Wednesday, December 17, 2025

‘দুর্গতিনাশিনী’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

এসো এসো মাগো

দেবী দশভূজা
এসো মা শারদজননী
এসো মা ভবানী
পিনাকধারিনী
এসো মা ভুবনমোহিনী ।

এই যে আগমনী গান , একি শুধু গানের জন্য গান ? শুধু কি কথা ও সুর , তাল ও লয় , আর ছন্দের নন্দিত বন্দনা ? এর সঙ্গে কি জড়িয়ে নেই হাজারো পেশার অগণ্য মানুষের রুটিরুজি , সারা বছরের অন্নসংস্থান ? একি শুধু কথার পিঠে কথা বসিয়ে মাকে তুষ্ট করার অভিসন্ধি?

এসো মা আশ্বিনে শারদপ্রাতে
এসো শুভ্র মেঘের রথে
দুঃখের সংসারে
খুশি নিয়ে এসো
এসো দুর্গতিনাশিনী ।

যাঁরা বিষাক্ত সাপের ছোবল উপেক্ষা করে প্রাণ হাতে নিয়ে পদ্ম তোলেন মায়ের পূজার অর্ঘ্য সম্পূর্ণ করার অভিপ্রায়ে , সে কি শুধুই কিছু বাড়তি রোজগারের আশায় ?

এতে কোনো সমর্পণ নেই ? সন্তানকে দুধেভাতে রাখার বাসনা কি মিশে নেই অমূল্য পদ্ম আহরণে ? শুধু কি পদ্ম ? আমাদের তথাকথিত সভ্য নাগরিক সমাজে একপ্রকার ব্রাত্য বারাঙ্গনা তকমাপ্রাপ্ত অসংখ্য মা-বোনেরা অপেক্ষা করেন সারাটা বছর শুধুমাত্র এক চিলতে সম্মানপ্রাপ্তির আশায় , যখন কিনা হাজার হাজার মণ্ডপে দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ‘ বেশ্যাবাড়ির মাটি’ দারুণ মূল্যবান হয়ে ওঠে ।

জমানো চোখের জলে
শাপলা শালুক ফুলে
অর্ঘ্য রচেছি যতনে
অঞ্জলি নিও আর
আশ্রয় দিও মাগো
তোমার রাতুল চরণে ।

শাপলা-শালুক চয়ণ করেন যাঁরা , সারা বছর অভাবের মেঘে ঢাকা থাকে তাঁদের সাধের সংসার । শারদোৎসব তাঁদের হাতে এনে দেয় কিছু কাঁচা পয়সা । যদিও সাময়িক , তবুও মায়ের আগমন ছাড়া এও কি জুটতো ?

আর ঢাকি ভাইয়েরা ? বোধনের দিন থেকে যাঁরা আনন্দের হিল্লোল তোলেন তালে তালে ছন্দে ছন্দে হরেক বোল আর লয়কারীর জাদুতে ? আমরা সমস্বরে উচ্ছল হয়ে উঠি , ‘ ওই তো ঢাকে কাঠি পড়েছে ‘ ! কিন্ত যতই তাল ঠুকি না কেন , আসল ‘ বোল ‘ তো লুকিয়ে থাকে হাজারো ঢাকি ভায়েদের বুকের গভীরে কান্না হয়ে । কি সেই ‘ বোল ‘ ?
‘ ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ
ঠাকুর যাবে বিসর্জন ‘ ।

একলপ্তে হাজার কয়েক টাকা আসবে বটে হাতে , কিন্তু সে সব তো ফুরিয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই । তারপর খাবো কি বাবু ? কিভাবে সংসার চলবে আমাদের ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে পৃথিবীর আহ্নিক গতি যেন থমকে যায় । কেউ কি বলতে পারেন দুর্গাপূজা শেষ হয়ে গেলে কীভাবে চলবে ঢাকশিল্পীদের সংসার ?

যাঁরা চাঁদমালা বানান , পুজোর ছোট ছোট অথচ ভীষণ জরুরি উপাদানের জোগান দেন , তাঁদের সারা বছর কতটা টানাটানির মধ্যে দিয়ে কাটাতে হয় তার খবরই বা কে রাখে ? যাঁরা প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধেন , অসামান্য সব মণ্ডপসজ্জার কাঠামো তৈরি করেন দিনরাত এক করে , তাঁরা শারদোৎসব শেষ হয়ে গেলে কীভাবে বাঁচেন ?

