‘ভূতনাথ রিটার্নস’, উৎপল সিনহার কলম 

উৎপল সিনহা

সাহিব নজর রাখনা ,

মৌলা নজর রাখনা

তেরা করম সবকো মিলে

সবকি ফিকর রাখনা ।

( চলচ্চিত্র : ভূতনাথ রিটার্নস ,

কণ্ঠ : ঋতুরাজ , কথা : মুন্না ধীমান , সুর : রাম সম্পথ )

 

হে প্রভু , হে দীননাথ ,

দয়া করে একটু দেখো

সবার জন্য তোমার করুণা

কৃপাকণাটুকু রেখো ।

দয়া করে একটু দেখো ,

তোমার ক্ষমা থেকে কেউ যেন বঞ্চিত না হয় । মানুষের রিক্ত , শুষ্ক , কঠোর জীবনে তুমি করুণাধারায় এসো । তোমার আশীর্বাদ যেন পুষ্পবৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে মানুষের চেতনায় । বিচারের পক্ষপাতহীনতায় সকলের জীবন যেন সুন্দর ও শান্তিময় হয়ে ওঠে ।

না আদমি কি আদমি

ঝেলে গুলামিয়াঁ

না আদমি সে আদমি

মাঙে সালামিয়া

যো ফর্ক পয়দা হো রহে

বো ফর্ক গর্ক হো

সবকো বরাবর বাঁট ইয়ে

ধরতি ইয়ে আসমা

কোই ভি না হো দর্দ মে

সবকি খবর রাখনা ।

কেউ কারোর দাসত্ব করবে না । কেউ কাউকে স্যালুট জানাতে বাধ্য থাকবে না । কেউ কারোর কাছে কোনো অবস্থাতেই নতজানু হবে না । বৈষম্যের অবসান হোক । সাম্য ও মৈত্রী আসুক । এই আকাশ , এই মাটি সকলের । এখানে সবার সমান অধিকার। হে দীননাথ , এই পৃথিবীর সকল সম্পদ সকলের মধ্যে সমানভাগে ভাগ করে দাও । কৃপা করে তুমি খেয়াল রেখো , কারোর জীবনে কোনো দুঃখ যেন না থাকে ।

সব সর উঠাকে চল সকেঁ

সব কো ইয়ে বল মিলে

কোই কিসি আওয়াজ কো

দাতা কুচল না দে

ইয়াহাঁ কাম ভি সবকো মিলে

আরাম ভি সবকো

মেহনত করে যো আদমি

মেহনত কা ফল মিলে

হর বোল পে হর বাত পে

আপনা অসর রাখনা ।।

মাথা উঁচু করে চলুক সবাই ।

অটুট থাকুক মনোবল । কোনো স্বর যেন চাপা না পড়ে ।‌ সবার কাজ জুটুক , সবাই বিশ্রাম পাক । মানুষ পরিশ্রমের ফল পাক । হে সাহিব , হে মৌলা , সব কথায়, সমস্ত কাজে যেন তোমার প্রভাব , তোমার স্পর্শ থাকে ।

অসামান্য এই গান নাড়া দেয় সংবেদনে । আর সিনেমায় এ গানের দৃশ্যায়ন তেমনই মর্মস্পর্শী । ফুটপাথ ও বস্তিঘেরা দরিদ্র ভারতের ছবি। মধ্যরাত , সবাই ঘুমিয়ে পথের ধারে । নিত্যদিনের জীবনযুদ্ধে পরিশ্রান্ত , বিধ্বস্ত। মাথায় ছাদ নেই , অনিকেত । কিন্তু ভোর আসে নিয়মমাফিক । শুরু হয় আবার লড়াই , খাবার জন্য লড়াই । এরা সবাই জানে অনির্বচনীয় হুণ্ডি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে । ১৪০ কোটির দেশে অধিকাংশই চূড়ান্ত বৈষম্যের শিকার । স্বাধীনতার à§­à§© বছর পরেও তারা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই । বরং আরও জটিল হয়েছে জাল , বেঁচে থাকাটাই এখন প্রধান সমস্যা। ‘ সাহিব নজর রাখনা ‘ গানের দৃশ্যায়ন তাই অনিবার্যভাবেই অবিস্মরণীয়। গানটি যতটা শোনার , তার চেয়েও অনেক বেশি দেখার ।

