‘বাঘকন্যা খইরি’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

” … জলে ও জঙ্গলে ভয়ংকরী
… মানুষের ঘরে-দোরে অনায়াসে ফেরো কন্যার মতন
মানুষী মায়ের গায়ে পা তুলে শুয়েছো তুমি ভরসন্ধেবেলা…
মানুষের ঘর ছেড়ে যাবে না ?
জঙ্গলই তোমার ঘর ,
জঙ্গলে যাবে না ?

( খৈরী আমার খৈরী ,
একটি এলেজি
শক্তি চট্টোপাধ্যায় )

খৈরী একটি নদীর নাম । সেই নদীর নাম থেকেই গৃহস্থের ঘরে পোষা এক বাঘিনীর নাম খৈরী । বড়ো আদরের খৈরী বা খয়েরী । ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসের কোন এক দিন সিমলিপাল ফরেস্ট রিজার্ভের ডিরেক্টর সরোজ রায়চৌধুরীর কাছে এক বাঘের বাচ্চাকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন গ্রামবাসীরা । তারপর সেই শিশু বাঘটি বড়ো হয়ে গৃহপালিত পশুর মতো জীবন কাটিয়ে দিলো সরোজবাবুর পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে । সে এক আশ্চর্য ইতিহাস ।

ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার অন্তর্গত সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভ । সেই অঞ্চলের খারিয়া সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে খৈরী নদীর ধার থেকে উদ্ধার করে সেই ব্যাঘ্রশাবকটিকে । প্রথমে তারা তিনটি বাচ্চাসহ এক বাঘিনীকে লক্ষ্য করেন নদীর ধারে ।‌ সেই সময় ক্যানেস্তারা , ড্রামের শব্দে ভীত বাঘিনী তার দুটি শাবক নিয়ে পালিয়ে যায় , একটি পড়ে থাকে । অসহায় সেই শিশু বাঘকন্যাকে উদ্ধার করে সরোজবাবুর নিরাপদ হাতে সমর্পণ করেন গ্রামবাসীরা ।

তারপর থেকে দীর্ঘ সাত বছর ধরে পরম যত্নে খৈরীকে বড়ো করে তোলেন তিনি । যোশিপুরে সরোজবাবুর সরকারী বনবাংলোয় পরম আনন্দে দিন কাটাতে থাকে খৈরী । সরোজবাবুর খুড়তুতো বোন নীহার নলিনীর সঙ্গেও দারুণ সখ্যতা গড়ে ওঠে খৈরীর । পাঁঠার মাংস আর গুঁড়ো দুধ খেয়ে তাঁদের সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়তো সে , কখনও বা খেলতো তাঁদের সঙ্গে । সরোজবাবু নানা জায়গা থেকে হরিণছানা , বনবিড়াল উদ্ধার করে নিজের দায়িত্বে লালন-পালন করতেন । খৈরী তাদের সঙ্গেও সময় কাটাতো।

হরিণ বা কুকুরকে যখন নীহার খাইয়ে দিত , তখন মুখ গোমড়া হয়ে যেত খৈরীর । ঈর্ষা হতো বোধহয় তার । সরোজবাবু খুব কাছ থেকে বাঘকন্যার আচার ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করতেন , বিশেষত বাঘেদের ফেরোমোন নিঃসরণের পদ্ধতি কিংবা তাদের মিলনের সময়কালীন আচরণ ইত্যাদিও পর্যবেক্ষণ করতেন । পরবর্তীকালে খৈরীকে নিয়েই বিখ্যাত বিজ্ঞানী রতনলাল ব্রক্ষ্মচারী ফেরোমোন নিঃসরণ সংক্রান্ত গবেষণা করেন এবং প্রাণীদের ফেরোমোনে বিশেষ তীব্র সুবাসের কারণ হিসেবে টু-এপি নামের এক রাসায়নিক যৌগ অনুর উপস্থিতি আবিষ্কার করেন ।