জগতের লাঞ্ছিত আতুর জনে
বরাভয় দিও
বল দিও গো প্রাণে
দাও মা সুরের আলো
ছড়িয়ে আঁধারে
ওগো মা করুণারূপিনী ।।
বরাভয়দাত্রীর কৃপা করুণা কারা পান ? যাঁদের প্রকৃতই পাওয়া উচিত তাঁরা পান কি ? সম্পন্ন ব্যবসায়ীরা শারদোৎসবের পর ফুলে ফেঁপে ওঠেন । কিন্তু পুজোয় যুক্ত থাকেন হাজার হাজার গরীব মানুষ । পুজোর বিশাল অর্থনীতি থেকে তাঁদের প্রাপ্তি যথারীতি যৎসামান্য , ছিটেফোঁটা । সন্তানদের দুধেভাতে রাখাটা তাঁদের কাছে স্বপ্নই । তবু নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালোর মতো তাঁরা বছরভর চাতকের মতো অপেক্ষা করতে থাকেন মায়ের আগমনের । কিছুই না পাওয়ার চেয়ে বছরের ওই বিশেষ চারদিনের নগদপ্রাপ্তি তো ভালো বটেই ।

আরও পড়ুন- সারেগামাপার মঞ্চে দরদী রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে মন জিতলেন জাভেদ

অটো বা টোটোর মতো ছোট গাড়ির চালকেরা পুজোয় বাড়তি কিছু রোজগার করেন। বড়ো ও বিখ্যাত পুজোমণ্ডপের আশেপাশে চা-পান-চপ-ঘুঘনি-ঝালমুড়ি-ফুচকা ও অন্যান্য ছোট ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত কিছু রোজগার করার সুযোগ পান অবশ্যই । মেলা বসে অনেক জায়গায় । দরিদ্র ব্যবসায়ীদের মুখে সামান্য হাসি ফুটে ওঠে ওই ক’টা দিন। আলোক শিল্পী , মাইক্রোফোন ব্যবসায়ী , ডেকরেটর্স , ফল ও ফুল বিক্রেতা , বাসন ও দশকর্মা ব্যবসায়ী , মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী ও পেশাদার গায়ক-গায়িকারা সাধারণত ভালো রোজগার করেন শারদোৎসবে । কিন্তু এখানে যুক্ত দরিদ্র শ্রমিক ও কর্মচারীরা অন্যান্য সময়ের চেয়ে কিছুটা বেশি রোজগারের মুখ দেখলেও সারা বছরের জন্য তা নেহাতই অপ্রতুল । তবুও তাঁরা সম্ভবত এই ভেবেই নিজেদের সান্ত্বনা দিতে থাকেন যে ,’ … তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে ‘ । এটা কিন্তু অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে , মায়ের মুখের হাসি সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেয় । হাজার কষ্টের মাঝেও অপার শান্তি অনুভূত হয় । মায়ের আগমণে অনন্ত জাগে । বিশ্বচরাচর আনন্দময় হয়ে ওঠে ।

 

spot_img

Related articles

ঢাকায় হুমকি হাইকমিশনে: বাংলাদেশের হাই কমিশনারকে তলব বিদেশ মন্ত্রকের

বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাসে ক্রমাগত হুমকি। অথচ বাংলাদেশের মহম্মদ ইউনূস (Mohammed Yunus) পরিচালিত অন্তর্বর্তী সরকার নীরব। প্রতিবেশী দেশ ভারতের...

বাংলায় কোটি কোটি রোহিঙ্গা-বাংলাদেশি কোথায়? মিথ্যাচারের জন্য ক্ষমা চাক বঙ্গ বিজেপি: তীব্র নিশানা অভিষেকের

বিজেপি বলেছিল বাংলায় এক-দেড় কোটি রোহিঙ্গা, অগণিত বাংলাদেশি নাগরিক আছে। তারা কোথায় গেল? বাংলার ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন...

NCRT-র সিলেবাসে বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাস রাখার দাবি ঋতব্রতের

এনসিইআরটি-র পাঠ্যবইয়ে বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের (Bengali Freedom Fighters) ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানালেন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ ঋতব্রত...

অস্কার নমিনেশনে শর্টলিস্টেড ‘হোমবাউন্ড’! উচ্ছ্বসিত করণ শুভেচ্ছা জানালেন টিমকে

অ্যাকাডেমি পুরস্কার জেতার স্বপ্ন দেখছে ভারতীয় বিনোদন জগত (Indian Entertainment Industry)। মঙ্গলবার ৯৮তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসে সেরা আন্তর্জাতিক ফিচার...