রাহুল বোস
২০২৫ সালটি ভারতীয় ক্রীড়ায় ক্রান্তিকাল। এই সময়টির সংজ্ঞা কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক আঙিনায় জিতে আনা (যদিও মনোভাব অটুট রাখতে ও জোরদার করতে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ) পদকের সংখ্যা দিয়ে স্থির করা সম্ভব নয়। খেলাধুলোর প্রতি সমগ্র দেশের দৃষ্টিভঙ্গীকে সুনির্দিষ্ট প্রণালীর মাধ্যমে অধিকতর ইতিবাচক করে তোলার বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নীতিগত সংস্কার এবং পরিকাঠামো প্রসারের কাজ শুরু হয়েছে জোরকদমে এবং তা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এমন একটি ভিত্তির নির্মাণের লক্ষ্যে, যা ভারতীয় ক্রীড়া প্রতিভার ক্রমবিকাশে সহায়ক।

এই বছর সরকার জাতীয় ক্রীড়া নীতি(National Sports Policy) ২০২৫ অনুমোদন করেছে। আন্তর্জাতিক আঙিনায় ধারাবাহিক সাফল্যের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে প্রণীত হয়েছে এই নীতি (ইতিমধ্যেই ভারত ২০৩০ –এ কমওয়েলথ গেমস আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েছে এবং ২০৩৬ –এর অলিম্পিকের আয়োজক দেশ হয়ে ওঠার জন্য জোরদার প্রচেষ্টায় সামিল)। এরপর জাতীয় ক্রীড়া প্রশাসন আইন ২০২৫ কার্যকর হওয়া প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। ভারতীয় ক্রীড়া ক্ষেত্র কিভাবে চালিত হওয়া উচিত তার স্পষ্ট দিশা নির্দেশ রয়েছে ওই আইনে ; সেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের খেয়াল খুশি নয়, স্বচ্ছতা এবং সুনির্দিষ্ট রূপায়ণ কাঠামোর কথা বলা হয়েছে। আইনটি পড়লেই বোঝা যায় যে এখানে অগ্রাধিকারের কেন্দ্রে রয়েছেন অ্যাথলেটরাই। নির্বাচন প্রক্রিয়া, অর্থ সংস্থান, অভিযোগের নিষ্পত্তি – সবক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট বিধি, মাপকাঠি এবং সময়সীমা স্থির করে দেওয়া হয়েছে। এই আইনটির লক্ষ্য, আচমকা সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা দূর করে ক্রীড়াবিদদের মধ্যে আস্থার মনোভাব বৃদ্ধি করা। ছোট শহর বা দুর্গম এলাকায় থাকা খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।

আমার কাছে যা বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় তা হল এই প্রথম সংশ্লিষ্ট আইনটির আওতায় বিপন্মুক্ত ক্রীড়া নীতি গ্রহণ ক্রীড়া সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক – যার সুবাদে মহিলা, অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং অন্য নানা দিক থেকে অসুবিধার সম্মুখীনদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি ন্যায়গত বিধির কথাও বলা হয়েছে। জাতীয় ক্রীড়া পর্ষদের মাধ্যমে নিরপেক্ষ নজরদারি ও দেখভাল এবং সুনির্দিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্রীড়া ট্রাইব্যুনাল সুস্থিতি ও ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের মধ্যে ক্রীড়াবিদ এবং মহিলাদের অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক হওয়ায় বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠনে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকবে। সব মিলিয়ে যেটা বলা যায় তা হল, এইসব পরিবর্তন আন্তর্জাতিক আঙিনায় ধারাবাহিকভাবে ভালো ফল করার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যায্য ও নির্ভরযোগ্য একটি পরিমণ্ডল গড়ে তুলবে অবশ্যই।
খেলাধুলোর বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের কর্মকাণ্ডের দিকে উৎসাহের সঙ্গে তাকিয়ে থাকি আমি। এই মাসেই জোশনা চিনাপ্পা, অভয় সিং এবং অনাহত সিং একযোগে ইতিহাস গড়েছেন – হংকং-কে ৩-০ –য় হারিয়ে ভারত প্রথমবার জিতে নিয়েছে স্কোয়াশ বিশ্বকাপ।

আন্তর্জাতিক আঙিনায় ভারতের এই সাফল্যে নেতৃত্ব দিয়েছেন মেয়েরা। ২০২৫-এর নভেম্বরে ভারত কন্যাদের ক্রিকেট দল আইসিসি মহিলা বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছে। দৃষ্টি বঞ্চিত ভারত কন্যাদের ক্রিকেট দল জিতেছেন তাঁদের প্রথম টি-২০ বিশ্বকাপ।