ধীরে ধীরে খৈরী হয়ে ওঠে সরোজবাবুর অতি প্রিয় । খৈরীকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার দক্ষতাও অর্জন করেন তিনি । প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ব্যবহার পদ্ধতিও জানতেন । খৈরীকে নিয়ে তিনি চলে যেতেন জঙ্গলের প্রাকৃতিক পরিবেশে , আর তারপর গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতেন সেই বাঘিনীর আচরণ । বাঘ তো অনেকেই পোষেন কিন্তু তাঁর মতো এত নিখুঁত পর্যবেক্ষণ ও নিপুণভাবে সমস্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করার মানসিকতা অধিকাংশ মানুষেরই থাকে না। ভারত সরকারের ‘ পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত সরোজ রায়চৌধুরী বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষায় আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন।

বাংলোয় অন্যান্য আরও পশুপাখিদের সাথে একত্রে একটি বিছানায় নীহার নলিনীর পাশে শুয়ে থাকতো খৈরী। আশ্চর্যের ব্যাপার , সরোজবাবুর সাহচর্যে থাকতে থাকতে সে সত্যিই পোষ্য হয়ে উঠেছিল , এমনকি জঙ্গলে তাকে ছেড়ে দিয়ে আসলেও খৈরী ঠিক বাড়ি ফিরে আসতো পথ চিনে । বন নয় , তার বাসস্থান হয়ে উঠেছিল গৃহস্থবাড়ি । স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও এই কারণেই বোধহয় খৈরী কোনো শাবক প্রসব করে নি ।
বাড়িতে থাকার ফলে তার বন্যপ্রবৃত্তিগুলি সম্ভবত ঠিকঠাক বিকশিত হয় নি ।

এরপরের ঘটনা নিদারুণ দুঃখের ।‌ ১৯৮১ সালে ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা ।‌ সরোজবাবুর অনুপস্থিতিতে বাংলোর মধ্যে ঢুকে পড়ে এক হিংস্র বন্য কুকুর । তাকে দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে খৈরী । উন্মত্ত লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত কুকুরটিকে মেরে ফেলে খৈরী। কিন্তু তার আগেই কুকুরটি খৈরীর গায়ে একটা কামড় বসিয়ে দেয় । তারপর জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয় খৈরী । তার প্রচণ্ড যন্ত্রণা হতে থাকে। চলাফেরা বন্ধ হয়ে যায় । জলাতঙ্কের প্রতিষেধক তাকে দেওয়া হয় অবশ্যই । এই দুঃসংবাদ পেয়ে সরোজ বাবু যখন ফিরে আসেন তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে । খৈরীর সেই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তাকে বেশি মাত্রার চেতনানাশক ইনজেকশন দেওয়া হয় । তারপর মারা যায় সরোজ বাবুর প্রাণের খৈরী । বাংলোর সামনেই কবর দেওয়া হয় তাকে । সরোজবাবুর কাছে খৈরী ছিল নিজের মেয়ের চেয়েও বেশি । সন্তান হারানোর শোক সহ্য করতে না পেরে খৈরীর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যুবরণ করেন সরোজ বাবু ।
মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিশু খৈরী ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় যেদিন আসে সরোজবাবুর কাছে , সেই প্রথম দিনেই তাকে অভয় দিয়েছিলেন সরোজবাবু , দিয়েছিলেন এক নিশ্চিন্ত কোল মায়ের মমতায় ।‌ বাঘের গর্জন করে শিশুটিকে আশ্বস্ত করতেই বাচ্চাটি ঝাঁপিয়ে পড়ে সরোজবাবুর কোলে । সম্ভবত সে বোঝে নিশ্চিন্তে থাকার এক আকাশ নির্ভরতা পাওয়া গেছে । তারপর তো অমরত্ব পায় বাঘে-মানুষে বন্ধুত্ব ও ভালবাসাবাসির এই ঘটনা ।

আরও পড়ুন- এবার ১০০ দিনের কর্মীদেরও দিতে হবে বায়োমেট্রিক হাজিরা, নির্দেশ কলকাতা পুরসভার

 

 

Previous articleএবার ১০০ দিনের কর্মীদেরও দিতে হবে বায়োমেট্রিক হাজিরা, নির্দেশ কলকাতা পুরসভার
Next articleBreakfast news : ব্রেকফাস্ট নিউজ