Thursday, December 11, 2025

অন্তহীন জুবিন, উৎপল সিনহার কলম 

Date:

Share post:

Utpal Sinha

মোর কোনো জাতি নাই
মোর কোনো ধর্ম নাই
মোর কোনো ভগবান নাই
মই মুক্ত
ময়েই কাঞ্চনজংঘা …

জাত-ধর্ম-ভগবান না মানা দামাল বেপরোয়া জুবিন গর্গের মহাজীবন হঠাৎই থেমে গেল মাত্র ৫২- য় !
সমাজ , বন্ধুবান্ধব , আত্মীয়-স্বজন ও রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে গেছেন বারবার , কিন্তু নিজের একান্ত বিশ্বাস থেকে , মতাদর্শগত অবস্থান থেকে একচুলও সরেন নি আমৃত্যু ।

তাঁর শবযাত্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ ! ভাবা যায় ! একজন গায়কের জীবন কি এতটা বড়ো ? এত মূল্যবান ? এত গুরুত্বপূর্ণ ?

হ্যাঁ , এতটাই । তবে সব জীবন নয় । কোনো কোনো জীবন । ঠিক যেমন , সব মরণ নয় সমান । কোনো কোনো জীবন সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায় মৃত্যুকে । যেমন জুবিন-জীবন । লিমকা বুক অফ রেকর্ডস-এ লেখা রইলো এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস । লোকপ্রিয় জুবিন গর্গের শেষযাত্রায় বিশ্বের চতুর্থ সর্ববৃহৎ জনসমাগম দেখলো সারা পৃথিবী । অসমের গুয়াহাটিতে ।

১৫ লক্ষ মানুষ ! অসমীয়া , হিন্দি , বাংলা এবং  আরও নানা ভাষায় অসংখ্য গান গেয়েছেন তুমুল জনপ্রিয় এই শিল্পী । হঠাৎ করেই জীবন থেমে না গেলে আরো কত অসামান্য গান যে গাইতেন এই মরমী শিল্পী !

নক্ষত্রের মৃত্যু নিয়ে কবিতা লিখে গেছেন জীবনানন্দ । আমরা স্বচক্ষে দেখলাম নক্ষত্র পতন ।

নিজের মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে বোধহয় ভালো লাগতো তাঁর । বলতেন ,’ আমি যখন মারা যাবো , দেখবে সারা অসম আমার জন্য পথে নামবে ‘ । সেই মরণযাত্রায় গাওয়া হবে কোন গানটি , তাও ঠিক করে দিয়ে যান তুমুল জনপ্রিয় জুবিন ।

‘ ধুমুহাব স’তে মোব
বহুদিন বে নাচোন …’
ঝড়ের সঙ্গে নাচে পা মেলাচ্ছি আমি বহুদিন ধরে …
জুবিনও কি ঝড়ের কাছে রেখে গেলেন নিজের ঠিকানা ?

বড়ো আদরে , বড়ো যত্নে নিজের বাড়ির সামনে একটা পাইন গাছ লাগিয়েছিলেন গায়ক । সেই গাছকে বুকে জড়িয়ে গল্প করতেন তিনি ।

সবাইকে বলতেন , ‘ এই গাছ যেদিন মারা যাবে , আমিও সেদিন মারা যাবো ‘ । আর , নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস ! ঝড়ে উপড়ে গেছে কিছুদিন আগেই সেই গাছ ।
তাহলে আর কেনই বা থামবে না এক ঝোড়ো জীবন ?
এভাবেই বুঝি কথা রাখতে হয় , শিল্পী ?

যোরহাটে আত্মীয়-বন্ধুরা এখন জুবিনের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন । সেই খ্যাপা কিশোরের দিনভর তুমুল দামালপনা , গাছে ওঠা , মাছ ধরা , আর রুটি-সিমুই প্রেম ঘুরেফিরে আসছে ছবির মতো ।

সাদা খাতা জমা দিয়েছিলেন বি এস সি পরীক্ষায় । বিরক্ত অধ্যক্ষ সঙ্গে সঙ্গে তলব করেন অমনোযোগী ছাত্রকে। কারণ জানতে চান । অবাধ্য ছাত্রের জবাব শুনে অবাক অধ্যক্ষ । ‘ ওসব আমার জন্য নয় স্যার । আমি গান লিখি , সুর করি , গান গাই ‘ ।

অধ্যক্ষ জানতে চান , এতে কি পেট ভরবে ?
জবাব পান পরের বছর । জুবিনের ‘ অনামিকা ‘ অ্যালবাম সুপারহিট হয় ।

জিরো থেকে হিরো হয়ে ওঠেন ছাত্র । তারপর ?

