
” পাশের মানুষটা থেকে তুমি নিঃশব্দে সরে পড়ো আর গলা ফাটাও: হিংস্রতা থেকে আমাদের পৃথিবীটাকে মুক্ত করুন। ”
একি! এ তো আমাদের দৈনন্দিন ভণ্ডামির মুখোশ ধরে টান !
তাহলে এবার একটা ভাস্কর চক্রবর্তী হয়ে যাক।
একটা মেহেদী হাসান হোক, তারপর আসুন গুলাম আলি।
একটা লতা মঙ্গেশকর হয়ে যাক, তারপর কিশোর কুমার। একটা পাবলো নেরুদা হোক এবার, তারপর শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সবই ঠিক আছে। কিন্তু ভাস্কর চক্রবর্তী! মানে, মৃত্যু নিয়ে লেখাপড়া?

আহা, শুধুই মৃত্যু দেখলে বন্ধু , শুধুই শিরা ছেঁড়া রক্তপাত? ঘোর আঁধারের আনাচে কানাচে চকমকি পাথরের মতো পড়ে থাকা টুকরো টুকরো আগুন-জীবন দেখতে পেলে না? আমাদের তো একটাই ভাস্কর চক্রবর্তী, মাত্র একটা, তাই না!

” দুই দীর্ঘশ্বাসের মধ্যিখানে মৃত্যু , আমি তোমাকে জন্মাতে দেখেছি। ” আর মৃত্যুকে যাঁরা জন্মাতে দেখেন তাঁদের সম্ভবত শীতকাল খুব পছন্দের।
” শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা
আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকবো —
প্রতি সন্ধ্যায় কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে —
আমি চুপ করে বসে থাকি — ”

এই কবিতা এখনও শেষ হয়নি। কখনও, কোনদিনও শেষ হবে না। যেমন শেষ নেই প্রেমের , ভালোবাসার, দীর্ঘশ্বাসের, অন্ধকারের , তেমনই অন্তহীন এই কবিতা। শুধু প্রেমিকার মতো জীবনের হাত ছুঁয়ে থাকে মৃত্যু। কারুবাসনা বারবার নষ্ট করে দিয়ে যায় জীবনের সমস্ত সফলতা, এমনকি কবিকেও।

” পৃথিবীর সমস্ত পুকুর পাড়ের সরু রাস্তার পাশে
একটা লম্বা গাছ ,
অকারণে, দাঁড়িয়ে থাকে —
তোমার পাশে আমি
দাঁড়িয়ে থেকেছি সেইরকম –”

জীবনানন্দ দাশের
” স্থবিরতা, তুমি কবে আসিবে বলো তো” লেখাটি বুঝি খুব ভালো লেগেছিল ভাস্করের!
” গতানুগতিক দিন
গতানুগতিক রাত
আসে আর যায়।
দুপুরে নীরব চারাপোনা
রাত্রিবেলা ফিরোজা বেগম।
এই তবে ? আর কিছু নেই ?
ভালোবাসা বলে কিছু নেই ?
ভালোবাসা, কোন দেশে তুমি।”
তাই বুঝি ভালোবাসার কাঙাল কবির এই আকুল আবেদন:
” আমার এ হাত আমি
বাড়িয়ে দিয়েছি —
যদি ভালবাসা থাকে,
মানুষের মতো যদি হও,
টান দাও, বাজুক সেতার । ”

শঙ্খ ঘোষ লিখে গেছেন ,
পড়ে আছে বাজনা,
ফিরে গেছে বাজনার হাত।

রবি ঠাকুর লিখেছেন,
আছে তো হাতখানি।
বাড়ানো হাত কোনদিন ফিরিয়ে নেন নি ভাস্কর।
ভালোবাসাকাতর হাতে লিখেছেন এক অমোঘ সত্য।
” ঠিক সময়ে ঠিক কথা বলার দাম এক টাকা
ঠিক সময়ে চুপ করে থাকার দাম দু’টাকা । ”

তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছেন:
” প্রেমিকেরা একদিন স্বামী হয়। স্বামীরা তারপর আর প্রেমিক থাকে না। অথচ ওমলেট খায়, ফিসফ্রাই খায়… ”

আসলে বাংলা কবিতাকে নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করতে চেয়েছিলেন ভাস্কর কবি। পেরেছেনও অনেকটাই। তিনি চেয়েছিলেন , ” সজ্জিত হয়ে উঠুক জীবন ” । তিনি ভুলতে চেয়েছেন, ” রুক্ষতা আর আলপিন দিয়ে সাজানো সব কণ্ঠস্বর ” । মিথ্যের দাপট তাঁর সহ্য হয় না। দীর্ঘশ্বাসের থেকেও লম্বা তাঁর জীবনটাকে তিনি শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছিলেন সম্ভবত নতুন করে বেঁচে ওঠার আশায়।
” আরেক পাড়ায় গিয়ে
ঘর বাঁধবো এবার সুন্দরী
যে পাড়ায় শ্বাসকষ্ট নেই ” ।
লিখেছেন,
” যখনই মৃত্যুর কথা মনে পড়ে,
ইচ্ছে করে সিগারেট ধরাই। ”
যেদিন সত্যিই মৃত্যু এসে ডেকে নিয়ে গেল ভাস্করকে , যেদিন সত্যিই চিতায় উঠলেন কবি , আর যখন তিনি পুড়ছেন, শেষবারের মতো তাঁর চিতার আগুনের ওপর এক প্যাকেট সিগারেট দিয়ে এসেছিলেন কবি মৃদুল দাশগুপ্ত। সিগারেট ছাড়া ভাস্করের যাওয়া যে মানায় না। সিগারেটে আসক্ত কবি বারবার তাঁর কবিতায় নিয়ে এসেছেন প্রিয় সিগারেট প্রসঙ্গ।
” আমি বোধহয় সিগারেট খাওয়ার জন্যেই বেঁচে আছি ” ।
আরোও লিখেছেন,
” যদিও, অজানা নয় আমার কাছে , শেষ সিগারেটের দিন কী দ্রুতই না ঘনিয়ে আসছে।”
কবি ভাস্করের শেষ কাব্যগ্রন্থের শেষ পংক্তিটা বড়ো বেদনার মতো বাজতে থাকে দশকের পর দশক:
” চলে যেতে হয় বলে চলে যাচ্ছি ,
না হলে তো আরেকটু থাকতাম। ”
আরও পড়ুন – এগিয়ে থেকেও অধরা ট্রফি, শিল্ড ঘরে তুলল মোহনবাগান