Sunday, August 24, 2025

‘বাঘকন্যা খইরি’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

” … জলে ও জঙ্গলে ভয়ংকরী
… মানুষের ঘরে-দোরে অনায়াসে ফেরো কন্যার মতন
মানুষী মায়ের গায়ে পা তুলে শুয়েছো তুমি ভরসন্ধেবেলা…
মানুষের ঘর ছেড়ে যাবে না ?
জঙ্গলই তোমার ঘর ,
জঙ্গলে যাবে না ?

( খৈরী আমার খৈরী ,
একটি এলেজি
শক্তি চট্টোপাধ্যায় )

খৈরী একটি নদীর নাম । সেই নদীর নাম থেকেই গৃহস্থের ঘরে পোষা এক বাঘিনীর নাম খৈরী । বড়ো আদরের খৈরী বা খয়েরী । ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসের কোন এক দিন সিমলিপাল ফরেস্ট রিজার্ভের ডিরেক্টর সরোজ রায়চৌধুরীর কাছে এক বাঘের বাচ্চাকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন গ্রামবাসীরা । তারপর সেই শিশু বাঘটি বড়ো হয়ে গৃহপালিত পশুর মতো জীবন কাটিয়ে দিলো সরোজবাবুর পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে । সে এক আশ্চর্য ইতিহাস ।

ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার অন্তর্গত সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভ । সেই অঞ্চলের খারিয়া সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে খৈরী নদীর ধার থেকে উদ্ধার করে সেই ব্যাঘ্রশাবকটিকে । প্রথমে তারা তিনটি বাচ্চাসহ এক বাঘিনীকে লক্ষ্য করেন নদীর ধারে ।‌ সেই সময় ক্যানেস্তারা , ড্রামের শব্দে ভীত বাঘিনী তার দুটি শাবক নিয়ে পালিয়ে যায় , একটি পড়ে থাকে । অসহায় সেই শিশু বাঘকন্যাকে উদ্ধার করে সরোজবাবুর নিরাপদ হাতে সমর্পণ করেন গ্রামবাসীরা ।

তারপর থেকে দীর্ঘ সাত বছর ধরে পরম যত্নে খৈরীকে বড়ো করে তোলেন তিনি । যোশিপুরে সরোজবাবুর সরকারী বনবাংলোয় পরম আনন্দে দিন কাটাতে থাকে খৈরী । সরোজবাবুর খুড়তুতো বোন নীহার নলিনীর সঙ্গেও দারুণ সখ্যতা গড়ে ওঠে খৈরীর । পাঁঠার মাংস আর গুঁড়ো দুধ খেয়ে তাঁদের সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়তো সে , কখনও বা খেলতো তাঁদের সঙ্গে । সরোজবাবু নানা জায়গা থেকে হরিণছানা , বনবিড়াল উদ্ধার করে নিজের দায়িত্বে লালন-পালন করতেন । খৈরী তাদের সঙ্গেও সময় কাটাতো।

হরিণ বা কুকুরকে যখন নীহার খাইয়ে দিত , তখন মুখ গোমড়া হয়ে যেত খৈরীর । ঈর্ষা হতো বোধহয় তার । সরোজবাবু খুব কাছ থেকে বাঘকন্যার আচার ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করতেন , বিশেষত বাঘেদের ফেরোমোন নিঃসরণের পদ্ধতি কিংবা তাদের মিলনের সময়কালীন আচরণ ইত্যাদিও পর্যবেক্ষণ করতেন । পরবর্তীকালে খৈরীকে নিয়েই বিখ্যাত বিজ্ঞানী রতনলাল ব্রক্ষ্মচারী ফেরোমোন নিঃসরণ সংক্রান্ত গবেষণা করেন এবং প্রাণীদের ফেরোমোনে বিশেষ তীব্র সুবাসের কারণ হিসেবে টু-এপি নামের এক রাসায়নিক যৌগ অনুর উপস্থিতি আবিষ্কার করেন ।

ধীরে ধীরে খৈরী হয়ে ওঠে সরোজবাবুর অতি প্রিয় । খৈরীকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার দক্ষতাও অর্জন করেন তিনি । প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ব্যবহার পদ্ধতিও জানতেন । খৈরীকে নিয়ে তিনি চলে যেতেন জঙ্গলের প্রাকৃতিক পরিবেশে , আর তারপর গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতেন সেই বাঘিনীর আচরণ । বাঘ তো অনেকেই পোষেন কিন্তু তাঁর মতো এত নিখুঁত পর্যবেক্ষণ ও নিপুণভাবে সমস্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করার মানসিকতা অধিকাংশ মানুষেরই থাকে না। ভারত সরকারের ‘ পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত সরোজ রায়চৌধুরী বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষায় আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন।

