৩৭০ ও কিছু প্রশ্ন…

৩৭০ লাগু হওয়ার পর অনেকেরই ভাবখানা এমন, যেন দেশের অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কিন্তু বাস্তব হল এটাই যে জম্মু-কাশ্মীর বা নয়া লাদাখ রাজ্যটা আস্ত ভারত নয়, তার সমস্যাই শুধু দেশের সমস্যা নয়। দুটি রাজ্য ভারতের একটা অংশমাত্র। যেখানে দীর্ঘদিনের ক্ষত। সেই ক্ষত একটা আইন পাশ করলেই নিরাময় হয়ে যাবে বলে যারা ভাবছেন, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। মনে রাখতে হবে জম্মু-কাশ্মীর সামাল দিতে দেশের এক-তৃতীয়াংশ সেনা রয়েছে পাহাড়ায়। সেই সঙ্গে নতুন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রায় ৫০ হাজারের বাহিনী এখনও মোতায়েন রয়েছে। কার্ফু আর নিষেধাজ্ঞায় স্বাভাবিক জীবন আর গণতান্ত্রিক অধিকার, সবই আজ তালাবন্দি। পাশাপাশি পাকিস্তানের প্ররোচনা। এরমাঝে আবার পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখলের ডাক। আবেগ উস্কে ভোট বৈতরণী পেরনো যায়, কিন্তু দেশকে সুস্থিত করা যায় না। এটা একটা দীর্ঘ পরিক্রমা। যা সরকারকে রাজনৈতিক সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে সকলের সহযোগিতা নিয়ে এগোতে হবে। এখানে সংসদের কোনও সংখ্যাগরিষ্ঠতাই কাজে দেবে না। দরকার দুই রাজ্যের মানুষের আস্থা অর্জন। সেটা ভাইচারা দিয়েই করতে হবে। জয়শ্রীরাম কিংবা ভারত মাতা কি জয় বলে মিছিল করলে হবে না, হতে পারে না। কিংবা কোনও বিজেপি নেতার কাশ্মীরি মেয়েকে বিয়ে করার ছাড়পত্রের উস্কানি সরকারকেই ব্যতিব্যস্ত করবে। পরিস্থিতিই স্বাভাবিক হল না, অথচ শিল্প সম্মেলন করে বিনিয়োগের আবহাওয়া তৈরি হয়ে যাবে বলে যে ভাবনা চলছে, সেটাও সোনার পাথরবাটি ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।

একটা আওয়াজ উঠেছে, এক দেশ, এক আইন। উত্তম কথা। তবে এ আওয়াজ উঠলে বেশ কিছু প্রশ্নের মুখেও পড়তে হবে সরকারকে। ৩৭০ যদি বিলোপ হয় তাহলে প্রশ্ন হল…

১. মহারাষ্ট্র আর গুজরাটে কেন ৩৭১ ধারা বলবৎ থাকবে? যে আইনের বলে দুই রাজ্যের রাজ্যপাল বিধর্ব, মারাঠাওয়াড়া কিংবা কচ্ছের জন্য বিশেষ উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি করতে পারেন।

২. ৩৭১এ ধারা কেন লাগু থাকবে নাগাল্যান্ডে? যে ক্ষমতাবলে নাগা সরকার দেশের সংসদকে উপেক্ষা করে নাগাদের ধর্মীয় ও সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে নাগা ঐতিহ্য রক্ষার্থে আইন। দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন নাগা ঐতিহ্য অনুযায়ী, যার মধ্যে জমির মালিকানা ও হস্তান্তরের বিশেষ সুবিধাও রয়েছে। এই নীতি কার্যকর করতে নাগা বিধানসভাকে আইন পাশের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নাগা রাজ্যপাল বিশেষ ক্ষমতাও ভোগ করেন।

৩. ৩৭১বি ধারা এখনও বহাল অসমে, কেন? যে আইনি ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি উপজাতি এলাকার উন্নয়নের জন্য নির্বাচিত বিধায়কদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করতে পারেন।

