Friday, November 28, 2025

তারাসুন্দরীর মঞ্চে ম্যাজিক দেখালেন গার্গী

Date:

Share post:


কুণাল ঘোষ
বাংলার নাট্যমঞ্চে ইতিহাসের পাতাকে পুনরুজ্জীবিত করেই এক নতুন ইতিহাস লেখা হল। লিখলেন অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরী (Gargi Raychowdhuri), জি ডি বিড়লা সভাঘরে একক অভিনয়ে তারাসুন্দরীকে হাজির করে। ইতিহাসের পাতায় উপেক্ষিত এক প্রতিভাকে যেন নতুন করে আবিষ্কারের মাধ্যমে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিলেন আজকের এক শিল্পী। তারাসুন্দরী আমার কাছে এক বিস্ময়মাখা আকর্ষণীয় চরিত্র এবং যেহেতু গার্গীকে আমি এই সময়ের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী মনে করি, তাই নাটক দেখতে যাওয়াটা জরুরি ছিল। দেখার পর একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে লিখছি, গার্গী সফল। এক, অভিনয়ে সফল। দুই, তারাসুন্দরীকে চর্চায় ফেরাতে সফল।

সংবাদ প্রতিদিন কাগজে নাটকের প্রিভিউ লিখেছিলাম। সেখানে প্রাধান্য পেয়েছিল উপেক্ষিত তারাসুন্দরীর কাহিনি। আর দেখার পর রিভিউ, সেখানে মূল আলোচ্য তারাসুন্দরীর ভূমিকায় গার্গী। আমি অভিনয় (Acting) বিশেষজ্ঞ নই। অভিনয়ের দর্শক। তাতে এটুকু বলতে পারি তারাসুন্দরীর প্রাণপ্রতিষ্ঠায় গার্গী বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি কত উঁচু মানের অভিনেত্রী। তারার জীবনের প্রতিটি শেড, ভাঙাগড়া, ট্র্যাজেডি কমেডিকে অনায়াস সাবলীলতায় গার্গী মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন।

একক অভিনয়। কঠিন। এক ঘণ্টা আঠারো মিনিট একটানা গোটা হলের দর্শকের চোখ ধরে রাখা কম কথা নয়। গার্গী পেরেছেন। তারাসুন্দরী এবং তাঁরই সঙ্গে একাধিক চরিত্র হয়ে ওঠা; সেকেন্ডের ভগ্নাংশে দুই আলাদা চরিত্রে আলাদা মেজাজের কথোপকথন; মসৃণতায় পোশাকবদল; নাটকীয়তার মুহূর্তের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, গার্গী একশোয় একশো। তারা সুন্দরীর কখনও দাপট, কখনও বিষাদ, কখনও প্রেম, কখনও স্বপ্ন, কখনও স্বপ্নভঙ্গ, গার্গী একা মঞ্চে অভিনয়শিল্পকে নতুনদের কাছে আদর্শ ওয়ার্কশপে পরিণত করেছেন- এটাও করা যায়! তারার একদা অভিনীত চরিত্রগুলির ঝলক আবার ফেরাতে গিয়ে গার্গীকে কতরকম রূপে পারফরম করতে হয়েছে, সেটাও দেখার মত। মঞ্চে ম্যাজিক দেখালেন শিল্পী। সংলাপ, বাংলা ভাষার তৎকালীন উচ্চারণ ও শব্দপ্রয়োগ অসাধারণ। বৃটিশ সাহিত্যধর্মী নাটকের সময় ইংরেজি পড়তে না জানা তারার শুনে শুনে ইংরেজি (English) ভাষায় অভিনয়, ওই দৃশ্যটার জন্য গার্গীর পুরস্কার পাওয়া উচিত। গানেও অনবদ্য গার্গী। মাঝেমধ্যেই ওই গান নাটককে জীবন্ত করে রেখেছে।

