সি পি রাধাকৃষ্ণন, ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি
১১ অক্টোবর ১৯০২। ধর্ম, সংস্কৃতি ও বিহারের জ্ঞানভূমি, গঙ্গা ও ঘাঘরা নদীর সঙ্গমস্থলের সীতাবদিয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ। এ বছর তাঁর ১২৩তম জন্মবার্ষিকী। জে পি নামে পরিচিত জয়প্রকাশ (Jayprakash Narayan), গরিবদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতেন। কোনও মহান ব্যক্তিত্ব তাঁকে ‘লোকনায়ক’ আখ্যা দেননি। ১৯৭৪-এর ৫ জুন পাটনার গান্ধী ময়দানে সমবেত জনগণ তাঁকে এই নামে ভূষিত করে।

সীতাবদিয়ারার ভূমিপুত্রর জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সরল। গরিবদের সমস্যা নিয়ে সব সময়েই ভাবতেন। গ্রামেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি পাটনায় যান। সেখানে গুণী মানুষের সান্নিধ্য তাঁর মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও দেশাত্মবোধের বীজ বপন করে। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার পরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অহিংসা ও অসহযোগিতার আন্দোলন গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে, যা তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলে। সমস্ত বিলাসিতা ত্যাগ করে তিনি স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেন।

আমেরিকায় সাত বছর পঠন-পাঠনের সময় নারায়ণ মার্ক্সবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং এক সময় তাঁর মনে হয়েছিল যে, ভারতের সমস্ত সমস্যার সমাধান এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। ভারতে ফিরে আসার পর এই দেশের প্রেক্ষাপটে মার্ক্সবাদী (Marxist) দর্শন কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে তিনি ভাবনাচিন্তা করতে থাকেন। বুঝতে পারেন, গণতান্ত্রিক সমাজবাদ এবং সর্বোদয়ের মধ্যে ভারতের সমস্যার সমাধান সম্ভব। শুধুমাত্র আদর্শ অনুসরণ করেননি, সেইসঙ্গে সমাজ পরিবর্তনের একজন নেতা হয়ে উঠেছিলেন।

১৯৫২-তে তিনি বিনোবা ভাবের ভূ-দান আন্দোলনের সঙ্গে সর্বোদয়-এর দর্শনের মেলবন্ধন ঘটিয়ে ভারতে জমি সমস্যার বাস্তব সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত চম্বলের ডাকাতদের পুনর্বাসন এবং অহিংসার আন্দোলন তাঁকে গোটা বিশ্বের স্বীকৃতি এনে দেয়। গোটা মানবজাতি, বিশেষত ভারতের স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব এবং শান্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি ক্রমাগত লড়াই চালাতে থাকেন।

লোকনায়ক জয়প্রকাশ (Jayprakash Narayan) শুধুমাত্র তত্ত্বগতভাবে ‘শ্রমের মর্যাদা’র ধারণা উপলব্ধি করেননি, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এটি আত্মস্থ করেছিলেন। আমেরিকায় পঠন-পাঠনের সময় নিজের আর্থিক ব্যয়ভার সামলাতে তিনি লেখাপড়ার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের কাজও করেছেন। এই অভিজ্ঞতা শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষ সম্পর্কে তাঁর মধ্যে এক অন্তর্দৃষ্টি গড়ে তোলে। সৎ শ্রমিকদের প্রতি সম্মান, ন্যায্য মজুরি এবং মানবিক কাজের পরিবেশ সম্পর্কে এই অনুভূতি তাঁর ভাবনাকে শক্তিশালী করে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শিল্পপতিরা যখন সমৃদ্ধিময় জীবনযাপন করেন, তখন শ্রমিক শ্রেণি দারিদ্র্যের মধ্যে দিনযাপন করে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে ১৯৪৭-এ তাঁকে তিনটি সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এগুলি হল – সারা ভারত রেলওয়ে মেনস ফেডারেশন, সারা ভারত পোস্টমেন ও টেলিগ্রাফ লোয়ার গ্রেড স্টাফ ইউনিয়ন এবং সারা ভারত অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিজ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন।

