শহর যখন আর জি কর কাণ্ডে উত্তাল! চারিদিকে চলছে প্রতিবাদ-মিছিল। আর এমনই পরিস্থিতিতে কবি শ্রীজাত আয়োজন করেছিলেন বারিশ-এর। কবির এই উদ্যোগে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়। তিনদিন ধরে চলে ওই অনুষ্ঠান। কবির ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন শ্রীকান্ত আচার্য, জয়তি চক্রবর্তী, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, অনুপম রায়, জয় সরকাররা। তিন দিন ধরে এই অনুষ্ঠান হওয়ায় কম বিতর্ক হয়নি। একাধিক কটুকথা শুনতে হচ্ছে কবিকে। এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রসঙ্গে মুখ খুলেন শ্রীজাত। দিলেন কড়া জবাব।

সোশ্যাল মিডিয়ায় কী লিখলেন কবি শ্রীজাত?

বারিশ-এর স্বপ্ন যখন দেখতে শুরু করি, তখনও কলকাতার আকাশে মেঘ জমেনি, পথে পথে নামেনি মিছিল। আর পাঁচটা স্বাভাবিক বছরের মতোই এগোচ্ছিল সময়। লেখালেখির পাশাপাশি একেবারে আনকোরা কাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করাটাও আমার একরকমের নেশা। তাই নতুন নতুন কাজে জড়িয়ে পড়েছি বারেবারে। কখনও আর-কারও ডাকে সাড়া দিয়ে, কখনও নিজেরই ডাকে। বারিশ ছিল আমার অনেকদিনের ডাক, নিজের প্রতি। সাড়া দিতে একটু দেরি হলো, এই যা।

প্রতি শীতে কলকাতা উপচে ওঠে হরেক রঙের আয়োজনে, কিন্তু যে-বর্ষা আমাদের শিল্পচর্চার অনেকখানি জুড়ে থেকেছে চিরকাল, তাকে সেভাবে উদযাপনের সুযোগ ঘটে না, এ ছিল আমার বরাবরের আক্ষেপ। প্রাকৃতিক কারণেই, বর্ষায় যে-কোনও ধরনের বড় আয়োজন করবার অনেক অসুবিধে এবং ঝুঁকি থাকে ঠিকই, কিন্তু এ-দুটো ব্যাপার না-থাকলে কাজ ক’রে আর মজা কোথায়? তাই ইচ্ছে ছিল, কেবল বর্ষাকে কেন্দ্র ক’রে এমন এক উৎসব আয়োজন করবার, যেখানে শিল্পের নানা শাখা’র সংমিশ্রণে বর্ষাকেই সাজিয়ে তোলা হবে। কবিতা থেকে ক্যানভাস, থিয়েটার থেকে শাস্ত্রীয় সংগীত, আড্ডা থেকে আলোচনা, লোকগান থেকে রবীন্দ্রনাথের গান ও লেখা, ঠুমরি থেকে ঠাসবুনোটের বক্তব্য, সিনেমা থেকে ছোটগল্প, সবই থাকবে এক ছাতার তলায়, আর সেই ছাতাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে ঝমঝম বৃষ্টি।

এরকমটা ভাবা যে খুব সহজ, অতি বিনয় ক’রে তা আমি বলব না। কিন্তু ভেবে ফেলা যদি-বা যায়, এই বিরাট আয়োজনকে সংঘটিত করা ভারী দুষ্কর ব্যাপার, সে কিছুতেই একার কাজ নয়। এখানে আমাকে ঋণ স্বীকার করতেই হবে আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু-দম্পতি মালবিকা Malavika R Banerjee ও জিতের Jeet Banerjee , যাঁরা এই অলীক প্রস্তাবকে বাস্তবে পরিণত করতে এক কথায় রাজি হয়েছেন এবং আয়োজনে কোনও রকম কসুর বা ত্রুটি রাখেননি। তাঁদের প্রতি আমার ভালবাসা ও সম্মান, দুই-ই বেড়ে গেল এই অনাবিল সহায়তার আবহে। Kolkata Literary Meet এবং Gameplan পরিবারের সমস্ত সদস্যের প্রতিও থাকল অকুণ্ঠ ভালবাসা, যাঁদের দিনরাতের পরিশ্রম ছাড়া কলকাতা বারিশ অনুষ্ঠিত হতে পারত না।