আসলে তারাসুন্দরী এক ব্যতিক্রমী উপেক্ষিত চরিত্র।বঙ্গরঙ্গমঞ্চে যখন কার্যত সামাজিক বিপ্লব করছেন গিরীশ ঘোষ, তখন অন্ধকার জগত থেকে আলোয় এসে যে কজন নারীচরিত্র পতিতা থেকে অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন, সেই তালিকার শীর্ষে নটি বিনোদিনী। তাঁকে নিয়ে আলোচনা, সিনেমা (Cinema), নাটক (Drama), সাহিত্যচর্চা হয়েছে বারবার, যুগে যুগে। বিনোদিনীর আলোয় ঢাকা পড়ে থেকেছেন তাঁরই সহযোদ্ধা আরও কয়েকজন। তাঁদের কয়েকজনের নাম অবশ্য বিনোদিনীচর্চার আবর্তে পরিচিত হয়েছে। কিন্তু তাঁরা আলাদা করে আলোচ্য হয়ে ওঠেননি। আমার মতে এই তালিকারই উজ্জ্বলতম নাম তারা, মঞ্চের তারাসুন্দরী। এবং কিছু ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভা, সাফল্য, যন্ত্রণা, জীবনপথ, দর্শন যেন ছাপিয়ে গিয়েছে স্বয়ং বিনোদিনীকে; তবু, বাঙালী তারাসুন্দরীকে চর্চার কেন্দ্রবিন্দু রাখার চেষ্টা করেনি।

কীভাবে আমি তারার ভক্ত হলাম বলি। বন্দিজীবনে আমি তখন প্রেসিডেন্সি জেলে। ‘পূজারিনী’ উপন্যাসটি লেখার সময় এই বিষয়টি নিয়ে পড়াশুনোর দরকার পড়ে। জেলের লাইব্রেরির অতি পুরনো অথচ দারুণ প্রবন্ধধর্মী বই, বাইরে থেকে আনানো বিশেষ কিছু তথ্য থেকে বিনোদিনীর আরও বিস্তারিত জানলাম। কিন্তু যেন পরিচয় হল তারাসুন্দরীর সঙ্গে। আমার উপন্যাসটিতে যতটা পেরেছি রেখেছি। পরে আরও সমৃদ্ধ হয়েছি ব্রাত্য বসুর (Bratya Basu) লেখা পড়ে।

