‘নিউটনের ডায়মন্ড’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

“এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে ; — জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা।” ( সপ্তক , সাতটি তারার তিমির , জীবনানন্দ দাশ )

স্যার আইজ্যাক নিউটনের এক পোষা কুকুর ছিল , নাম ডায়মন্ড । বিজ্ঞানী নিউটনের প্রকৃতপক্ষে দুটি কুকুর ছিল , ডায়মন্ড আর গ্রাফাইট । দুটো তো দূরের কথা , মহামতি নিউটন জীবনে কোনদিন কুকুর পোষেন নি । এসব নেহাতই গালগপ্পো ।

তাহলে কি আগুন লেগে নিউটনের বিশ বছরের গবেষণালব্ধ অমূল্য কাগজপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা আদৌ ঘটে নি ?

ব্যাপারটা তাহলে কী ?
আপনভোলা নিউটন টানা বিশ বছর ধরে একটি কাজ করে চলেছিলেন ক্যালকুলাস নিয়ে । কাজটা প্রায় শেষের পথে । এটা সম্পূর্ণ করতে পারলে তাঁর মাধ্যাকর্ষণ সংক্রান্ত তত্ত্বগুলি প্রতিষ্ঠা পাবে ।

সেদিন অনেক রাত হয়ে গেছে। হঠাৎই একটা জরুরি কাজের কথা মনে পড়লো বিজ্ঞানীর । প্রথমে ভাবলেন , থাক , রাত হয়েছে অনেক , কাজটা কালকেও করা যায়। তারপর ভাবলেন আজকেই না করলে কথার খেলাপ হবে।

টেবিলে স্তুপাকার কাগজ , দীর্ঘ গবেষণার বিশ্লেষণ , ফলাফল । মোমবাতি জ্বলছে একটা । মোমবাতিটি না নিভিয়েই বেরিয়ে পড়লেন বিজ্ঞানী । ঘরে রইলো প্রিয় পোষ্য ডায়মন্ড । মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার । ফিরে এসে দেখলেন টেবিলে রাখা মোমবাতির আগুনে পুড়ে গেছে তাঁর গবেষণার সমস্ত কাগজপত্র ।

কীভাবে আগুন লাগলো ? তার মনিব বাইরে যেতেই ঘরময় ছোটাছুটি করতে থাকে ডায়মন্ড । আর তা থেকেই বিপত্তি । বিজ্ঞানী সবই বুঝলেন । তাঁর কুড়ি বছরের সাধনা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । তারপর অবোধ ডায়মন্ডের মাথায় হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করলেন , ” কত বড়ো ক্ষতি তুমি করলে , জানো না ডায়মন্ড ” ।

তখন নিউটনের আরেক পোষ্য গ্রাফাইট কী করছিল ? সে ছিল বাড়ির ঠিক বাইরেই । বেগতিক কিছু দেখলেই চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলতো গ্রাফাইট । ঘরের ভেতরে ডায়মন্ডের চিৎকার শুনে গ্রাফাইটও প্রাণপণে চেঁচাতে থাকে। তা শুনে প্রতিবেশীরা বেরিয়ে এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে থাকেন এবং একসময় আগুন নিভে যায় । কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে ।

অন্য একটি বিবরণ অনুসারে , নিউটন যখন গির্জায় গিয়েছিলেন তখন তিনি একটি জানলা খোলা রেখেছিলেন এবং হঠাৎ আসা এক দমকা ঝড়ে জ্বলন্ত মোমবাতিটা ছিটকে পড়েছিল তাঁর টেবিলের ওপর জড়ো করা রাশিরাশি কাগজের স্তুপে । কারণ , নিউটনের কোনো পোষা কুকুর ছিল না ।

স্যার আইজ্যাক নিউটন জন্মেছিলেন ১৬৪৩ সালের ৪ জানুয়ারি এবং মারা যান ১৭২৭ সালের ৩১ মার্চ । ক্যালকুলাস , অপটিক্স এবং মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের মাধ্যমে তিনি অমর হয়ে রয়েছেন ।

ডায়মন্ড কুকুরের গল্পটি প্রথম প্রচারিত হয় উনবিংশ শতাব্দীতে । এই সময় আরো একটি গল্পও প্রচারিত হয় । নিউটন নাকি বিড়াল ভালোবাসতেন । তিনি নাকি একাধিক বিড়ালের মালিক ছিলেন । শোনা যায় , প্রিয় বিড়ালদের জন্য তিনি দুটি ঘরও বানিয়েছিলেন । একটি ছোট ঘর এবং অন্যটি বেশ বড়ো ।

অন্যমতে , বিড়াল নয় , ঘরদুটি তিনি বানিয়েছিলেন তাঁর দুই পোষ্য গ্রাফাইট ও ডায়মন্ডের জন্য । দীর্ঘ বিশ বছরের সাধনা নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পরেও নিউটন যথেষ্ট শান্ত ছিলেন । অনেকেই বলেন , আগুন লাগার ঘটনাটির সময় তিনি বাইরে একটু পায়চারি করতে বেরিয়েছিলেন । তখন টেবিলে একটা মোমবাতি জ্বলছিল এবং ডায়মন্ড ঘুমোচ্ছিল । ফিরে এসেই আবার কাজ শুরু করবেন এই ভেবেই বাইরে বেরিয়েছিলেন তিনি ।

আগুন লাগার ঘটনায় তিনি চূড়ান্ত হতাশ হয়ে পড়েন । বুঝতে পারেন , পাহাড়প্রমাণ কাজের সমস্তটা আবার নতুন করে শুরু করতে হবে । আবার কাজটা সম্পূর্ণ করতে আরও কত বছর লাগবে তা ভেবে তিনি যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন । কিন্তু বিমর্ষ ও হতাশ হলেও মোটেও ভেঙে পড়েন নি তিনি । কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় কাগজ কিনতে বেরোন তিনি ।

বহু বছরের সাধনার একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে সিদ্ধিলাভের পরিবর্তে তীরে এসে তরী ডোবার মতো এই ঘটনায় তিনি ভীষণ বিচলিত হলেও মনের জোর হারান নি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, ডায়মন্ডের কাজটি বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে পিছিয়ে দিল কুড়ি বছর , একথা যেমন সত্য , ঠিক ততটাই সত্য তাঁর মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে বাইরে যাওয়ার ভুল সিদ্ধান্তটি। এক্ষেত্রে ডায়মন্ডের চেয়ে বেশি দায়ী তিনি নিজে । ডায়মন্ডকে ক্ষমা করেন তিনি । তার মাথায় হাত বুলিয়ে হাহাকার করেন । ডায়মন্ড যে আগুনে পুড়ে মারা যায় নি সেজন্য তিনি মনে মনে খুশিও হন । তারপর নিজের মর্মান্তিক ভুলের প্রায়শ্চিত্য করতে আবার নতুন করে ডুবে যান বিজ্ঞান সাধনায়। এ থেকে একটা সিদ্ধান্তে অবশ্যই আসা যায় , তা হলো , ডায়মন্ড বা গ্রাফাইট গল্প হতে পারে , কিন্তু আগুন লেগে কাগজপত্র পুড়ে যাওয়ার ঘটনাটা সত্যিই ঘটেছিল।

আরও পড়ুন- বাংলাদেশের সাংসদ খুনে নয়া মোড়, বাগজোলা খাল থেকে উদ্ধার ‘মৃতের হাড়’!