টেনিদা যখন গড়গড়ির নলটা মুখে পুরে বসে আছে , আর সিন্ধুঘোটক যেন ‘ অর্ডার অর্ডার ‘ বলে চেঁচাচ্ছে , আলু চচ্চড়ির মতো মুখ করে বসে আছে কম্বলরাম, সিন্ধুঘোটক শুধু বলে , ‘ অর্ডার অর্ডার , ভুল সব ‘ !
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ” টেনিদা আর সিন্ধুঘোটক” – এর সিন্ধুঘোটক চরিত্রটি বড়ই আজগুবি আর একইসঙ্গে ভীষণ মজারু। আবার জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পাওয়া যায় সিন্ধুসারস , যার বরফের মতো শাদা ডানা দুটি আকাশের গায় ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়। তবে বাস্তবের সিন্ধুঘোটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এরাই পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী, যাদের পুরুষেরা গর্ভধারণ করে। পুরুষ সিন্ধুঘোটক জন্ম দেয় সন্তানের।
পুরুষের গর্ভধারণের কথা উঠলেই চলে আসে ‘ সি- হর্স ‘ – এর কথা। সি-হর্স হলো এক ধরনের সামুদ্রিক মাছ। আকারে ছোট এই মাছের মাথা অনেকটা ঘোড়ার মতো দেখতে। তাই এদের এমন নামকরণ করা হয়েছে। এদের খণ্ডিত হাড়ের বর্ম, খাড়া ভঙ্গি এবং বাঁকা লেজ রয়েছে। হিপ্পোক্যাম্পাস গণের অন্তর্গত এরা। এই মাছগুলো গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে থাকে। এদের প্রজননের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো পুরুষ সি-হর্স ডিম থেকে বাচ্চা ফোটায় এবং প্রসব করে। সামুদ্রিক ঘোড়া বা সিন্ধুঘোটক এদেরকেই বলা হয়ে থাকে। স্ত্রী সি-হর্স পুরুষ সি-হর্সের পেটের থলিতে ডিম পাড়ে এবং পুরুষটি ডিম নিষিক্ত করে। পুরুষের ভ্রুণধারণ এবং প্রসব প্রাণীজগতের অন্যতম অনন্য ঘটনা। প্রসবকালে একসঙ্গে একাধিক বাচ্চা বেরোতে পারে। সময় লাগে একঘন্টা কিংবা তারও বেশি সময়। প্রসবকাল সাধারণত রাত্রি। জন্মের পরপরই সেইসব নবজাতকেরা স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে শুরু করে। বাবার গর্ভে বেড়ে ওঠা এই বাচ্চারা প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় এক আশ্চর্য চমক। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, একটি সামুদ্রিক ঘোড়ার মৃত্যুর পর, পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে বাকি সঙ্গীদের আচরণ পাল্টে যায়, এমনকি মৃত্যু হওয়া বিরল নয়।
এছাড়া রয়েছে পাতাযুক্ত সমুদ্র ড্রাগন। এই প্রজাতির পুরুষেরাও গর্ভধারণ করে এবং সন্তানের জন্ম দেয়। মিলনের সময় স্ত্রী ড্রাগন পুরুষের লেজের নীচের দিকে একটি বিশেষ ব্রুড প্যাচ-এ ১০০ থেকে ২৫০ টি ডিম পাড়ে, যেখানে তাদের নিষিক্ত করা হয়। আগাছা সমুদ্র ড্রাগন-সহ তিন ধরনের সামুদ্রিক ড্রাগন রয়েছে।
এবার পাইপ ফিস নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। ‘ পাইপ ফিস ‘ একটি লম্বা ও সরু মাছের প্রজাতি, যা দেখতে অনেকটা পাইপের মতো এবং এদের সি-হর্স-এর আত্মীয় হিসেবে গণ্য করা হয়। এদের মুখ নলের মতো। এদের দাঁত নেই। এদের প্রজনন প্রক্রিয়াও বেশ অদ্ভুত। স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছের থলিতে ডিম রেখে যায় এবং পুরুষ মাছ সেই ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর কাজটি করে বড়ো যত্ন ও সতর্কতার সঙ্গে। সাপের শারীরিক গঠনের সঙ্গে এদের শরীরের কিছুটা মিল পাওয়া যায়। এদের বাস প্রধানত ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে। এরা সাধারণত প্রবাল প্রাচীর বা সামুদ্রিক ঘাসের তলদেশে বসবাস করে। সাঁতার কাটার ক্ষমতা কম থাকায় প্রায়শই অগভীর জলে চলে আসে পাইপফিস। এই পাইপফিসের ব্রুড প্যাচ-এ একটি ভেন্ট্রাল সেলাই থাকে, যা সিল করা হলে তাদের সমস্ত ডিম ঢেকে দিতে পারে সম্পূর্ণভাবে। পাইপফিস প্রজাতির সহবাসের ঠিক আগে তাদের পারস্পরিক ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে নৃত্য প্রদর্শন চলতে থাকে এবং সেই অদ্ভুত আনন্দনৃত্য সমাপ্ত হয় সহবাসের মধ্য দিয়ে। স্ত্রী মাছ তার ডিম একটি ছোট ডিম্বাশয়ের মাধ্যমে পুরুষ মাছের গর্ভথলিতে স্থানান্তর করে। এই সময়ে পুরুষ মাছ ‘ S ‘ আকৃতির ভঙ্গি ধারণ করে এবং ডিমগুলোকে নিষিক্ত করে। ব্রুড থলিযুক্ত পুরুষ মাছগুলো তাদের শুক্রাণু সরাসরি সেগুলোর মধ্যে ছেড়ে দেয়। তারপর থলিগুলোকে জোরে জোরে ঝাঁকানো হয় অর্থাৎ নাড়াচাড়া করা হয়। জন্মানোর পর বাচ্চারা স্বাধীনভাবে সাঁতার কাটতে সক্ষম হয় এবং তারা তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য গ্রহণ করতে শুরু করে। ভূমিষ্ঠ সন্তানদের পুষ্টি , অক্সিজেন সরবরাহ এবং শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার দায়িত্ব পালন করে পুরুষ পাইপফিস। এক্ষেত্রে নারী পাইপফিসেরা অভিভাবকের সমস্ত দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে পুরুষদের কাঁধে চাপিয়ে পরম নিশ্চিন্তে জলে ভেসে বেড়ায়।
আরও পড়ুন- ড্রোন শোয়ে নয়া আকর্ষণ গঙ্গাসাগর মেলায়! প্রস্তুতি পরিদর্শনে দুই মন্ত্রী
_
_
_
_
_
