
এইমাত্র হেমলক পান করে এলেন , আবার চললেন হেমলক পান করতে …খালাসিটোলা শাসন করা এই আশ্চর্য মানুষটি কে ? ইনি আর কেউ নন , এক এবং অদ্বিতীয় কমলকুমার মজুমদার । মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করা চার বোহেমিয়ান যুবকের এবং আরও অনেক কবি ও শিল্পীর গুরু এই কমলকুমার । বাংলা আধুনিক কবিতার পত্রিকা কৃত্তিবাস-এর অন্যতম জনক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন , কমলকুমার তাঁর শিষ্যদের ওয়েলিংটনের মোড়ে হেমলক পান করতে শেখান । ” Kamalkumar knows all the arts” , বলেছিলেন সত্যজিৎ রায় ।

সাহিত্য , সিনেমা , নাটক কিংবা ভাস্কর্য , কমলকুমার মজুমদারের অসামান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার শিল্প ছিল সর্বগ্রাসী ও সর্বব্যাপী । তবে এতসবের পরেও তিনি কোথাও যেন থেকে যেতেন সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে এক নির্লিপ্ত সন্ন্যাসীর মতো ।

উইট , হিউমার , শানিত ব্যঙ্গ আর তির্যক বাক্যবন্ধ নিয়ে হাজার ইন্টেলেকচুয়ালদের ভিড়েও স্বতন্ত্র কমলকুমার ।তাঁর গদ্যশৈলী প্রকৃতই দলছুট । কেউ বলে দুরুহ , কেউ বলে দুষ্পাঠ্য , কেউ বলে দুর্বোধ্য । আবার কেউ বা বলেন তিনি লেখকদের লেখক ।

” আলো ক্রমে আসিতেছে । এ নভোমন্ডল মুক্তোফলের ছায়াবৎ হিম নীলাভ । আর অল্পকাল গত হইলে রক্তিমতা প্রভাব বিস্তার করিবে , পুনর্বার আমরা , প্রাকৃতজনেরা , পুষ্পের উষ্ণতা চিহ্নিত হইব । ক্রমে আলো আসিতেছে । ” এইরকম কয়েকটি বাক্যবন্ধ ব্যবহার করে একটি উপন্যাস শুরু করার কথা কে কবে ভাবতে পেরেছেন ?


আলো আসছে নয় , আলো আসবে নয় , আলো এসে গেছে নয় , এমনকি অন্ধকার ক্রমে কেটে যাচ্ছে নয় , উনি লিখছেন , ” আলো ক্রমে আসিতেছে “, অর্থাৎ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে আলো । প্রথমেই কারোর মনে হতে পারে আলো কমে আসছে । কিন্তু তা তো নয় , ” ক্রমে ” আসছে । অমোঘ বাক্যবন্ধ । ( অন্তর্জলী যাত্রা )


কমলকুমার স্কুলে তো নয়ই , কোথাও মন বসাতে পারতেন না শৈশবে । কিছুটা বড়ো হয়ে ওঠার পরেও তাঁর এই ‘ হেথা নয় , হেথা নয় ‘ ভাব কাটে নি। কখনও সেতার শিখছেন , কখনও আঁকা , কখনও কাঠ খোদাই করে ছবি তৈরি করছেন , ফরাসি ভাষা শিখছেন , আবার কখনও সংস্কৃত ভাষা নিয়ে নিমগ্ন । তাঁর তুল্য প্রজ্ঞা সেকালে কেন , একালেও প্রায় দুর্লভ ।

কমলকুমার ছিলেন প্রকৃতই এক স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পী । মদ্যপ , ঠোঁটকাটা , বাউন্ডুলে , নাকউঁচু ইত্যাদি বিশেষণে তথাকথিত নিন্দিত এই মানুষটির সঙ্গে তর্কে জেতা একপ্রকার অসম্ভব ছিল সেকালে । ‘ দ্য রিভার ‘ ছবির শুটিং করতে কলকাতায় এসে বিখ্যাত জাঁ রেনোয়া মুগ্ধ হয়েছিলেন কমলকুমার মজুমদারের সান্নিধ্যে । তিনি বলে গেছেন , কমলকুমারের মতো ব্যক্তিত্ব বঙ্গভূমে সম্ভবত দ্বিতীয় কেউ নেই । এও বলে যান , কমলকুমারকে তিনি ভুলতে পারবেন না ।

আটপৌরেপনা পুরোদস্তুর বজায় রেখেও এক আশ্চর্য রূপকল্পময় মায়াবাস্তবের অবতারণা তাঁর লেখা ছোটগল্পগুলোকে আজও সজীব করে রেখেছে । বস্তুত কমলকুমার চেষ্টা করে গেছেন ‘ অভাষা ‘ দিয়ে ভাষার সাবালকত্ব আনার । আপাত দুর্বোধ্যতা ও কিঞ্চিৎ যতিহীনতার আড়ালে ভাষার এক ছন্দোময় লালিত্যের চর্চা তিনি করে গিয়েছেন আমৃত্যু।

” … কোথাও এখনও মায়া রহিয়া গেল ” , শুধু এটুকু দিয়ে কমলকুমারের দর্শন বোঝা যাবে না কিছুতেই । রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্যের অঙ্গনে যেসব লেখকদের মাথায় তুলে বাঙালি নাচে , তাঁদের পাশ কাটিয়ে নীরবে একাকী গঙ্গাতীরে অপেক্ষমান থাকলেন কমলকুমার , আধুনিকতার ডিঙিনৌকো কবে আসবে , সে আশার অনিঃশেষ অন্তর্জলী যাত্রায় ।
স্থির ভাষাকে হাঁটাতে চাইলেন যিনি, ভাষা দিয়ে চিন্তা করার পথ খুলে দিয়ে গেলেন যিনি , বিমূর্তকে মূর্ত এবং মূর্তকে বিমূর্ত করার সাধনায় কেটে গেল যাঁর সারাটা জীবন , সেই অনন্য কমলকুমার মজুমদারের ঠিকঠাক মূল্যায়ন কি আজও করতে পেরেছি আমরা ? কোথায় গেলে পাওয়া যাবে এই প্রশ্নের উত্তর ?

আরও পড়ুন – বিরোধীদের প্রতিবাদ, দেশজুড়ে বিক্ষোভ সত্ত্বেও ওয়াকফ সংশোধনী বিলে সই রাষ্ট্রপতির

_