বাংলোয় অন্যান্য আরও পশুপাখিদের সাথে একত্রে একটি বিছানায় নীহার নলিনীর পাশে শুয়ে থাকতো খৈরী। আশ্চর্যের ব্যাপার , সরোজবাবুর সাহচর্যে থাকতে থাকতে সে সত্যিই পোষ্য হয়ে উঠেছিল , এমনকি জঙ্গলে তাকে ছেড়ে দিয়ে আসলেও খৈরী ঠিক বাড়ি ফিরে আসতো পথ চিনে । বন নয় , তার বাসস্থান হয়ে উঠেছিল গৃহস্থবাড়ি । স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও এই কারণেই বোধহয় খৈরী কোনো শাবক প্রসব করে নি ।
বাড়িতে থাকার ফলে তার বন্যপ্রবৃত্তিগুলি সম্ভবত ঠিকঠাক বিকশিত হয় নি ।

এরপরের ঘটনা নিদারুণ দুঃখের ।‌ ১৯৮১ সালে ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা ।‌ সরোজবাবুর অনুপস্থিতিতে বাংলোর মধ্যে ঢুকে পড়ে এক হিংস্র বন্য কুকুর । তাকে দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে খৈরী । উন্মত্ত লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত কুকুরটিকে মেরে ফেলে খৈরী। কিন্তু তার আগেই কুকুরটি খৈরীর গায়ে একটা কামড় বসিয়ে দেয় । তারপর জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয় খৈরী । তার প্রচণ্ড যন্ত্রণা হতে থাকে। চলাফেরা বন্ধ হয়ে যায় । জলাতঙ্কের প্রতিষেধক তাকে দেওয়া হয় অবশ্যই । এই দুঃসংবাদ পেয়ে সরোজ বাবু যখন ফিরে আসেন তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে । খৈরীর সেই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তাকে বেশি মাত্রার চেতনানাশক ইনজেকশন দেওয়া হয় । তারপর মারা যায় সরোজ বাবুর প্রাণের খৈরী । বাংলোর সামনেই কবর দেওয়া হয় তাকে । সরোজবাবুর কাছে খৈরী ছিল নিজের মেয়ের চেয়েও বেশি । সন্তান হারানোর শোক সহ্য করতে না পেরে খৈরীর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যুবরণ করেন সরোজ বাবু ।
মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিশু খৈরী ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় যেদিন আসে সরোজবাবুর কাছে , সেই প্রথম দিনেই তাকে অভয় দিয়েছিলেন সরোজবাবু , দিয়েছিলেন এক নিশ্চিন্ত কোল মায়ের মমতায় ।‌ বাঘের গর্জন করে শিশুটিকে আশ্বস্ত করতেই বাচ্চাটি ঝাঁপিয়ে পড়ে সরোজবাবুর কোলে । সম্ভবত সে বোঝে নিশ্চিন্তে থাকার এক আকাশ নির্ভরতা পাওয়া গেছে । তারপর তো অমরত্ব পায় বাঘে-মানুষে বন্ধুত্ব ও ভালবাসাবাসির এই ঘটনা ।

আরও পড়ুন- এবার ১০০ দিনের কর্মীদেরও দিতে হবে বায়োমেট্রিক হাজিরা, নির্দেশ কলকাতা পুরসভার

 

 

spot_img

Related articles

পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্পে নাম নথিভুক্তি শুরু

পরিযায়ী শ্রমিকদের সুবিধার্থে এবার আরও এক পদক্ষেপ রাজ্য সরকারের। ‘আমাদের পাড়া আমাদের সমাধান’ কর্মসূচির আওতায় দুয়ারে সরকার শিবিরেও...

‘নিখুঁত ভুলগুলি’, উৎপল সিনহার কলম

একটা দুঃখের কথা পথে ও বিপথে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে গান হয়ে ওঠে ...একটি দুঃখের কথা পথে ও বিপথে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে গান...

ষোলতেই ১৩০ কেজি! ছেলের খাবার জোগাতেই নাজেহাল বাবা-মা

মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি থানার কাবিলপুর পঞ্চায়েতের মথুরাপুর গ্রাম। এখানেই থাকেন দিনমজুর মুনশাদ আলি। তাঁর ছোট ছেলে জিশান আলি...

কবে থেকে শুরু জয়েন্টের কাউন্সেলিং? দিনক্ষণ জানিয়ে দিল বোর্ড

ফলপ্রকাশের পর এবার ১৫ দিনের মধ্যেই কাউন্সেলিং প্রক্রিয়া তথা ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করবে জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড। এবার কাউন্সেলিং...