যারা টাকা দেবে, মিডিয়া তাদের সঙ্গে শোবে। কুণাল ঘোষের কলম।

কুণাল ঘোষ

বেশ্যাদের আমি এতটুকু অসম্মান করি না। কারণ তাঁদের যন্ত্রণার বাধ্যতামূলক দিকটা বিবেচনায় রাখতে হয়।

কিন্তু সংবাদমাধ্যম আর সাংবাদিকতার প্রতি আর বিশেষ কোনো সম্মান বজায় থাকবে না, সেই দিন আর বেশি দূরে নয়।

আমি যখন সক্রিয় মূলস্রোত সাংবাদিকতায়, সেই সময়টাও বাদ দিচ্ছি না। তার বহু আগের থেকেই ধ্বংস হচ্ছে। এবং, এখন তো আমি মূলস্রোতে নেই, এখনও চূড়ান্ত অবক্ষয়।

পাঠকপাঠিকারা মিডিয়াকে নিন্দেমন্দ করেন। কিন্তু আপনাদেরও সমস্যাটা বুঝতে হবে। না হলে গোটা সিস্টেমটা বিশ্বাসযোগ্যতা তো হারাবেই, পুরো লাটে উঠবে।

সাংবাদিকরা কী করেন? কাগজ বা চ্যানেল বা ইদানিং পোর্টাল। আমি মূলত কাগজ আর চ্যানেলের কথাই আলোচনা করছি।

এটা কি সমাজসেবা?
না। এটা পেশা। বহু সংসার জড়িত।

সাংবাদিকরা কার উপর নির্ভরশীল?
মালিকের।

মালিক কি কাগজ বিক্রি করে বা চ্যানেল চালিয়ে টাকা তুলতে পারেন?
না।

তাহলে টাকা আসে কোথা থেকে?
হয় মালিকের অন্য ব্যবসা থেকে ভর্তুকি, অথবা বিজ্ঞাপন।

বিজ্ঞাপন কারা দেয়?
সরকার বা কিছু বেসরকারি সংস্থা।

তাহলে সেই কাগজ বা চ্যানেলকে কীসের উপর নির্ভর করতে হয়?
মালিকের অন্য ব্যবসা বা বিজ্ঞাপনদাতাদের উপর।

সেই মিডিয়া কার কথা বলবে?
যাদের জন্য তাদের বেঁচে থাকা, তাদের কথা বলবে। এটাই স্বাভাবিক।

আজ মিডিয়া এভাবেই ঘেরাটোপে বন্দি। কী আশা করেন?

আগে সাংবাদিকরা ছিলেন স্বাধীন।
এরপর হল সাংবাদিক নয়, সংবাদপত্রমালিক স্বাধীন।
এখন তাঁরাও নয়। নীতি ঠিক হবে বিজ্ঞাপনদাতার মাপকাঠিতে।

বড় থেকে ছোট, সব কটি হাউসের কমবেশি একই হাল।

অতীত দেখুন।বরুণ সেনগুপ্ত প্রণম্য। তাঁকেও ‘বর্তমান’ শুরুর সময় একাধিক রাজনৈতিক নেতার সাহায্য নিতে হয়েছে।
এখনকার পরিস্থিতি দেখুন।অশোক দাশগুপ্ত। আমার দ্রোণাচার্য। তাঁকেও উগ্র বাম বা বুদ্ধপন্থী থেকে উগ্র বিপরীতধর্মী প্রচারক হতে হচ্ছে !

পাঠকের দায় নেই?
আছে।

সব জিনিস আপনারা দাম দিয়ে কেনেন। সবের দাম বাড়ে।
কাগজ আর চ্যানেলের বেলায় পয়সা দিতে কষ্ট হয় !
এখানে দাম কম আর ফ্রির প্রতিযোগিতা।

একটা কাগজ তৈরিতে যা খরচ, তার কিছুই আসে না বিক্রি থেকে। নির্ভর করতে হয় অন্য টাকার উপর। তাদের কথায় চলতে হয়। তাদের কথা বলতে হয়। না হলে কোম্পানিই উঠে যাবে।

আর আপনারা তারপর জ্ঞান দেন সাংবাদিকদের?

একটা কাগজের দাম যদি দশ বা পনেরো টাকা হয়, মাসে খরচ তিনশ থেকে সাড়ে চারশো টাকা।

যদি আপনারা কাগজের যথাযথ মূল্যে কাগজ কেনেন বা চ্যানেলের জন্য খরচ করেন, তাহলে এই হাউসগুলোকে ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে ঘুরতে হয় না। আপনারা সবেতে খরচ করেন। শুধু মিডিয়ার জন্য সস্তার প্রডাক্ট। ফলে আপনারাই হাউসগুলোকে ঠেলে দেন কোনো না কোনো সরকার বা বিজ্ঞাপনদাতা শিল্পগোষ্ঠীগুলোর দিকে।

যাদের কাছ থেকে টাকা আসে, মাইনে হয়, এত পরিবার চলে, তাদের স্বার্থের বাইরে মিডিয়া কথা বলতে পারে না।

