রাজ্যের মানুষের প্রহরী তিনি। তাই বিপর্যের প্রহরে রাজ্যের প্রতিটি মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে বিনীদ্র রাত্রী যাপন করাই তাঁর অভ্যাস। এর আগে ইয়াস, আম্পান, ফণীর সময় তার স্বাক্ষী থেকেছেন রাজ্যবাসী। এবার ঘুর্ণিঝড় ডানার হানাদারির সময়ও তার ব্যতয় হলনা। সচিবালয় নবান্নে বসেই গোটা রাজ্যের উপর আক্ষরিক ভাবে অক্লান্ত নজরদারী চালালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গোটা দুর্যোগের রাত এবং তার পরের বৃষ্টিমুখর সকাল পেরিয়ে গড়াল দুপুর। তখন ঘূর্ণিঝড়ের অভিঘাতে রাজ্যের প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি পর্যালোচনার পরেই অবশেষে নবান্ন থেকে বেরল মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি। তখন তাঁর সচিবালয় যাপনের ২৮ ঘণ্টা অতিক্রান্ত।

বৃহস্পতিবার বিকালেই সাংবাদিক বৈঠকে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন রাতভর থাকবেন নবান্নে । ঝড়ের ওপরে চালাবেন কড়া নজরদারি। দেখা গেল রাত কেটে ভোর হয়ে সকালেও সেই নবান্নে বসেই ঝড়বৃষ্টির ওপর নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার ভোর রাতে প্রবল শক্তি নিয়ে ‘ডানা’ আছড়ে পড়েছে ওড়িশার বুকে। দিল্লির মৌসম ভবন জানিয়েছে, ডানার স্থল্ভাগে ঢোকার প্রক্রিয়া শুরু হয় রাত সাড়ে এগারোটায়। তবে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী ‘রেডার সার্চ’ প্রযুক্তির মাধ্যমে ঝড়ের ল্যান্ডফল-এ নজর রেখেছিলেন সন্ধ্যা থেকেই। ঘণ্টায় প্রায় ১২০ কিমি বেগে ডানার ল্যান্ডফল লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে ধামরা সহ আশেপাশের এলাকা। রাত পেরিয়ে সকাল হয়েছে। এখনও নবান্ন থেকে গোটা পরিস্থিতির উপর নজরদারি চালাচ্ছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। কথা বলছেন উপকূলবর্তী জেলাগুলোর জেলাশাসকদের সঙ্গে। খোঁজ নিচ্ছেন ক্ষয়ক্ষতির।

পরিস্থিতির উপর নজরদারি চালাতে নবান্নে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুম সক্রিয় ছিল । সেখানেই রাত কাটান মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, স্বরাষ্ট্রসচিব নন্দিনী চক্রবর্তী, রাজ্য পুলিশের ডিজি- সহ অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। উপস্থিত ছিলেন আলিপুর আবহাওয়া দফতরের প্রাক্তন অধিকর্তা গোকুল চন্দ্র দেবনাথও। ছিলেন রাজ্যের বিপর্যায় মোকাবিলা দফতরের মন্ত্রী জাভেদ খানও। গতকাল সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠকের মাধ্যমে রাজ্যবাসীকে বার্তা দিয়েছিলেন। তারপরেও রাতে সোশ্যাল মিডিয়া মারফত জানান, ‘আমার রাজ্যবাসী যখনই কোনও বিপদের সম্মুখীন হয়েছে, আমি দিবারাত্রি তাঁদের পাশে থেকেছি। এবারও তার পরিবর্তন হয়নি। আজ নবান্নে, রাজ্যের এমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার থেকে ঘূর্ণিঝড় দানা পর্যবেক্ষণ করছি। আমাদের সরকার, প্রশাসন এবং সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধিরা সর্বদা আপনাদের সেবায় প্রস্তুত। ইতিমধ্যেই আমরা যা যা করণীয় সব করেছি। আপনারা ভয় পাবেন না, আতঙ্কিত হবেন না। সতর্ক থাকুন। আমরা আছি সর্বক্ষণ আপনাদের রক্ষার্থে।’

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে হাল্কা ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয় দক্ষিণবঙ্গের প্রায় সর্বত্র। উপকূলবর্তী এলাকায় রাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়ার তীব্রতা। সেই সঙ্গে প্রায় ৫ ফুট উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়তে শুরু করে। রাত বাড়তেই পূর্ব মেদিনীপুরের দীঘায় প্রবল ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে। সঙ্গে বৃষ্টি। উত্তাল হয়ে ওঠে সমুদ্রও। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে জেলাগুলিতে যাওয়া প্রধান সচিবরাও সেখানকার অফিসে রাত জেগে পরিস্থিতির ওপর নজর রেখেছেন। রাতভর বিদ্যুৎ দফতরের কন্ট্রোল রুমে ছিলেন রাজ্যের বিদ্যুৎ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও। রাতের মধ্যে রাজ্যের দু’লক্ষেরও বেশি মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে খবর। ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার বাসিন্দা। দুপুরে ভিডিও কনফারেন্স করে জেলাগুলির প্রশাসনের কাছ থেকে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক রিপোর্ট নেন মুখ্যমন্ত্রী। শস্য ও সম্পত্তিহানির বিস্তারিত রিপোর্ট তলব করতে বলেন। ক্ষতিগ্রস্থদের পাশে থাকার সবরকম আশ্বাস দেন। তারপরেই নবান্ন ছাড়েন। ততক্ষণে দুর্যোগের মেঘ অনেকটাই ফিকে হতে শুরু করেছে। ধরে এসেছে ভারি বৃষ্টি।

আরও পড়ুন- ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়নের সময় বেঁধে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী, কথা সুন্দরবনে মাস্টার প্ল্যান নিয়েও