ধন্যবাদ জানাই আমাদের সমস্ত বিজ্ঞাপনদাতা ও স্পনসরদের, যাঁরা আমারই মতো, নতুনের ঝুঁকি সত্ত্বেও উজাড় করে দিয়েছেন অনেক কিছু। তিনদিনের অনুষ্ঠানে মঞ্চে উপস্থিত সমস্ত শিল্পী ও মঞ্চের বাইরের প্রত্যেক কলাকুশলীদের কাছে অশেষ ঋণ থাকল, প্রথমবারের বারিশ-কে এত অনন্য উপহারে সাজিয়ে দেবার জন্য। আর অবশ্যই ঋণী থাকলাম শ্রোতাদের কাছে, কলকাতা থেকে কলোরাডো, কল্যাণী থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, শিলিগুড়ি থেকে সিঙ্গাপুর, কোনও দূরত্বই যাঁদের কাছে বাধা মনে হয়নি। চরম উত্তাল দুঃসময়ে প্রতিবাদে জেগে ওঠা মানুষও দিনের শেষে শিল্পের কাছেই আশ্রয় নেয়। এ সত্যি যে চিরকালীন, ওই তিনদিনে ঘর ভরিয়ে দেওয়া শ্রোতারা তা প্রমাণ করলেন। এবং হ্যাঁ, রীতিমতো টিকিট খরিদ ক’রে। বিনামূল্যের শিল্পে আমার অনাস্থা আছে বরাবর। শ্রোতারাও দেখিয়ে দিলেন, মনমতো অনুষ্ঠান পেলে তাঁরা অর্থমূল্য ব্যয় করতে রাজি। অতএব, বাংলায় সিনেমা ছাড়া অন্য কিছু লোকে পয়সা দিয়ে দেখতে বা শুনতে যায় না, এর বিরুদ্ধেও কলকাতা বারিশ একটি উদাহরণ হয়ে থাকল। উপর্যুপরি এই তীব্র অস্থির সময়ে, যখন মনমেজাজ থেকে পথঘাট, সবই প্রায় বন্ধ। বারিশ-এর দরজা ছিল খোলা আর ঘর ছিল ভর্তি। শ্রোতারা যেভাবে নতুন এই উদ্যোগকে আলিঙ্গন করলেন, তার জন্য কোনও কুর্নিশই যথেষ্ট নয়।
সবশেষে বলি, যে-কোনও নতুন কাজই অনেক কিছু শেখায়, চেনায়। কত বন্ধু যে নানাভাবে পাশে থেকে উৎসাহ আর সাহস জোগালেন, তা বলার নয়। এই জোরটুকু আমার খুব প্রয়োজন ছিল। আবার কিছু চেনামুখ একটু একটু অচেনা হয়ে উঠল, বারিশের জলের ছাঁট লেগেই বোধহয়। সেসব মন থেকে ধুয়ে যাবে নিশ্চয়ই। এটা আমি মানি যে, কোনও নতুন কাজ প্রথমবার করা খুব কঠিন। বারিশ-এর মতো একখানা বৃহৎ আয়োজন তো বটেই। তবে আরও কঠিন হলো তাকে বজায় রাখা। আমার জানাতে ভাল লাগছে যে, কলকাতা বারিশ অনুষ্ঠিত হবে, প্রতি বছর। আয়োজক, পরিবেশক এবং শ্রোতাদের ভালবাসায় তার আর থামবার জো নেই। ২০২৫-এর বর্ষাও সেজে উঠবে নতুন রঙের মেঘে, তার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। বৃষ্টি যেন আমাদের সব কালিমা ধুয়ে নিয়ে আবার কোনও এক পরিষ্কার আকাশের নীচে দাঁড় করাতে পারে, এটুকুই আমাদের চাওয়া। আমি জানি, আপনাদেরও।

পুনশ্চ : ইদানীং এমন হয়েছে যে, বাঁকা কথা না-শুনলে ঠিক বুঝতেও পারি না, সোজা পথে আছি কিনা। কলকাতা বারিশ ঘোষিত হবার পর থেকে আজ অবধি তাকে ঘিরে যা যা বেকার ছলনাময় কটূক্তি চোখে পড়েছে, যেসব অপটু কুযুক্তির খেলনা চক্রব্যূহে তাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা হয়েছে, যে-সমস্ত অকর্মণ্য আলস্যময় ট্রোলার্ণবেরা হাতে দেদার সময় পেয়ে খুঁতের অগ্রিম বুকিং চালিয়েছেন, তাতে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, বেশ করছি। এবং, আবার করব। বাঙালিদের মধ্যে কিছু মানুষ চিরকালই কাজ করে, বাকিরা জাজ করে। তবে হাতে-কলমে যাচাই না-ক’রে খোঁটা দেবার এই ব্যাপারটাকে আমি দুর্বলের লক্ষণ বলেই মনে করি। তাই জানাই, এ-বছর যেহেতু প্রচুর মানুষ টিকিট না-পেয়ে ফিরে গেছেন, তাই সামনের বছর থেকে কলকাতা বারিশ আরও বড় কোনও প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত হবে, আরও বড় আকারেই। সকলের আমন্ত্রণ রইল। আপনারাও আসুন, একবার পকেটের পয়সা খরচ ক’রে দেখেশুনে পরখ ক’রে তারপর গালিগালাজ করে দেখুন, ভাল লাগবে। এইভাবে ফ্রি-তে আর কতদিন?
আরও পড়ুন- KMC: অভিনব উদ্যোগ! স্বাস্থ্য সচেনতায় পথনাটিকা পুরসভার স্বাস্থ্যকর্মীদের
