ভার্চুয়াল টাইম ট্রাভেল: ঐতিহ্য সংরক্ষণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব


ডঃ দীপ্র ভট্টাচার্য

১৮ এপ্রিল দিনটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস’ হিসেবে। পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া স্থাপত্য, শিল্পকলা, ভাষা ও সংস্কৃতির নিদর্শনগুলোকে সম্মান জানাতেই এই দিনের সূচনা। সময়ের সাথে সাথে এই ঐতিহ্যগুলি যেমন ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনি এগুলো আজ নানা হুমকির মুখে। জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, নগরায়ণ কিংবা অবহেলার কারণে বহু স্থাপত্য ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে এক নতুন আশার আলো হয়ে এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI।

আজকের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধু স্বাস্থ্য, ব্যবসা বা যোগাযোগ ব্যবস্থাতেই নয়, বরং ইতিহাস সংরক্ষণেও এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছে। এ যেন প্রযুক্তির হাত ধরে অতীতে ফিরে যাওয়ার এক ভার্চুয়াল যাত্রা—এক প্রকার “Virtual Time Travel”। এবার আসুন দেখা যাক কীভাবে এই প্রযুক্তি আমাদের অতীতকে ভবিষ্যতের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করছে।

প্রথমেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নজর দেয়া যাক। ইতালির বিখ্যাত পম্পেই নগরী, যা বহু শতাব্দী আগে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ধ্বংস হয়ে যায়, সেখানে AI ও ৩ডি স্ক্যানিং প্রযুক্তির মাধ্যমে পুরো নগরীকে ভার্চুয়ালভাবে পুনর্গঠন করা হয়েছে। এখন বিশ্ববাসী ঘরে বসেই এই শহরের প্রতিটি অলিগলি ঘুরে দেখতে পারে। এমনকি ঐতিহাসিক বিশেষজ্ঞরাও প্রাচীন বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা বিশ্লেষণ করতে পারেন এই প্রযুক্তির সাহায্যে।

আরেকটি চমৎকার উদাহরণ ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স বেসিলিকা। Microsoft-এর সহযোগিতায় এই গির্জাটির ৪০০,০০০-রও বেশি ছবির ভিত্তিতে একটি ডিজিটাল টুইন তৈরি করা হয়েছে, যা শুধু দর্শনার্থীদের ভার্চুয়াল ভ্রমণের সুযোগই দেয় না, বরং ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণের কার্যকর উপায়ও বটে। এই ডিজিটাল রূপ আমাদের নিশ্চিত করে যে, ভবিষ্যতের প্রজন্ম যদি কোনো কারণে আসল স্থাপনাটি দেখতে না পায়, তবুও তারা তার নিখুঁত রূপ উপলব্ধি করতে পারবে।

এই রকম আরও একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্প হলো গুগল আর্টস অ্যান্ড কালচারের “ওপেন হেরিটেজ” উদ্যোগ, যেখানে পৃথিবীর নানা ঐতিহাসিক স্থান যেমন মেক্সিকোর টিওটিহুয়াকান বা কম্বোডিয়ার আংকর ওয়াটকে ডিজিটালভাবে সংরক্ষিত করা হচ্ছে। ড্রোন, লেজার স্ক্যান ও AI প্রযুক্তির সমন্বয়ে তৈরি হচ্ছে তাদের পূর্ণাঙ্গ ৩ডি মডেল। এটা শুধু পর্যটন নয়, গবেষণা ও পুনঃসংরক্ষণেও বিপুল সহায়তা করছে।

এবার ফিরি আমাদের নিজেদের দেশে—ভারতের দিকে। মহারাষ্ট্রের অজন্তা গুহা, যা বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত, সেখানে AI ব্যবহার করে চিত্রকলাগুলোর ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি করা হয়েছে। সাপিও অ্যানালিটিক্স নামক একটি প্রতিষ্ঠান ‘Ancient AI’ নামে এক প্রকল্পের মাধ্যমে এই কাজ করছে। হাজার বছরের পুরনো এই বৌদ্ধ চিত্রকলাগুলোর রং ও নকশা এখন নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠছে কম্পিউটারের পর্দায়। এই ডিজিটাল রূপগুলোর এক কপি নরওয়ের ‘আর্কটিক ওয়ার্ল্ড আর্কাইভে’ সংরক্ষিত রাখা হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য, যা সত্যিই এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

পশ্চিমবঙ্গের কথাও বলা যাক। মেদিনীপুর জেলার একটি ছোট্ট গ্রাম, পাথরা। এখানকার বাসিন্দারা এবং আইআইটি খড়গপুরের গবেষকরা একত্রে প্রায় ৩৫০টিরও বেশি পুরাতন হিন্দু ও জৈন মন্দিরের ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় AI ও জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঐতিহ্যগুলোকে নথিভুক্ত করা হয়েছে। আজ এই গ্রামটি শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, বরং ভারতের ডিজিটাল হেরিটেজ সংরক্ষণের এক অনন্য উদাহরণ।

এই সব উদাহরণ থেকে স্পষ্ট যে, AI কেবল ছবি তোলা বা ডেটা সংরক্ষণেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি এখন ইতিহাস বিশ্লেষণ, পুনর্গঠন, ভাষান্তর এবং এমনকি বিলুপ্তপ্রায় ভাষার সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। UNESCO এর তথ্যমতে, প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। AI-এর সাহায্যে এইসব ভাষাকে রেকর্ড করা, বিশ্লেষণ করা ও পুনরুদ্ধার সম্ভব হচ্ছে।