সেই সালটা ১৯৭২। এখন ২০২৫। মাঝে পেরিয়েছে ৫৩ বছর। এর মধ্যে তাঁকে ভুলেই গিয়েছে গোটা দেশ। হঠাৎ মনে করালেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি বি আর গভাই (B R Gavai, former CJI)। অথচ তাঁকে যে দেশ ভুলে যেতে পারে ৫০ বছর আগে কেউ সেটা ভাবেইনি। বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্র (Maharashtra) আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল নারীর সম্মান তো দূরের কথা, বেঁচে থাকা নিয়েই কতটা উদাসীন বিজেপির গাল ভরা প্রতিশ্রুতি দেওয়া নেতা-মন্ত্রীরা।
‘মথুরা কেস’ (Mathura case)। এই একটি নামই যথেষ্ট ছিল দেশের নারী সমাজকে উজ্জীবিত করে পথে নামানোর জন্য। পুলিশ হেফাজতে দুই কনস্টেবলের দ্বারা ধর্ষিতা (custodial rape) নাবালিকা গোটা দেশে মথুরা নামেই পরিচিতি পেয়েছিল। বিচার দিতে পারেনি খোদ সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court)। বেকসুর খালাস পেয়েছিল অভিযুক্ত দুই কনস্টেবল (constable)। আর সেখান থেকেই এসেছিল দেশে নারীর অধিকার নিয়ে আন্দোলনে করার জন্য সংগঠন তৈরির চিন্তাভাবনা। বদলের গিয়েছিল দেশের অনেক আইন। যৌন নির্যাতন নিয়ে নতুন নতুন আইন তৈরি হয়েছিল।

প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি বি আর গভাই নিজের মেয়াদকালের শেষদিকে একটি বক্তৃতায় সেই মথুরা কেসের উল্লেখ করেন। স্মরণ করিয়ে দেন, ভারতে নারী নির্যাতন, যৌন নির্যাতনের বীজ কতখানি পুরুষতান্ত্রিকতায় (patriarchal) ডুবে রয়েছে। কিন্তু যাকে ঘিরে এত কথা, এত ভাবনা-আন্দোলন, সেই নাবালিকা যে বার্ধক্যে পৌঁছে গিয়েছেন, তা বোধহয় ভুলে গিয়েছে ৫০ বছর আগে তাঁরই জন্য আন্দোলনে নামা সব মুখ। বাস্তবটা তাই-ই।

প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পরে আচমকাই ফের সেই নির্যাতিতার খোঁজ পড়ে। আর খুঁজতে গিয়ে যা দেখা যায়, তার মতো বেদনার বোধহয় আর কিছুই হয় না।

সেদিনের ১৩ বছরের অনাথ আদিবাসী নাবালিকা আজ ৭২-এর বৃদ্ধা। বয়স বাড়া ছাড়া আর কিছুই বদলায়নি তাঁর জীবনে। সেই অনাথিনীর একাকিত্ব। সেই নির্যাতিতার দারিদ্র। গ্রামের বাইরে এক জোগাড়ু কুঁড়ে। ঘরে খাবার চালটুকুর সংস্থান নেই। তাঁর একাকীত্বে সেই নির্যাতিতা নারীর প্রতি সমাজের বঞ্চনার ছবিটা আজও এক। এতটুকু বদলায়নি। ঠিক যেমন বদলায়নি নাগপুরের (Nagpur) গাচিবোউলি থেকে ১০০কিমি দূরের গ্রামগুলির সমাজ জীবন।

১৯৭২ সালের পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণের (custodial rape) ঘটনায় ১৯৭৯ সালে দুই অভিযুক্ত কনস্টেবল তুকারাম ও গণপতকে বেকসুর খালাস দেয় সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court)। তার আগেই যদিও ধর্ষণের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের চিকিৎসক, যিনি অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন থানায় যা হয়েছে তা নাবালিকার সম্মতিতে। দেশের মহিলারা সংগঠন তৈরি করে নারীর অধিকারের দাবিতে মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু এসবের মধ্যে কোথায় ছিলেন সেই নাবালিকা? তিনি কোথায় কীভাবে জীবন কাটালেন? আদৌ বেঁচে আছেন? গোটা দেশ, সমাজ যেন লজ্জাতেই তাঁর খোঁজ নেওয়া বন্ধ করে দিল।

সম্প্রতি ফ্রান্সে খবরের শিরোনামে এসেছেন গিজেল পেলিকোট (Gisele Pelicot)। ৫১ বছরের পেলিকোট নিজের ধর্ষকদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রকাশ্যে এসেছেন। ধর্ষিতা হওয়া যে এক নারীর লজ্জা নয়, গোটা পৃথিবীতে বুক চিতিয়ে তা-ই প্রমাণ করে দিতে গিজেলের লড়াইয়ে সামিল হয়েছে তাঁর পরিবারও। যদিও পেলিকোটও দাবি করেন, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে আজও বদলায়নি পৃথিবীটা। গিজেলের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাঁর পরিবার ছিল, আছে। কিন্তু ‘মথুরা’র তো কেউ ছিল না। আজও তাই সে একা।

আরও পড়ুন : বুধেই ভাগ্য নির্ধারণ! বাংলাদেশে বসে ফেরার অপেক্ষায় অন্তঃসত্ত্বা সোনালি

কিন্তু সমাজ, পরিবার যে নারীকে ব্রাত্য করেছে, তাঁর পাশে দাঁড়ানোর কর্তব্য কী ছিল না রাষ্ট্রের? রাষ্ট্রও কখনও সেই পথে হাঁটেনি। তাই আজ গ্রামের বাইরে একার কুঁড়েতে খাদ্যহীন। পৌঁছায়নি কোনও সরকারি সাহায্য। পান না কোনও সরকারি ভাতা (allowance)। ১৯৭২ সালের কথা বললে তিনি বিরক্ত হন। তাঁর বড় প্রশ্নই যে – কী খাবেন। যা হয়ে গেছে, তা হয়ে গেছে। কিন্তু যা আছে, তা নিয়ে কীভাবে বাঁচবেন, আজও সেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ‘মথুরা’।

তবে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির এই ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেন কিছুটা হলেও আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে একাকিনী বৃদ্ধার জীবনে। সংবাদ মাধ্যম ফের তাঁকে নিয়ে নাড়াচাড়া করায় সজাগ হয়েছে দেবেন্দ্র ফাড়নবিশ (Devendra Fadnavis) প্রশাসন। তাঁর কাছে এবার পৌঁছাবে সরকারি ভাতা। স্বাস্থ্যের দেখাশোনা করার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে মহারাষ্ট্রের বিজেপি প্রশাসন।