আমি যেভাবে বুঝেছি তারাসুন্দরীকে, তাঁর চলার পথ ভারি বিচিত্র। তিনি হয়ত বিনোদিনীর থেকেও সুন্দরী, অভিনয়ে আরও ধারালো। একটা সময়ে প্রচার ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা বিনোদিনী নিজে তারাকে সামনে আনাতে উদ্যোগী ছিলেন। বিনোদিনীর তুফানতোলা চৈতন্যলীলাতে বিনোদিনী নিমাই, তারা সেখানেই বালক নিমাই, শৈশবচরিত্রে। চৈতন্যলীলার পর ফের নিমাই সন্নাসী। গিরীশ ঘোষ থেকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব যে আলোকবৃত্ত, বিনোদিনীর সূত্রেই সেখানে তারার যোগাযোগ শুরু। পরে, তারাসুন্দরীর মুঠোয় যখন গ্ল্যামার, বাবুদের চোখ যখন তারার উপর, মঞ্চে তারা সুপারহিট, তখন এই বিনোদিনীই তারাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে আচরণ পাল্টে ফেলেন। তারার উত্থানেই তাঁর অবসান, এমন অস্তিত্বের লড়াই, ধার এবং ভারের ছায়াযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। দুই নারীর তখন এক জটিল সমীকরণ। তারার চন্দ্রশেখর, শৈবলিনী, অযোধ্যার বেগম, আয়েষা, রিজিয়া- পরপর সফল নাটক। তাঁর একচোখে জল, এক চোখে ক্রুরতা, ঠোঁটে হাসি; অসামান্যা অভিনেত্রী তারা। ইংরেজি পড়তে পারতেন না। স্রেফ শুনে ক্লিয়োপেট্রা, ডেসডিমোনার চরিত্র করতেন, সেই আমেজ আর মেজাজে। নাম, যশ, অর্থ তাঁর মুঠোয়। এসেছে বারবার প্রেম, হাতছানি দিয়েছে। মন ভেঙেছে। তারপর বিয়ে হয়েছিল বা হয়ত হয়নি আরেক নাট্যকর্মী অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে, যিনি বিবেকানন্দভক্ত। শিকাগোজয়ের পর কলকাতা ফেরা, ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়া খুলে স্বামীজিকে টেনে আনলেন যুবকবৃন্দ, তার মধ্যে থাকা এই অপরেশ সেদিন ভিড়ে চোট পেয়ে শয্যাশায়ীও ছিলেন। তারাসুন্দরীর জীবনে অনেক ভাঙাগড়া। ছেলের অকালমৃত্যুর পর হঠাৎ সব ছেড়ে আধ্যাত্মিকতায় সমর্পণ। নিজের সব অর্জিত অর্থ দিয়েছিলেন আশ্রম গড়তে, ভুবনেশ্বরে। তৈরি করেছিলেন ‘রাখালকুঞ্জ’। গিরীশ ঘোষের অনুরোধে আবার মঞ্চে ফেরা। তারপর মৃত্যু। এখানে সবিস্তার লেখার নয়, কিন্তু তারাসুন্দরীর অভিনয়প্রতিভা, কিছুটা লেখালেখি, জীবনদর্শন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর ‘প্রবাহের রূপান্তর’ অবাক হওয়ার মত। বিনোদিনীর মত তারাকেও অন্ধকার থেকে আলোয় আসার যুদ্ধ করতে হয়েছে। তিনিও গিরীশবৃত্ত, রামকৃষ্ণদেব, দক্ষিণেশ্বর, বিবেকানন্দ, নাট্যমঞ্চে ঠাকুরের পদার্পণ দর্শনে সমৃদ্ধ, প্রভাবিত। বঙ্গরঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে মহিলা শিল্পীদের শুরুর দিনে নটি বিনোদিনী যদি উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হন; তাহলে তারাসুন্দরীও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য থাকার কথা, অথচ তিনি কার্যত উপেক্ষিতা। পাহাড় ভাঙার গান প্রথম সাফল্যের সঙ্গে বিনোদিনীই গেয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই; তবে সেই আকাশকে বৃহত্তর ব্যাপ্তি দিতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন তারা।

গার্গীর একক নাটক অনবদ্য। অভিনয়দক্ষতা আকাশছোঁয়া। একবার নয়, বারবার দেখার। তবে নাট্যরূপ এবং চিত্রনাট্য নিয়ে আমার সামান্য বক্তব্য আছে। এক, এত চরিত্রকে আনা হয়েছে, অথচ রামকৃষ্ণদেব নেই? কেন? তারা ঠাকুরকে মঞ্চে আসতে দেখেছেন, দক্ষিণেশ্বরেও গেছেন, শৈশব থেকেই। পরে গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। রামকৃষ্ণদেব ও তারার পর্বটি নাটকে থাকলে গার্গী বিষয়টিকে অন্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে যেতে পারতেন বলে আমি মনে করি। দুই) বিনোদিনীর তারার প্রতি স্নেহ, পরে ছায়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা; এই দ্বিতীয় পর্বের নাটকীয়তা ফুটিয়ে তোলার সুযোগ গার্গীকে দেওয়া উচিত ছিল। তিন) শেষে আধ্যাত্মিকতার প্রতি সমর্পণ, এটা আরও স্পষ্ট করার অবকাশ ছিল। চিত্রনাট্যকার এই তিনটি জায়গায় তিনরকম অভিনয়ের সুযোগ গার্গীকে করে দিলে বোধহয় আরও বৈচিত্র স্পর্শ করা যেত।

