কে এই ট্যাক্সিচালক? চমকে গেলেন বিনোদ ঘোষাল

এক ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে কথা বলে চমকে গেছেন বিনোদ ঘোষাল। অপূর্ব জ্ঞান, চর্চা, কৌতূহল। সোশ্যাল মিডিয়ার পাঠকদের বিনোদ জানিয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। তিনি লিখেছেন:

এই ট্যাক্সিওলাকে চিনে রাখুন!

ছেলেটির নাম তারক সিং। পেশায় ট্যাক্সিচালক। প্রথমদিন ওর ট্যাক্সিতে উঠেছি। কিছুক্ষণ পর আমার বন্ধুর একটি ফোন এল। নজরুল বিষয়ক বেশ কিছু কথা হল সেই বন্ধুর সঙ্গে। কথা শেষ হওয়ার পর আমি চুপ। সাধারণত নজরুল নিয়ে কথার পর আমার মনের ভেতর অনেক ভাবনা ঘুরপাক খায়, আমি অন্যমনস্ক হয়ে উঠি। সেদিনও তাই হ’ল। ভাবনার ঘোরটা কাটল ট্যাক্সিওলার প্রশ্নে-
-স্যর একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
-হুঁ বলুন(অপরিচিত তারককে আমি তখন স্বাভাবিকভাবে আপনি সম্বোধন করতাম)
-নজরুল তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সিপাই হয়ে লড়তে গিয়েছিলেন?
-হুঁ(আমি সামান্য বিস্মিত)
-কিন্তু ভারত তো বিশ্বযুদ্ধে লড়েনি। তাহলে কি ব্রিটিশের হয়ে লড়েছিল?
-হ্যাঁ(আমি আবারও সামান্য বিস্মিত)
-ওর মতো মানুষ ব্রিটিশের হয়ে কেন লড়তে গেলেন স্যর?
-যুদ্ধবিদ্যা শিখে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়বেন বলে।
-কোথায় গেছিলেন?
-করাচি।
ছেলেটির প্রশ্ন বাড়তে থাকল। এবং একটা সময় আমি তুমুল বিস্মিত হয়ে দেখলাম সেই ট্যাক্সিওলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে ভারতে কাশ্মির সমস্যার উৎস, গান্ধীজির ভুল কী ছিল থেকে বর্তমান ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ নেতাজি সম্পর্কে কী ভাবেন তাই নিয়ে আলোচনা করছে। ছেলেটির এতই জ্ঞান যে আমি একই সঙ্গে কৌতুহলী এবং দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম। ওর প্রশ্ন এবং ওর সঙ্গে আলোচনার খেই রাখতে গিয়ে আমি হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে বসেছিলাম।
আপনার নাম কী ভাই?
তারক। তারক সিং।
আপনি এত কিছু জানলেন কীভাবে?
বই পড়ে। বই পড়তে আমার খুব ভাল লাগে।
জমে গেল আড্ডা। আর আমি জানলাম….
তারক বড় হয় একটি অনাথ আশ্রমে। সেই আশ্রমের লাইব্রেরিতে বই বাঁধাইউএর কাজে সাহায্য করতে গিয়ে নানা রকমের বই ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে তারকের বই পড়ার নেশা শুরু। আর শুরু দেশ বেড়ানোর স্বপ্ন দেখা। ক্লাস টেন পাশ করে তাই এক পরিচিতের সঙ্গে অনাথ আশ্রম ছেড়ে তারক বেড়িয়ে পড়ল দেশ ভ্রমণে। লরির খালাসি। দীর্ঘ বছর লরির খালাসি, ড্রাইভারি করে ভারতবর্ষকে খুব কাছে থেকে দেখেছে তারক। অনেকগুলো ভাষা জানে। আর অভিজ্ঞতার ঝুলি? তা শুনতেই হপ্তা পার হয়ে যাবে। কখনও ঘন জঙ্গলে লরি খারাপ হয়ে গিয়ে সেখানেই রাত্রিবাস এবং বুনো ভাল্লুকের কবলে পড়া তো কখনও ডাকাতের কবলে। পুলিশ ডাকাত ভেবে তুলে নিয়ে তিহার জেলেও ঢুকিয়ে দিয়েছিল বেশ কিছুদিন। কত কত রকমের সংস্কৃতি দেখেছে তারক, কতরকম মানুষের সঙ্গে যে মিশেছে। অনেক সময় লরিতে লোড হত ম্যাগাজিন আর পুরনো বই। ওগুলো গলিয়ে পিচবোর্ড প্যাকিং বাক্স তৈরি হবে। তারক সেই হাজার হাজার বই থেকে ভাল ভাল ‘নবেল'(নভেল) বার করে ঝপাঝপ পড়ত লরির মাথায় বসে। বাকি সহকর্মীরা হাসত, কিন্তু তারকের হুঁশ নেই।
জীবনকে নানাভাবে দেখেছে তারক। আর অসামান্য সেইসব গল্প! আমি ওইদিনের পর থেকে মাঝেমাঝেই তারকের ট্যাক্সিতে উঠি। আর ওর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিই। পেটানো চেহারা, মিষ্টিভাষী তারক শুধু দেশের নয় বিদেশের গল্পও করে, ন্যশনাল জিওগ্রাফি, ডিসকভারি দেখে। সেদিন দেখি গাড়িতে বসে সন্দীপ মহেশ্বরীর ভিডিও দেখছে।আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম তুমি চেনো ওকে?
না স্যর নাম জানি না। তবে লোকটার কথাগুলো খুব ভাল লাগে। কয়েকটা ভিডিও ডাউনলোড করে রেখেছি, সময় পেলেই শুনি।
অনাথ আশ্রমে খুদকুঁড়ো খেয়ে বড় হওয়া তারক সেদিন আমাকে বলল, স্যর একটা অনুরোধ ছিল।
হ্যা বলো।
আপনি তো নজরুলকে নিয়ে লিখছেন। ওর জীবনটা খুব জানতে ইচ্ছে করে। আমি তো মুখ্যু মানুষ, বিশেষ কিছু জানি না। কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করে।
বেশ দেব তোমাকে।
সেদিন দিলাম।
বইটায় হাত বুলিয়ে তারক হেসে বলল। তিন দিনের মধ্যে হয়ে যাবে স্যর।
জীবনে বহু কষ্ট করে বড় হওয়া তারক, ধার দেনা করে একটা ট্যাক্সি কেনা তারক, একটুকরো জমিতে ছোট্ট একটা ঘর বানানো তারক সারারাত ট্যাক্সি চালিয়ে দিনের বেলা বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ রেস্ট নেয়। তারপর আবার বেরিয়ে পড়ে পেটের টানে। আর তার মাঝেই সময় বার করে করে পড়ছে সে আরেক বোহেমিয়ান জীবনের কথা। আমি বেজায় চিন্তায় আছি তারকের কেমন লাগবে কে বাজায় বাঁশি?…কে জানে!!!
তারকের ট্যাক্সিতে এরমধ্যে যদি কেউ ওঠেন ওকে একবার জিজ্ঞাসা করবেন তো!

Previous articleআজ নাগপুরে সিরিজ জিততে মরিয়া ভারত
Next articleআইএফএ-র বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পিকে-চুনীকে বিশেষ সম্মান