ধর্মীয় বিভাজন ও রাজনীতির স্বার্থে ভগবান রামকে কার্যত রাস্তায় নামিয়েছে বিজেপি, এমন অভিযোগ শুধু বিরোধীদের নয়, খোদ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘর। শুধুমাত্র ভোটে জিততে ভগবান রামের নাম বছরের পর বছর ধরে ব্যবহার করে আসছে পদ্ম পার্টি। রামের নামে ভোট ভিক্ষা করে ফুলেফেঁপে উঠেছিল বিজেপি। তবে সদ্য সমাপ্ত লোকসভা ভোটে এবার ভগবান রামের সেই জন্মভূমি অযোধ্যাতে লজ্জার হার হয়েছে বিজেপির। শ্রীরামের জন্মস্থান বলে পরিচিত অযোধ্যা যে লোকসভা কেন্দ্রে অবস্থিত, সেই ফৈজাবাদে বিজেপির পরাজয় নিয়ে দেশজুড়ে জোর চর্চা চলছে। অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণ হওয়া সত্ত্বেও ফৈজাবাদ কেন্দ্রে পরাজয়ের মুখে পড়তে হয়েছে বিজেপি প্রার্থী লাল্লু সিংকে। তিনি প্রায় ৫৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী অবধেশ প্রসাদের কাছে। শুধু অযোধ্যা নয়, গোটা উত্তরপ্রদেশে ভরাডুবি হয়েছে বিজেপির।

তবে বিজেপির এই বিড়ম্বনা শুধুমাত্র অযোধ্যা বা ফৈজাবাদে সীমাবদ্ধ নেই। ‘রাম-কথা’র সঙ্গে জড়িত হিন্দু বিশ্বাসে পবিত্র স্থান বলে পরিচিত আরও বহু জায়গায় জোরদার ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। রামায়ণ মহাকাব্যে উল্লিখিত চিত্রকূটে রামচন্দ্রের বনবাসের প্রথম বছর কেটেছিল। এই চিত্রকূট উত্তরপ্রদেশের বান্দা লোকসভা আসনের অন্তর্গত। সেখানে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী কৃষ্ণাদেবী শিবশঙ্করের কাছে ৭০ হাজারের বেশি ব্যবধানে হেরেছেন বিজেপি প্রার্থী আর কে সিং প্যাটেল। একই অবস্থা যোগীরাজ্যের আরও একটি আসন সীতাপুরেও। কথিত আছে, এই স্থানেই জন্মেছিলেন জনক-কন্যা সীতা। ভগবান রামের জন্মস্থানের মতো সীতামায়ের জন্মস্থানেও বড় পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়েছে বিজেপিকে। এখানে জয়ী হয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী রাকেশ রাঠোর। বিজেপি প্রার্থী রাজেশ ভার্মাকে তিনি হারিয়েছেন ৭০ হাজারের বেশি ভোটে। শ্রীরামের গুরু বশিষ্ঠের ভূমি বলে পরিচিত উত্তরপ্রদেশের বস্তি আসনের ছবিটাও একই। এই আসনে মুখ থুবড়ে পড়েছেন বিজেপি প্রার্থী হরিশ দ্বিবেদী। সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী রামপ্রসাদ চৌধুরী তাঁকে হারিয়েছেন এক লক্ষ ভোটের ব্যবধানে। রামের বনবাস পর্বের সঙ্গে জড়িত আরও একটি জায়গা প্রয়াগরাজ বা এলাহাবাদ। এই লোকসভা কেন্দ্রে হেরেছেন বিজেপি প্রার্থী নীরজ ত্রিপাঠী। ১৯৮৪ সালের পর আবার এই আসনে জয়ের মুখ দেখল কংগ্রেস। বিজেপি প্রার্থীকে ৫৮ হাজারের বেশি ভোটে হারিয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী উজ্জ্বল রামন সিং।


‘রাম-কথা’র সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে নাসিকের নাম। মহারাষ্ট্রের এই শহর গোদাবরী নদীর তীরে অবস্থিত। কথিত আছে, এই নাসিকেই রাবণের ভগ্নী শূর্পনখার নাক কেটে দিয়েছিলেন লক্ষ্মণ। এই নাসিক লোকসভা কেন্দ্রে হেরেছেন বিজেপির জোটসঙ্গী শিবসেনার একনাথ সিন্ধে গোষ্ঠীর প্রার্থী হেমন্ত গডসে। এখানে তাঁকে দেড় লক্ষের বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন বিরোধী জোটের উদ্ধব শিবসেনা প্রার্থী রাজাভাউ ওয়াজে। ভগবান রামের ভক্ত হনুমানের জন্মস্থান বলে পরিচিত কোপ্পলেও ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। কর্ণাটকের এই আসনে বিজেপি প্রার্থী বাসবরাজ এস কিয়াভাতের ৪৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন কংগ্রেস প্রার্থী কে রাজাশেখর বাসবরাজ হিতনালের কাছে।

দক্ষিণ ভারতের আরও এক স্থান রামেশ্বরমেও হার বাঁচাতে পারেনি বিজেপি। এই রামেশ্বরমে শ্রীরাম শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি তামিলনাড়ুর রামনাথপুরম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। এই আসনে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক এইউএমএল-এর প্রার্থী কানি কে নাভাস জয়ী হয়েছেন। সবমিলিয়ে ভগবান রামকে সামনে রেখে বিজেপি এতদিন ভোট বাক্সে যে ফসল তুলে আসছিল, এবার লোকসভা ভোটে ঠিক সেই জায়গাতেই ধাক্কা খেতে হয়েছে গেরুয়া শিবিরকে। মোদি-অমিত শাহদের ধর্মীয় বিভাজনের তাস যে দেশের মানুষ আর নিচ্ছে না, তা লোকসভা ভোটের ফলাফলেই স্পষ্ট।