৪. প্রশ্ন, স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও কেন ৩৭১সি ধারা এখনও বলবৎ মনিপুরে? অসমের মতোই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত বিধায়কদের নিয়ে পার্বত্য এলাকায় বিশেষ কমিটি তৈরি করতে পারেন। তবে রাষ্ট্রপতিকে বার্ষিক রিপোর্ট দেবেন রাজ্যপাল।

৫. ১৯৭৪ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে অন্ধ্রপ্রদেশে ৩৭১ডি ও ই ধারা লাগু হয়। যে (৩৭১ডি) আইনে রাজ্যের মানুষ শিক্ষা আর চাকরির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাবেন। রাজ্য সরকার চাইলে অসামরিক পদ তৈরি করে সরাসরি নিয়োগ করতে পারে। আর ৩৭১ই ধারার ক্ষমতাবলে অন্ধ্রে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা সম্ভব।

৬. ৩৭১জি ধারা এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে মিজোরামে। নাগাল্যান্ডের মতোই এই রাজ্য সরকার ধর্মীয় ও সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে। মোদ্দা কথা মিজো ঐতিহ্য রক্ষার্থে আইন। দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন মিজো ঐতিহ্য অনুযায়ী, যার মধ্যে জমির মালিকানা ও হস্তান্তরও রয়েছে। আর বিধানসভার প্রতিনিধি সংখ্যা অন্তত ৪০জন রাখতেই হবে।

৭. ৩৭১এইচ ধারা চালু অরুণাচল প্রদেশে। যে আইনের বলে এখানকার বিধানসভায় কমপক্ষে ৩০জন সদস্য থাকতে হবে। আর আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নে রাজ্যপাল এই রাজ্যে বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করেন।

৮. ৩৭১ আই ধারা চালু রয়েছে গোয়ায়। যে আইন বলছে, রাজ্যে নির্বাচিত বিধায়কের সংখ্যা নূন্যতম ৩০ হতেই হবে।

৯. ৩৭১জে ধারা অনুযায়ী কর্নাটকের ৬টি পিছিয়ে পড়া জেলা বিশেষ সুবিধা পায়। সরকার এই ক্ষমতাবলে ৬টি জেলার জন্য বিশেষ উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি করতে পারে। শুধু তাই নয়, এই জেলাগুলিতে চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে স্থানীয়রা বিশেষ ‘কোটা’র সুবিধা পাবেন।

এই প্রশ্ন তোলার পরেই কেউ কেউ বলবেন, সরকার একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। কারওর তো এটা করারই হিম্মত হয়নি এখন হুল ফোটাতে নেমে পড়েছে সব ‘দেশদ্রোহীরা’। প্রশ্নটা এই কারনে উঠছে, কারন…

১. এর আগে ৩৭০ ধারা তোলা হয়নি জম্মু-কাশ্মীর থেকে। তাই এই প্রশ্নও ওঠেনি স্বাভাবিকভাবে।

২. ৩৭০ ধারা লাগু করেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, অন্য রাজ্যগুলোর উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু হয়নি। রাজ্যগুলি বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে না।

৩. আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাই যদি শিরোধার্য হয়, তবে এক দেশ, এক আইন ব্যাপারটা সোনার পাথরবাটির মতোই শোনায় না!

স্বাভাবিকভাবেই এরপর কেউ যদি বলেন, দেশ নয়, ব্যালটই আসল লক্ষ্য, তাহলে কি খুব একটা ভুল বলা হবে!!

আমাকে মার্জনা করবেন…

Previous articleরণক্ষেত্র পূর্ব মেদিনীপুরের বাজকুল কলেজ
Next articleজনগণের টাকায় বৈশাখীকে নিরাপত্তা কেন ? বিজেপির অন্দরেই উঠছে প্রশ্ন