তবে যা হয়েছে, তাই বা কম কী! গার্গী রায়চৌধুরী এই ইতিহাসে উপেক্ষিতাকেই ফেরানোর দায়িত্বপালন করছেন। বিনোদিনীকে নিয়ে একাধিক নাটক, সিনেমা দেখেছি। আবার বলছি, বিনোদিনীর ভূমিকায় এখনও পর্যন্ত আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে রামকমল মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে রুক্মিণী মৈত্রকে। সেটা বড় পর্দায়। এবার মঞ্চে, একক অভিনয়ে তারাকে নিয়ে এলেন গার্গী। আমার নিজের বিশ্লেষণে, গার্গী দক্ষ অভিনেত্রী; সৌন্দর্য, গ্ল্যামার, আভিজাত্য এবং মেধামিশ্রিত বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থিতির এক সংযমী সংবেদনশীল শিল্পী। তিনি যে তারাসুন্দরীকে তাঁর অভিনয়ের জন্য বেছে নিয়েছেন, সেটাই প্রশংসার। রেডিও, বড় পর্দা, ছোট পর্দা, মঞ্চ, যাত্রা, অভিনয়ের সব মাধ্যমের অভিজ্ঞতার সম্পদ উজাড় করে গার্গী গড়ে তুলেছেন তারাসুন্দরীকে। নেপথ্যে অভিভাবকোচিত ভূমিকায় ব্রাত্য বসু। সঙ্গে নাট্যকাঠামো ( ব্রাত্যর বই থেকে), সঙ্গীত, পোশাকে উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক রায়েরা। মঞ্চ সৌমিক-পিয়ালী। নাচের গাইড সুকল্যাণ ভট্টাচার্য। গার্গী পরম যত্ন আর চরম সাধনায় আজ তারাসুন্দরী হয়ে উঠেছেন। নিজেকে ভেঙেচুরে প্রতিনিয়ত অতীতের পাতার এক অভিমানী নায়িকা হিসেবে নির্মাণ করেছেন। আবহ ও গানের প্রয়োগও দেখলাম সময়ের ছোঁয়ামাখা অনবদ্য, অভিনেত্রী গাইলেনও দারুণ। প্রিভিউতে লিখেছিলাম, বঙ্গরঙ্গমঞ্চে জীবন উৎসর্গ করা ইতিহাসে উপেক্ষিতা যদি ব্রহ্মান্ডের কোনো প্রান্তে থেকে থাকেন ক্ষুধিত পাষাণের বিবর্ণ চেহারায়, তাতে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে আবার প্রাণপ্রতিষ্ঠার পালা। এখন লিখছি, গার্গী এই কাজটি করেছেন অতিদক্ষতার সঙ্গে। এক পূজারিনীর পুজো করতে গিয়ে নিজেও এক আন্তরিক পূজারিনী হয়ে উঠেছেন গার্গী রায়চৌধুরী।

 

spot_img

Related articles

ইচ্ছে মতো নয়, সেমিস্টার পিছু ফি বেঁধে দিল উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ

সেমিস্টারের নামে অতিরিক্ত ফি (Fee) নেওয়াতে রাশ টানতে নির্দেশ দিল উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ (Council Of Higher Secondary...

ফের ভিনরাজ্যে আক্রান্ত বাংলাভাষী শ্রমিক, ওড়িশায় ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে চাপের অভিযোগ বজরং দলের বিরুদ্ধে

ফের বাংলায় কথা বলায় অত্যাচারের শিকার। বিজেপি(BJP)শাসিত ওড়িশায় (Orissa) আক্রান্ত মুর্শিদাবাদের (Murshibad) চার পরিযায়ী শ্রমিকের। বেধড়ক মারের পর...

সীমান্তে কাঁটাতার বসানো নিয়ে কবে রিপোর্ট? রাজ্যকে সময় বেঁধে দিল হাই কোর্ট

বাংলায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতার বসানো মামলায় রিপোর্ট রাজ্যকে দিতে ৭ দিন সময় বেঁধে দিল কলকাতা হাই কোর্ট (Calcutta...

জন্ম শংসাপত্র তৈরিতে আধার গৃহীত হবে না: নির্দেশ জারি মহারাষ্ট্রে!

যে কোনও মূল্যে আধার কার্ডকে  অকেজো করে দিতে তৎপর মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকার। এবার জন্ম শংসাপত্র (birth certificate) তৈরিতে...