নকিব উদ্দিন গাজী

কেউ নদীতে মাছ ধরেন, কেউ সুন্দরবনে গহীনে মধু সংগ্রহ করেন, কেউবা জঙ্গলের মধ্যে কাঁকড়া খোঁজেন। এটাই ওঁদের জীবিকা। সেই জীবিকার টানে সুন্দরবনের গহীন থেকে গভীরে যান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। বাঘ-কুমিরের ভয়কে উপেক্ষা করে পেটের টানে জঙ্গলে যেতে হয়। সুন্দরবন এলাকার সেইসব খেটে খাওয়া মানুষই অভিনয় মঞ্চে। মঙ্গল কাব্য ‘মনসামঙ্গল’-এর আঙ্গিকে বর্তমান জীবনযাত্রার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন বিষয়ে সুন্দরবনের মানুষের সচেতনতায় ‘বেহুলা এখন’ নাটকটি সাজিয়েছেন নাট্য ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র মিত্র। সেটিই মঞ্চস্থ হল দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকা রায়দিঘির শ্রীধরপুর গ্রামে মনি নদীর পাড়ে। এই নাটকের মধ্যে দিয়ে বার্তা দেওয়া হল সমাজ সচেতনতার।

কলকাতার নাট্যদল পূর্ব-পশ্চিমের প্রযোজনায় ও স্থানীয় সংস্থা মুক্তির সহযোগিতায় সুন্দরবনের ওই সব প্রান্তিক মানুষকে নিয়েই মঞ্চ বেঁধে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। প্রত্যন্ত সুন্দরবনের গ্রামে গঞ্জে সাপে কাটলে প্রথমেই নিয়ে যাওয়া হয় ওঝার কাছে। সেই কুসংস্কার দূর করতেই মনসামঙ্গলের বেহুলা চরিত্রের অবতারণা করা হয়েছে। চাঁদ সদাগর পুত্র লখিন্দরকে বাসরঘরে সাপে কাটলে বেহুলা এই দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবনের নেতি ধোপানীর ঘাট হয়ে বিভিন্ন নদীপথে স্বর্গে মৃত স্বামীর প্রাণভিক্ষায় দেবতাদের কাছে পৌঁছান বলে কথিত আছে। এই নাটকে সেই ঘটনা উল্লেখ করে বলা হয়েছে সাপে কাটলে ওঝার কাছে নয়, রোগীর প্রাণ বাঁচাতে প্রথমেই হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার। এছাড়াও নাটকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবেশ সচেতনতায় জোর দেওয়া হয়েছে। কুলতলি, রায়দিঘি ,পাথরপ্রতিমা সহ বিভিন্ন এলাকার প্রান্তিক মানুষজনকে নিয়ে এই অভিনয়ের মহড়া চলছে প্রায় দশ দিনের বেশি, রায়দিঘির শ্রীধরপুরের সংস্থা ‘মুক্তি’র অঙ্গনে।
কুলতলির বাসিন্দা তথা ‘মুক্তি’র সদস্য দেবাশিস গিরি অভিনয় করছেন এই নাটকে। তিনি জানান, সমাজ সচেতনতা মূলক প্রচারেই এই নাটক মঞ্চস্থ হবে। এই নাটকে মহিলাদের ঘরবন্দি না রেখে তাঁদের স্বপ্নপূরণে পরিবারের উৎসাহ ও সহযোগিতার কথাও রয়েছে। নাটকে অভিনয় করে দারুন খুশি ছাত্রী রীতা প্রামাণিক, সুস্মিতা বেরারা। নাটকে সুস্মিতা বেহুলা ও রীতা মনসার অভিনয় করছে। প্রথম অভিনয়েই যথেষ্ট পারদর্শী দু’জনেই। সুন্দরবনের গভীরে জঙ্গলে মধু ভাঙতে যাওয়া তারক হালদারও এই নাটকের একজন অভিনেতা। তারক জানায়, “জীবনে প্রথম অভিনয় করছি। এক নতুন স্বাদ পেলাম যেন জীবনে।”

নাটকটির পরিচালক সৌমিত্র মিত্র বলেন, “গত কয়েক দিন ধরেই মানুষগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে থেকে মহড়া চালাচ্ছি। এত সহজ সরল মনের মানুষ এঁরা ভাবা যায় না! দীর্ঘ নাট্যজীবনের অভিজ্ঞতায় প্রান্তিক এলাকার মানুষজনের জন্য কিছু করার ইচ্ছা বহুদিনের। সেই প্রেক্ষিতেই সুন্দরবনে যাঁরা মাছ-কাঁকড়া ধরতে যান, জঙ্গলে মধু সংগ্রহে বের হন, কাঠফাটা রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে মাটি কাটার কাজ করেন যে শ্রমিকরা সেই সমস্ত পরিবার ও তাঁদের পরিজনদের অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই সামাজিক সচেতনতায় প্রচার এই নাটক। লোকসংগীত গাইছেন ওই সমস্ত পিছিয়ে পড়া, খেটে খাওয়া পরিবার থেকে উঠে আসা শিল্পীরাই। এখন মনে হচ্ছে থিয়েটারের জন্য সত্যিই যেন কিছু করতে পারলাম। এত সাবলীল ও সুন্দর মানুষগুলোর অভিনয়ের মহড়া দেখে অবাক হয়েছি। আসলে ওঁরা ওঁদের নিজেদের জীবনের কথা মন থেকে ভাবতে পারেন বলেই সকলেই দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রীর মত অভিনয় করছেন। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, কেবল এখনকার বেহুলা সমসাময়িক জীবনে প্রকৃতই নারী হয়ে উঠুক, প্রান্তিক এলাকার নারীরও ক্ষমতায়ন হোক এটাই লক্ষ্য। কলকাতায় ফেস্টিভ্যালেও ওঁদের দিয়েই এই নাটকটি মঞ্চস্থ করব এবং নিশ্চিতভাবে সফল হব বলেই আশা রাখি।”
প্রচলিত লোকগান ছাড়াও এই নাটকে এমন কিছু লোকগান ব্যবহার করা হয়েছে যে সমস্ত লোকগানের সৃষ্টি করা হয়েছে ওই এলাকায় বসেই। সৃষ্টিকর্তা পূর্ব-পশ্চিমের গীতিকার ও সুরকার দীপেন ভট্টাচার্য। নাটকের নাট্যভিত্তি উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের থেকে নেওয়া। নাট্য কর্মশালা পরিচালনায় রয়েছেন দেবব্রত মাইতি, সহ প্রধান রূপকার অরূপ রতন গঙ্গোপাধ্যায় এবং আবহে সন্দীপ ভট্টাচার্য।

আরও পড়ুন – রবীন্দ্র চর্চার প্রতি দায়বদ্ধতা বাড়ানোর আহ্বান: রবীন্দ্র সদনে কবিগুরুকে শ্রদ্ধা মুখ্যমন্ত্রীর

_

_

_


_

_

_

_

_