আপনারাই তারপর বলেন অমুক মিডিয়া অমুকের লোক। তমুকের লোক।

কিন্তু মিডিয়াকে স্বনির্ভর, বলা ভালো পাঠকনির্ভর করার কোনো চেষ্টা আপনারা করেন কি? করেন না।

ফলে সংবাদ বিক্রি হচ্ছে। কলম বিক্রি হচ্ছে। ভাষ্য বিক্রি হচ্ছে।

সাংবাদিকের কিছু করার নেই। যারা একটু সিনিয়র, তারা টিম বাঁচাতে নেমে কলঙ্কিত হচ্ছেন। বিতর্কিত হচ্ছেন। এবং মালিকরাও বহু ক্ষেত্রে পরিস্থিতির চাপে পড়ে অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কোথাও কর্মিসংকোচন, কোথাও কোনো পক্ষের মুখপত্র হয়ে যাওয়া।

সাংবাদিকরা কাগজ করুন। আপনারা যথাযথ দামে কিনুন। ভালো হলে চলবে। না হলে চলবে না। মিটে গেল। কিন্তু সেক্ষেত্রে পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখানোর একটা লড়াই তো হবে।

জেলাগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। জেলা সাংবাদিকরা এতটা দুরাবস্থায় যে তাদের প্রতি নীতিজ্ঞান শোনানোটা অপরাধের পর্যায়ে চলে গেছে।

সাংবাদিকদের কি দোষ নেই? আছে। মিডিয়া হাউস কি ধোয়া তুলসীপাতা? এখানে কি অযোগ্যরা লবির সৌজন্যে সিংহাসনে বসে থাকে না? থাকে। সব পেশাতেই এসব হয়। কিন্তু মূল সমস্যাটার দিকে তাকানো উচিত।

কেন মিডিয়াজগৎকে পরজীবী থাকতে হবে?
কেন এক নম্বর হাউস আনন্দবাজারেও এত সঙ্কট?
কেন প্রচার ও প্রভাবে ক’বছর আগেও ঊর্ধ্বমুখী থাকা সংবাদ প্রতিদিনকে অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে?
কেন আগমার্কা বামপন্থী আজকাল এখন উগ্র তৃণমূলপন্থী হয়ে গেল?
কেন বর্তমান ভগবান ছাড়াও অনেককে ভয় করতে শুরু করেছে?

টাকার উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে মিডিয়া। পুরোপুরি। চিট ফান্ডের মিডিয়ায় কাজ করেছে অসংখ্য, বিজ্ঞাপন নিয়েছে প্রায় সব হাউস: বলি শুধু আমি, সৃঞ্জয়, সুমনদা। চমৎকার!!

প্রতিনিয়ত বিকৃত হচ্ছে খবর। রোজ প্রতিমুহূর্তে চাপা হচ্ছে কিছু খবর। দেখানো হচ্ছে ততটাই, যা সেই হাউসের আর্থিক মদতদাতাদের স্বার্থ বিঘ্নিত করে না।

মায়ার খেলা চলছে। আর তিলে তিলে বিশ্বাসযোগ্যতার খাদের কিনারে পৌঁছে যাচ্ছে মিডিয়া।

আমি কৈশোর থেকে এই ইন্ডাস্ট্রিতে। আমার মত অনেক পাগলের এটাই সাধনা, এটাই স্বপ্ন। সুনাম, দুর্নাম সব এর থেকেই।

আজ তো আমি মূলস্রোত থেকে দূরে। গত পাঁচ ছ বছরেও কেন এত অবনতি?

এখনও স্বপ্ন দেখি প্রয়াত সুহাস তালুকদারের নেতৃত্বের সেই শুরুর দিনগুলো ফিরিয়ে আনার।
কাগজ হবে। ঝকঝকে না হোক; হবে নিরপেক্ষ, সাহসী। খবর থাকবে খবরের মত করে। পাঠক ইচ্ছে হলে নেবেন। না হলে নেবেন না। আজও মাথা উঁচু করে লড়ে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ সংবাদ। আপস হয়ত কিছুটা আছে। আত্মসমর্পন নেই।

পাঠকপাঠিকা, আপনারা ভাবুন। দায়দায়িত্ব আপনাদেরও। ভালো কাগজ, সিরিয়াস কাগজ, জীবনমুখী কাগজ সঠিক দামে কেনার অভ্যেসটা তৈরি হোক। ভালো লাগলে পুরো দামে কিনুন। না লাগলে কিনবেন না। কিন্তু ভর্তুকির সস্তা দামে কাগজ কিনে নীতির জ্ঞান দেওয়ার অভ্যেসটা বদল হোক।

ভাবতে হবে সকলকে।

অন্যথায় চায়ের টেবিলে এই কটাক্ষ চলতেই থাকবে, যে টাকা দেবে, তার সঙ্গেই শুতে যায় মিডিয়া। তার আবার সম্মান !!