
মোর কোনো জাতি নাই
মোর কোনো ধর্ম নাই
মোর কোনো ভগবান নাই
মই মুক্ত
ময়েই কাঞ্চনজংঘা …

জাত-ধর্ম-ভগবান না মানা দামাল বেপরোয়া জুবিন গর্গের মহাজীবন হঠাৎই থেমে গেল মাত্র ৫২- য় !
সমাজ , বন্ধুবান্ধব , আত্মীয়-স্বজন ও রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে গেছেন বারবার , কিন্তু নিজের একান্ত বিশ্বাস থেকে , মতাদর্শগত অবস্থান থেকে একচুলও সরেন নি আমৃত্যু ।

তাঁর শবযাত্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ ! ভাবা যায় ! একজন গায়কের জীবন কি এতটা বড়ো ? এত মূল্যবান ? এত গুরুত্বপূর্ণ ?

হ্যাঁ , এতটাই । তবে সব জীবন নয় । কোনো কোনো জীবন । ঠিক যেমন , সব মরণ নয় সমান । কোনো কোনো জীবন সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায় মৃত্যুকে । যেমন জুবিন-জীবন । লিমকা বুক অফ রেকর্ডস-এ লেখা রইলো এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস । লোকপ্রিয় জুবিন গর্গের শেষযাত্রায় বিশ্বের চতুর্থ সর্ববৃহৎ জনসমাগম দেখলো সারা পৃথিবী । অসমের গুয়াহাটিতে ।

১৫ লক্ষ মানুষ ! অসমীয়া , হিন্দি , বাংলা এবং আরও নানা ভাষায় অসংখ্য গান গেয়েছেন তুমুল জনপ্রিয় এই শিল্পী । হঠাৎ করেই জীবন থেমে না গেলে আরো কত অসামান্য গান যে গাইতেন এই মরমী শিল্পী !

নক্ষত্রের মৃত্যু নিয়ে কবিতা লিখে গেছেন জীবনানন্দ । আমরা স্বচক্ষে দেখলাম নক্ষত্র পতন ।

নিজের মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে বোধহয় ভালো লাগতো তাঁর । বলতেন ,’ আমি যখন মারা যাবো , দেখবে সারা অসম আমার জন্য পথে নামবে ‘ । সেই মরণযাত্রায় গাওয়া হবে কোন গানটি , তাও ঠিক করে দিয়ে যান তুমুল জনপ্রিয় জুবিন ।

‘ ধুমুহাব স’তে মোব
বহুদিন বে নাচোন …’
ঝড়ের সঙ্গে নাচে পা মেলাচ্ছি আমি বহুদিন ধরে …
জুবিনও কি ঝড়ের কাছে রেখে গেলেন নিজের ঠিকানা ?

বড়ো আদরে , বড়ো যত্নে নিজের বাড়ির সামনে একটা পাইন গাছ লাগিয়েছিলেন গায়ক । সেই গাছকে বুকে জড়িয়ে গল্প করতেন তিনি ।