বিশ্ব বক্সিং কাপ ফাইনাল ২০২৫-এ প্রথমবার অংশ নিয়েই ভারত ৯ টি স্বর্ণ পদক জিতেছে। এশিয়ান যুব গেমস ২০২৫-এ ভারতের সাফল্য এযাবৎ সবচেয়ে বেশি।

দক্ষিণ কোরিয়াকে ফাইনালে ৪-১ গোলে হারিয়ে ভারতের ছেলেরা বিহারের রাজগিরে এশিয়া কাপ ২০২৫-এ সেরার শিরোপা জিতেছেন। ৮ বছর অপেক্ষার পর এই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারত।

১৮ বছরের শীতল দেবী প্যারা–তিরন্দাজিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। এফআইডিই মহিলা বিশ্বকাপে প্রথম ভারতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন দিব্যা দেশমুখ। এদেশেরই দাবাড়ু কোনেরু হাম্পিকে হারিয়ে তিনি এই শিরোপা জিতে নিয়েছেন।

২০২৫-এ ভারতীয় ক্রীড়া জগতের সাফল্যের মধ্যে এক ধরণের বিকেন্দ্রীকরণ রয়েছে – যা খুবই ইতিবাচক। সাফল্য অর্জিত হয়েছে দেশের নানা প্রান্তে, নানা পরিসরে। সম্প্রতি ছেলেদের এফআইএইচ জুনিয়র হকি বিশ্বকাপ হয়ে গেল তামিলনাড়ুতে। গ্রেটার নয়ডায় অনুষ্ঠিত হল বিশ্ব বক্সিং কাপ ফাইনাল। আমেদাবাদে নব নির্মিত বিশ্বমানের বীর সাভারকার স্পোর্টস কমপ্লেক্সে বসেছিল ১১ তম এশিয়ান অ্যাকোয়াটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের আসর।