সেই কলেজছুট ছাত্রই কলেজের সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রধান অতিথি ! পাশের আসনে সেই অধ্যক্ষ । কিন্তু এবার তিনি সেই সাদা খাতা জমা দেওয়া ছাত্রের কৃতিত্বে রীতিমত গর্বিত ! এই বেপরোয়া আত্মবিশ্বাসের নাম জুবিন গর্গ । এই দলছুট ভাবনার নাম জুবিন গর্গ । জুবিন এক স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও উন্মাদনার নাম ।

গোটা অসম শোকস্তব্ধ । শোকাচ্ছন্ন সারা দেশের সঙ্গীত ও সংস্কৃতি মহল । অসমে যেন সর্বাত্মক বনধ চলছে । স্কুল-কলেজের পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়েছে ।

অফিস কাছারি বন্ধ । রাজ্যে ঘোষিত হয়েছে তিনদিনের জাতীয় শোক । একজন গায়ক , শিল্পীর জন্য এতকিছু ? ভাবতেও ভালো লাগে ।

কিন্তু জুবিনের এই হঠাৎ চলে যাওয়া যেন কাঁটার মতো বিঁধে আছে সঙ্গীতপ্রেমীদের বুকে । এই মর্মান্তিক অকাল মৃত্যু মেনে নেওয়া বড়ো কঠিন । তাঁর মৃত্যু নিয়ে গাফিলতি , খবর চেপে রাখা ইত্যাদি অভিযোগ উঠেছে । সি আই ডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে অসম সরকার । জুবিনের মৃত্যুতে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন অনেকেই ।

গানের অনুষ্ঠান করতে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন জুবিন। সেখানেই সকালে স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়েন ৫২ বছর বয়সী গায়ক । তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায় নি।

জুবিনের বোন জংকি মারা যান ২০০২ সালে তেজপুরে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় । তিনিও ছিলেন সুগায়িকা । সেই শোক সামলাতে না পেরে নাকি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন জুবিন । বছর তিনেক আগে মাথায় গুরুতর চোট পাওয়ার পর থেকেই গায়কের শরীর ভেঙে যায় । তাঁর মৃগী রোগ ছিল । কিন্তু এসবের পরেও তাঁর বেপরোয়া ও উদ্দাম জীবনযাত্রায় ভাঁটা পড়ে নি ।

নেশা থেকেও মুক্তি পান নি ।

সিঙ্গাপুরের অনুষ্ঠান আয়োজকদের কাছ থেকে জানা যায় যে , জুবিন একটা নৌকা ভাড়া করে সিঙ্গাপুরের একটি দ্বীপে যান । সেখানে সাঁতার কাটতে গিয়ে নাকি তাঁর খিঁচুনি ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয় । তা আর সামলে উঠতে পারেন নি শিল্পী । অবশ্য তদন্ত সম্পূর্ণ না হলে মৃত্যুর মূল কারণ জানা যাবে না ।

স্কুবা ডাইভিং হলো জলের নীচে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার সরঞ্জাম ব্যবহার করে ডাইভিং করা । এটি একটি বিনোদনমূলক জলক্রীড়া । ঠোঁটকাটা জুবিন ছিলেন চিরদিনের এক বিতর্কিত বর্ণময় চরিত্র । অসম্ভব ডাকাবুকো। একাধারে গায়ক , গীতিকার , সুরকার ,

অভিনেতা , পরিচালক , প্রযোজক এবং সমাজসেবী ছিলেন এই প্রতিভাধর মানুষটি । ছিলেন অত্যন্ত মানবিক । পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ‌। অন্তত ১২ ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতেন তিনি । তাঁর ভক্তরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না এই অকাল প্রস্থান ।

আরও পড়ুন – ”মায়ের স্নেহভরা মুখের উন্মোচনে আলোকিত হয় জগৎ”, মহাষষ্ঠীর শুভেচ্ছা অভিষেকের

spot_img

Related articles

হাইকোর্টে স্বীকৃতি এসএসসির যুক্তি! চাকরিতে বহালদের ‘যোগ্য’ স্বীকৃতি 

স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) নতুন নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় হাইকোর্ট মঙ্গলবার সরকারি পক্ষের যুক্তি মানল। আদালতে সরকারি আইনজীবী কল্যাণ...

দীর্ঘ পাঁচ মাস পর বাংলাদেশ থেকে দেশে ফিরলেন কাকদ্বীপের ৪৭ মৎস্যজীবী 

দীর্ঘ পাঁচ মাসের কারাবন্দির পর অবশেষে বুধবার দেশে ফিরলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপের ৪৭ জন মৎস্যজীবী। ফ্রেজারগঞ্জ উপকূল...

বনগাঁ পুরসভা: আস্থা ভোটের আগেই পদত্যাগ করলেন পুরপ্রধান গোপাল শেঠ

বনগাঁ পুরসভায় চেয়ারম্যান গোপাল শেঠ অবশেষে পদত্যাগ করেছেন। নভেম্বরের শুরুতে দলের নির্দেশে পদত্যাগের কথা বলা হলেও তিনি তা...

মানুষকে বল বানিয়ে ক্যাচ-ক্যাচ খেলতেন! মহাকাশের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন শুভাংশু 

কলকাতায় ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্সে শহরের স্কুল-কলেজের ছাত্রদের সামনে মহাকাশে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন ভারতের দ্বিতীয় নভোচারী...