সবাইকে বলতেন , ‘ এই গাছ যেদিন মারা যাবে , আমিও সেদিন মারা যাবো ‘ । আর , নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস ! ঝড়ে উপড়ে গেছে কিছুদিন আগেই সেই গাছ ।
তাহলে আর কেনই বা থামবে না এক ঝোড়ো জীবন ?
এভাবেই বুঝি কথা রাখতে হয় , শিল্পী ?
যোরহাটে আত্মীয়-বন্ধুরা এখন জুবিনের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন । সেই খ্যাপা কিশোরের দিনভর তুমুল দামালপনা , গাছে ওঠা , মাছ ধরা , আর রুটি-সিমুই প্রেম ঘুরেফিরে আসছে ছবির মতো ।
সাদা খাতা জমা দিয়েছিলেন বি এস সি পরীক্ষায় । বিরক্ত অধ্যক্ষ সঙ্গে সঙ্গে তলব করেন অমনোযোগী ছাত্রকে। কারণ জানতে চান । অবাধ্য ছাত্রের জবাব শুনে অবাক অধ্যক্ষ । ‘ ওসব আমার জন্য নয় স্যার । আমি গান লিখি , সুর করি , গান গাই ‘ ।
অধ্যক্ষ জানতে চান , এতে কি পেট ভরবে ?
জবাব পান পরের বছর । জুবিনের ‘ অনামিকা ‘ অ্যালবাম সুপারহিট হয় ।
জিরো থেকে হিরো হয়ে ওঠেন ছাত্র । তারপর ?
সেই কলেজছুট ছাত্রই কলেজের সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রধান অতিথি ! পাশের আসনে সেই অধ্যক্ষ । কিন্তু এবার তিনি সেই সাদা খাতা জমা দেওয়া ছাত্রের কৃতিত্বে রীতিমত গর্বিত ! এই বেপরোয়া আত্মবিশ্বাসের নাম জুবিন গর্গ । এই দলছুট ভাবনার নাম জুবিন গর্গ । জুবিন এক স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও উন্মাদনার নাম ।
গোটা অসম শোকস্তব্ধ । শোকাচ্ছন্ন সারা দেশের সঙ্গীত ও সংস্কৃতি মহল । অসমে যেন সর্বাত্মক বনধ চলছে । স্কুল-কলেজের পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়েছে ।
অফিস কাছারি বন্ধ । রাজ্যে ঘোষিত হয়েছে তিনদিনের জাতীয় শোক । একজন গায়ক , শিল্পীর জন্য এতকিছু ? ভাবতেও ভালো লাগে ।
কিন্তু জুবিনের এই হঠাৎ চলে যাওয়া যেন কাঁটার মতো বিঁধে আছে সঙ্গীতপ্রেমীদের বুকে । এই মর্মান্তিক অকাল মৃত্যু মেনে নেওয়া বড়ো কঠিন । তাঁর মৃত্যু নিয়ে গাফিলতি , খবর চেপে রাখা ইত্যাদি অভিযোগ উঠেছে । সি আই ডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে অসম সরকার । জুবিনের মৃত্যুতে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন অনেকেই ।
গানের অনুষ্ঠান করতে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন জুবিন। সেখানেই সকালে স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়েন ৫২ বছর বয়সী গায়ক । তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায় নি।
জুবিনের বোন জংকি মারা যান ২০০২ সালে তেজপুরে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় । তিনিও ছিলেন সুগায়িকা । সেই শোক সামলাতে না পেরে নাকি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন জুবিন । বছর তিনেক আগে মাথায় গুরুতর চোট পাওয়ার পর থেকেই গায়কের শরীর ভেঙে যায় । তাঁর মৃগী রোগ ছিল । কিন্তু এসবের পরেও তাঁর বেপরোয়া ও উদ্দাম জীবনযাত্রায় ভাঁটা পড়ে নি ।
নেশা থেকেও মুক্তি পান নি ।
সিঙ্গাপুরের অনুষ্ঠান আয়োজকদের কাছ থেকে জানা যায় যে , জুবিন একটা নৌকা ভাড়া করে সিঙ্গাপুরের একটি দ্বীপে যান । সেখানে সাঁতার কাটতে গিয়ে নাকি তাঁর খিঁচুনি ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয় । তা আর সামলে উঠতে পারেন নি শিল্পী । অবশ্য তদন্ত সম্পূর্ণ না হলে মৃত্যুর মূল কারণ জানা যাবে না ।
স্কুবা ডাইভিং হলো জলের নীচে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার সরঞ্জাম ব্যবহার করে ডাইভিং করা । এটি একটি বিনোদনমূলক জলক্রীড়া । ঠোঁটকাটা জুবিন ছিলেন চিরদিনের এক বিতর্কিত বর্ণময় চরিত্র । অসম্ভব ডাকাবুকো। একাধারে গায়ক , গীতিকার , সুরকার ,
অভিনেতা , পরিচালক , প্রযোজক এবং সমাজসেবী ছিলেন এই প্রতিভাধর মানুষটি । ছিলেন অত্যন্ত মানবিক । পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার । অন্তত ১২ ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতেন তিনি । তাঁর ভক্তরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না এই অকাল প্রস্থান ।
আরও পড়ুন – ”মায়ের স্নেহভরা মুখের উন্মোচনে আলোকিত হয় জগৎ”, মহাষষ্ঠীর শুভেচ্ছা অভিষেকের