বিহারের রাজগিরে আয়োজিত হয়েছে এশিয়া রাগবি এমিরেটস ইউ২০ সেভেন্স। তুমুল প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পদক জিতে নিয়েছেন ভারতের মেয়েরা। এশিয়া রাগবি –র প্রেসিডেন্ট বলেছেন, এশিয়া জুড়েই রাগবির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বিহারে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন তারই প্রমাণ দেয়।
রাগবির জনপ্রিয়তা বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ভারতের ক্রীড়া বিপ্লবেরই প্রতিফলন। ২০২৫-এর জুনে প্রথম রাগবি প্রিমিয়াম লিগের আয়োজন হয় মুম্বইয়ে। এই প্রতিযোগিতা বিশ্বের প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি–ভিত্তিক রাগবি ৭ লিগসের মধ্যে পড়ে। শহরভিত্তিক ৬ টি দলে ছিলেন (চেন্নাই বুলস, হায়দ্রাবাদ হিরোজ, মুম্বই ড্রিমার্স ইত্যাদি) স্থানীয় নামজাদা খেলোয়াড়দের পাশাপাশি নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিজি এবং অস্ট্রেলিয়ার ৩০ জন রাগবি স্টার। এই দেশগুলি রাগবির ক্ষেত্রে একেবারে প্রথম সারির। ১৫ জুন লীগের প্রথম ম্যাচে মুম্বইয়ের আন্ধেরি স্পোর্টস কমপ্লেক্সে ছিল উৎসাহী দর্শকের ভিড়। তার সরাসরি সম্প্রচার হয় টেলিভিশন এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। এই সাড়ম্বর সূচনা এতটাই উদ্ভাবনাত্মক ছিল যে, নতুন প্রজন্মের উৎসাহীদের পাশাপাশি স্পনসর এবং সম্প্রচার সংস্থাগুলিও খেলা হিসেবে ভারতে রাগবির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন হয়ে ওঠে। ঠিক একমাস পরে মহাদেশীয় রাগবি প্রতিযোগিতার আয়োজন হয় রাজগীরে।
খেলো ইন্ডিয়া(Khelo India) কর্মসূচির আওতায় শহর থেকে শহরান্তরে বিভিন্ন ধরণের খেলার ফ্র্যাঞ্চাইজি – ভিত্তিক লীগ প্রতিযোগিতা আয়োজনে উদ্যোগী কেন্দ্রীয় ক্রীড়া মন্ত্রক। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে, মেয়েদের এএসএমআইটিএ (অস্মিতা) রাগবি লীগ দেশের বিভিন্ন শহরে এই খেলার প্রতি ভারত কন্যাদের আকর্ষণ অনেক বাড়িয়ে তুলেছে। বেসরকারি ক্ষেত্রের আগ্রহও বাড়ছে। সম্প্রচার সংস্থাগুলি ওটিটির স্বত্ত্ব গ্রহণ করছে এবং স্পনসররা ভারতীয় ক্রীড়া ক্ষেত্রের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে আরও বেশি করে।
এই বছর কেন্দ্রীয় যুব বিষয়ক ও ক্রীড়া মন্ত্রক জাতীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলিকে সহায়তা দান প্রণালীতে আমূল পরিবর্তন করেছে। সুনির্দিষ্ট শর্ত রাখা হয়েছে স্পষ্টভাবে। যেমন, যেসব ক্রীড়া সংস্থার বার্ষিক বাজেট ১০ কোটি টাকার বেশি তাদের পূর্ণ সময়ের হাই-পারফরমেন্স ডিরেক্টর (এইচপিডি) নিয়োগ করতেই হবে প্রক্রিয়াগত নানা কর্মকাণ্ড তদারকির জন্য। প্রতিটি ক্রীড়া সংস্থাকে বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ রাখতে হবে তৃণমূল স্তরে উন্নয়নের জন্য (ছোটদের প্রশিক্ষণ)। বাজেটের অন্তত ১০ শতাংশ রাখতে হবে প্রশিক্ষক এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য। আন্তর্জাতিক স্তরে সাফল্যের সম্ভাবনা রয়েছে এমন অ্যাথলেটদের মাসে পুষ্টিকর খাবার দাবারের জন্য ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, “সান ডেজ অন সাইকেল” –এর মাধ্যমে ফিট ইন্ডিয়া আন্দোলন (আমি অংশ নিয়েছি ২ বার) কেন্রীধ্য় ক্রীড়া মন্ত্রীর সক্রিয় সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের সুবাদে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে জাতীয় স্তরে একটি আন্দেলনের চেহারা নিয়েছে। ভারতীয়দের মধ্যে শারীরিক সচেতনতার বোধ আরও জোরদার করায় তা অত্যন্ত ইতিবাচক উদ্যোগ। আমি আগেও বলেছি এবং এখনও বলব : খেলাধুলো এবং ফিটনেস সামাজিক জীবনযাপনের অঙ্গ হওয়া উচিত। তবেই স্থায়ী এবং ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। ক্রীড়া ক্ষেত্রে উপযুক্ত মানব পরিমণ্ডল গড়ে তুলতেই হবে। আন্তর্জাতিক আঙিনায় স্বর্ণ পদক জয় দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রের সামনে আলোকবর্তিকা অবশ্যই ; কিন্তু সর্বাত্মক ক্রীড়া সংস্কৃতি খেলাধুলোর ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা দেশের দীর্ঘস্থায়ী ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
সংক্ষেপে :
– জাতীয় ক্রীড়া নীতির(National Sports Policy) ৫ টি স্তম্ভ খেলাধুলোর প্রতিটি শাখার সামনে দেশ গঠনে সক্রিয় অংশ নেওয়ার সুযোগ এনে দেয়। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় সাফল্যই শেষ কথা নয়। সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভাব এবং শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সংযোগের বিষয়টিও এসে পড়ে এখানে।
– জাতীয় ক্রীড়া প্রশাসন আইন নিয়ন্ত্রণমূলক কাজকর্মকে আরও যুক্তিযুক্ত ও দক্ষ করেছে।
– জনমুখী নেতৃত্বের ভূমিকা আরও জোরদার করেছে।
– জাতীয় থেকে প্রাদেশিক স্তর পর্যন্ত খেলোয়াড়দের এবং সংশ্লিষ্ট সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এমন বার্তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যাতে ক্রীড়া সংস্থাগুলি এবং স্পনসররা বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
– খেলাধুলোর সময়ে খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা এবং বয়স সংক্রান্ত জালিয়াতি রোধ, বিশেষত রাগবির মতো খেলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি।
– কমনওয়েলখথ গেমস ২০৩০ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজনকারী দেশ হয়ে ওঠায় ভারতীয় ক্রীড়াবিদ, স্পনসর এবং দর্শকরা বিশ্বমানের ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রত্যক্ষ করতে পারছেন আরও বেশি করে।
আগামী দশকে ক্রীড়া শক্তি হিসেবে বিশ্ব তালিকায় দশের মধ্যে ভারতকে দেখতে চায় সরকার। প্রয়োজনীয় ভিত্তি গড়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই। ধারাবাহিকতা, শৃঙ্খলা এবং সাধারণ মানুষের উৎসাহ ধরে রাখতেই হবে। ভারতীয় ক্রীড়া জগৎ ও জনসমাজের কাছে বড় সুযোগ এসেছে এখন। এগিয়ে চলা যাক!