শুধুমাত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যেই লোকনায়ক জয়প্রকাশ তাঁর যাত্রা শেষ করেননি। ক্ষমতা তাঁকে কখনও আকৃষ্ট করেনি। তিনি সর্বদা মানুষের সেবা করতে চেয়েছেন। ১৯৬০ সালে বিহারে খরা দেখা দেয়। জয়প্রকাশ এবং তাঁর অনুগামীরা ত্রাণকাজে সামিল হন। দেশসেবার ক্ষেত্রে এই প্রথম তিনি আরএসএস-এর স্বয়ংসেবকদের কাজের সঙ্গে পরিচিত হন এবং এটি তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।

দেশের সর্বস্তরে যখন দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে, তখন লোকনায়ক জয়প্রকাশ ভারতীয় (Indian) সমাজের পুনর্জাগরণে তরুণদের অনুপ্রাণিত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ১৯৭৩-এ বিনোবা ভাবের পৌনার আশ্রম থেকে ‘টোটাল রেভোলিউশন’ বা পূর্ণ বিপ্লবের ডাক দেন। পূর্ণ বিপ্লব আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল, একটি আদর্শ মানবিক সমাজ গড়ে তোলা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর নীরলস লড়াই সেই সময়ে রাজনীতিতে আলোড়ন তুলেছিল এবং গণতন্ত্রে মানুষের ক্ষমতার মাহাত্ম্য তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন।

উনিশ বছরের একজন তরুণ হিসেবে কোয়েম্বাটোরে জেলা সংগঠক সম্পাদক হিসেবে পূর্ণ বিপ্লব আন্দোলনে সামিল হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। এই পর্বে ভারতের ইতিহাস এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ায়। আমার মধ্যে সেসময় আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে।

আমাদের প্রিয় নেতা জয়প্রকাশজিকে স্মরণ করছি। তবে, তাঁর আন্দোলনে সবসময় পাশে থেকেছেন তাঁর স্ত্রী প্রভাবতী দেবী। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নিঃস্বার্থ অবদান রাখার লক্ষ্যে তিনি ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করেছিলেন এবং গান্ধীজীর আদর্শে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন।

১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে ১৯৭০-এর পূর্ণ বিপ্লব – সবক্ষেত্রে একটি বিষয় কাজ করেছে, তা হল দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। সে সময় তাঁর কাছে যে কোনও সরকারি পদ বেছে নেওয়ার সুযোগ এসেছিল, কিন্তু ক্ষমতার মোহ তাঁকে কখনও গ্রাস করেনি।
লড়াই যতই কঠিন হোক না কেন, লোকনায়কের জীবন ও শিক্ষা পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বার্তা দেয়। তিনি সর্বদা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন এবং ন্যায়, সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেছেন। তিনি একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা। তাঁর শিক্ষা শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সাম্যের আদর্শে বিশ্বাসী প্রতিটি ভারতবাসীকে প্রেরণা যুগিয়ে যাবে।
বিপ্লবের সঙ্গে হিংসাকে প্রায়ই সমার্থক করে তোলা হয়। কিন্তু, জয়প্রকাশের পূর্ণ বিপ্লব ছিল পুরোপুরি অহিংস। অহিংসার গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি ভারতের ভিত্তি গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন।
১১ অক্টোবর আমরা এই মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে থাকি। আমাদের অঙ্গীকার করা উচিত যে, তাঁর পথ ধরে গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে আমরা সজাগ থাকব। এই দিনে তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধার্ঘ্য আমাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলবে এবং স্বার্থহীনতা, সেবা এবং সত্যের ওপর ভিত্তি করে উন্নত ভারতের পথ প্রশস্ত করবে।
দেশ গড়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। আমি মনে করি, এই মহান ব্যক্তির কাছে এটি অত্যন্ত তুচ্ছ। প্রকৃত অর্থে তিনি হলেন ভারতের প্রকৃত রত্ন। সর্বদা মাতৃভূমির সেবায়!