , গুব্বি তালুক , টুমাকুরু জেলায় , কর্ণাটকে । তিনি প্রথাগত কোনো শিক্ষা পান নি । একটি খাদানে দৈনন্দিন শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন ।

কর্ণাটকের টুমাকুরু জেলার এই মেয়েটির বিয়ে হয় ওই রাজ্যেরই রামনগর জেলার মাগদি তালুকের হুলিকাল গ্রামের অধিবাসী চিক্কাইয়ার সঙ্গে । তাঁদের কোনো সন্তান হয় নি ।‌ সেই দুঃখ ভুলতেই স্বামীর প্রেরণায় গাছ লাগানো শুরু করেন থিম্মাক্কা । তাঁর এই কাজকে সম্মান জানিয়ে তাঁকে সালুমারাদা ( কন্নড় ভাষায় গাছের সারি ) নামে ডাকা হয় । থিম্মাক্কার গ্রামের কাছে প্রচুর ডুমুর গাছ ছিল , এগুলো অশ্বত্থ জাতীয় গাছ ।

তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে এই গাছ থেকে কলম করে চারাগাছ তৈরি শুরু করেন । প্রথম বছরে ১০ টি , দ্বিতীয় বছরে ১৫ টি এবং তৃতীয় বছরে ২০ টি কলমচারা রোপণ করা হয়। নিজেদের সামান্য রোজগার পর্যন্ত তাঁরা এসবের পিছনে খরচ করে ফেলতেন । এই দম্পতি ৪ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত চারটি বালতি করে জল বহন করে নিয়ে যেতেন গাছে জল দেবার জন্য । গাছগুলোর চারপাশে তাঁরা কাঁটাঝোপের বেড়া দিয়েছিলেন গবাদি পশুদের মুখ থেকে গাছগুলো রক্ষার জন্য । গাছপালা বেশিরভাগ রোপণ করা হয় বৃষ্টির মরশুমে , যাতে গাছগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পায় । সব মিলিয়ে ৩৮৪ টি গাছ লাগানো হয়েছিল , যেগুলোর সম্পদমূল্য প্রায় ১.৫ মিলিয়ন টাকা । এখন এই গাছগুলোর দায়িত্ব নিয়েছে কর্ণাটক সরকার । তারাই এগুলোর রক্ষনাবেক্ষণ করে ।

১৯৯১ সালে থিম্মাক্কার স্বামী মারা যান । তাঁর স্বামীর স্মরণে গ্রামে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করার স্বপ্ন দেখেন থিম্মাক্কা বনভূমি সৃজন থেকে শুরু করে বহু সামাজিক কাজে যুক্ত এই বৃক্ষমাতা । সারা দেশ , সারা বিশ্ব থেকে ডাক আসে তাঁর । তাঁর কাজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত ও বহুল প্রশংসিত । জীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন । বিবিসি ২০১৬ সালে তাঁকে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণাদায়িনী মহিলা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে । বিশ্বপ্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় তাঁর এই জীবনব্যাপী কাজের জন্য তিনি ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কার পান ২০১৯ সালে ।

আরও পড়ুন- আরজি কর কাণ্ডের জের, মহিলা নিরাপত্তায় ১৫ দফা নির্দেশিকা লালবাজারের

প্রকৃতি থেকে যখন ক্রমেই বিলুপ্ত হচ্ছে সবুজ , যখন বিশ্ব উষ্ণায়ন এই গ্রহের সবচেয়ে বড়ো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে , যখন বাড়ছে বিষাক্ত গ্যাস এবং কমছে জীবনদায়ী অক্সিজেন , সেই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে বয়সের ভারে রুগ্ন মা থিম্মাক্কা সারা পৃথিবীকে শিখিয়ে চলেছেন প্রকৃতি চেতনার সারকথা । বৃক্ষনিধন নয় , দিচ্ছেন বৃক্ষরোপণের অতীব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ পাঠ । গাছ বাঁচলে তবেই বাঁচবে পৃথিবী , তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে এই কথাটাই সারা বিশ্বকে বুঝিয়ে চলেছেন গাছেদের মা ।

 

 

spot_img
spot_img

Related articles

বিজেপি শাসিত রাজ্যে হেনস্থা বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের! শাহকে চিঠি সাংসদ সামিরুলের

বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর অত্যাচার ও বৈষম্যের অভিযোগ তুলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখলেন...

আইএএস-আইপিএসদের নয়া ইউনিফায়েড পেনশন প্রকল্প চালুর সিদ্ধান্ত রাজ্যের

সর্বভারতীয় ক্যাডারের অন্তর্গত আইএএস, আইপিএস সহ অন্যান্য আধিকারিকদের জন্য রাজ্য সরকার নতুন ইউনিফায়েড পেনশন প্রকল্পের (Unified Pension Scheme)...

বিনা অনুমতিতে পাকিস্তানি মহিলাকে বিয়ে! ভিসা শেষের পর আশ্রয় দিয়ে বরখাস্ত CRPF জওয়ান

পহেলগাঁওয়ে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলায় ২৬ জনের মৃত্যুর পর দেশজুড়ে পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভারত...

সাত লাখি কলম! মনের মতো লেখার টানে পেন উৎসবে কলকাতার মানুষ

দাম দিয়ে কলমের আঁচড়ের যে মূল্য দেওয়া যায় না তার নজির মেলে বাঙালির পেনের প্রতি আকর্ষণ দেখলে। ল্যাপটপের...