গানের প্রিল্যুড শুরু হয় বিভিন্ন খবরের কাগজের শিরোনাম দেখিয়ে । সঙ্গে ভূতনাথের কৌতুহলী মুখ । দারিদ্র , সন্ত্রাস , দুর্নীতি , শিশুশ্রম , ধর্ষণ ইত্যাদি সব খবর । ভালো খবর নেই ।গান আরম্ভ হয় । দেখি একটি দুর্গত শিশুর বিপন্ন মুখ , তার নিচে ইংরেজিতে লেখা , ‘ The ugly face of poverty’ , তারপর দেখা যায় টিনের একচালা ঘরে নিম্নবিত্ত বাবা ও ছেলে , একটু দূরে মলিন পোশাক পরা ছোট্ট দিদির কোলে আরও ছোট্ট ভাইটি রাস্তার পাশে ।

আরও পড়ুন- বাংলা জুড়ে ভাইফোঁটা উদযাপন, সোশ্যাল মিডিয়ায় শুভেচ্ছাবার্তা পোস্ট মুখ্যমন্ত্রীর

মাত্র আড়াই মিনিটের একটা গান দেখায় গোটা দেশের আসল ছবিটি । পক্ষপাতহীন ক্যামেরা , নির্মোহ দৃষ্টি । রাতের ঘুমন্ত ফুটপাথ , বেঘর কিশোরবেলা , ঘুমন্ত মুখে মশা , মাছি , পোকামাকড় , আহা এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ! দেখি সরকারের হাসপাতালে নাকেমুখে নল ঢোকানো যত্নহীন বার্ধক্য । ফুটিফাটা চাষের জমিতে বসে থাকা প্রাপ্তবয়স্কের হাত কিশোরের কাঁধে , চৌচির ধমনী নিয়েও অবিনশ্বর আশ্বাস । কিছুটা দূরে নির্জনপথে আগুন জ্বালিয়ে বসে আছেন কে একজন ।‌ দেখি খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে কাদা এক বুড়ি মা । মাথায় বোঝা নিয়ে কোথায় যায় কিশোরী ?  স্কুল নেই ওর ? এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে ? রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে ? এই যে প্রচার করা হয় , শিশুশ্রম নাকি অপরাধ ! একি ঢক্কানিনাদ ? কুয়ো ঘিরে প্রচুর মানুষ ! কেন ?

স্কুল ব্যাগ নিয়ে মেয়ে চলছে মায়ের সঙ্গে স্কুলের পথে । এদের বোধহয় পাকা বাড়ি আছে । দেখি উদ্বেগে রাঙা চোখ , শিশুরা জল সেঁচে চলেছে জলাশয়ে । রেললাইনের ওপর বসে কাজ করছে শ্রমিকরা । দেখা যায় পুতিগন্ধময় ধাপার অনেকটা ওপরে উঠে কি যেন খুঁজছে একটি বিপন্ন মুখ । এইভাবে বাঁচে মানুষ ! এটা একটা দেশ ? শিশুরা এইভাবে বাঁচে কোনো দেশে ? শৈশবের কোনো আদর নেই , কোনো আপ্যায়ন নেই , কোনো ভবিষ্যৎ নেই ।‌ যৌবনের কোনো অভিষেক নেই । কোনো অভ্যর্থনা নেই । কোনো কান্তিময় আলো নেই কাছে অথবা দূরে ! বিপুল এক অন্ধকারে ঢাকা প্রৌঢ়ত্ব , বার্ধক্য । কী হবে এই দেশটার ? মানবজীবনের এমন নির্মম অপচয় বোধহয় এই দেশেই সম্ভব , এই ভারতবর্ষে । এই ভারত প্রকৃতই অভিভাবকহীন , অনিকেত , অনাথ!