এই আন্দোলন ভুল, যেতে হবে আদালতে, কণাদ দাশগুপ্তের কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

সেই ‘What bengal thinks today, India will think tomorrow’ যেন ফিরে আসছে৷ প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও, মিল আছে মূল সুরে৷ মহামতি গোখলের এই উক্তি ছিলো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে৷ এবারের সংগ্রামও স্বাধীনতার, তবে এই স্বাধীনতা মানবিকতার, এই স্বাধীনতা বৈষ্যমমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত হওয়ার৷ শুরু করেছিলো বাংলা৷ তারপর দিল্লি। একে একে সঙ্গে এসেছে পঞ্জাব, ছত্তীসগঢ়, কেরল৷ এবার মধ্যপ্রদেশ। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে এই ৬ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও বলছেন, নতুন নাগরিকত্ব আইন কোনও ভাবেই তাঁদের রাজ্যে লাগু হবে না। প্রতিবাদী স্বর দীর্ঘায়িত হচ্ছে৷ এ কিসের ইঙ্গিত ?

🕳 এ পর্যন্ত না হয় ঠিক আছে৷ কিন্তু এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে সমান নজর দেওয়ার সময়ও এসেছে৷ কোনও আন্দোলনের জেরেই CAA বাতিল হবে না৷ এটাই বাস্তব৷ এটা মেনে নিতে হবে৷

🕳 কেন্দ্রীয় আইনের প্রয়োগ ঠেকানোর পথ সহজ নয়৷ কোন পথে তা ঠেকানো সম্ভব, তা নিয়ে ‘প্রতিবাদী’ মুখ্যমন্ত্রীদের আশু বৈঠক জরুরি৷ এই আইনকে বারবার ‘অসাংবিধানিক’ বললেই সমাধান আসবেনা৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়েছে, নাগরিকত্বের বিষয়টি সংবিধানের সপ্তম তফসিলের অধীনে আছে৷ তাই বিষয়টি সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় তালিকার অন্তর্গত বিষয়। তাই সব রাজ্যই ওই আইন মানতে বাধ্য। কোনও রাজ্যের হাতে নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রয়োগ প্রত্যাখ্যান করার আইনি হাতিয়ার নেই৷ সেটাই স্মরণ করিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ বলেছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় আইন বলবৎ করব না, এ কথা বলার কোনও আইনি ক্ষমতা কোনও রাজ্য সরকারের নেই৷ নতুন আইনেও তা দেওয়া হয়নি। ভারতের সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কখনই কোনও রাজ্যকে সেই ক্ষমতা দেয়না, এবারও দেয়নি।’’ এটাই সার কথা, এটা বুঝতে হবে৷

🕳 শুধুই প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, বাসে আগুন বা ট্রেনে পাথর ছুঁড়লেই এই আইন লাগু হবেনা, এমন ভাবনা নিতান্তই শিশুসুলভ,অপরিনত৷

🕳 নীতিগত ভাবে রাজ্যের পক্ষে যে কেন্দ্রীয় আইনের প্রয়োগ আটকানো সম্ভব নয়, তা স্বীকার করে নিয়েই পরবর্তী ধাপে পা রাখতে হবে৷ তৃণমূলের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও, পরামর্শ দেওয়াই যায়, এই ইস্যুতে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং আর্থ-সামাজিক দিকগুলি সামনে এনে জনমত তৈরি করতে হবে ঠিক সিঙ্গুরের কায়দায়৷ গণ- আন্দোলনের আবহ তৈরি করা না গেলে, এই প্রতিবাদ সাফল্যের আলো দেখবে না৷ এমন ভাবে মানুষের মনের কথা সামনে আনতে হবে, যাতে শুধুই দলীয় নেতা-কর্মীরা নন, সাধারন মানুষও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এর প্রতিবাদে পথে নামেন। তবে এই পথে প্রচার আছে, সমাধান নেই৷

🕳 কেন্দ্র বলছে, কোনও রাজ্য যদি কেন্দ্রীয় আইন প্রয়োগের পথে বাধা বা সমস্যার সৃষ্টি করে, সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে হলে প্রথমে সংবিধানের ৩৫৫ এবং পরে ৩৫৬ ধারা পর্যন্ত প্রয়োগ করতে পারার অনুমতি দেশের সংবিধান কেন্দ্রকে আগেই দিয়েছে।এদিকে বাংলার পথ বেয়ে একের পর এক রাজ্য বিরোধিতায় এগিয়ে আসছে৷ একা বাংলা প্রতিবাদ করলে, কেন্দ্রের পক্ষে কড়া ব্যবস্থা সুবিধা হতো। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই সুবিধা কেন্দ্র সম্ভবত পাচ্ছে না৷ একাধিক রাজ্য নতুন আইনের বিরোধিতায় এগিয়ে এসেছে৷ ফলে, এত রাজ্যে একসঙ্গে সংবিধানের ৩৫৫ বা ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করা অসম্ভব৷ সেই সুবিধা বাংলা-সহ প্রতিবাদী রাজ্যগুলি পাবে৷

🕳 এ রাজ্যের প্রশাসনকে অতি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, শুক্র এবং শনিবার কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যে ধরনের অনভিপ্রেত, অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, তা এখনই কড়া হাতে দমন করতে না পারলে, এই ফাঁক দিয়েই বাংলায় ঢুকে পড়বে কোনও না কোনও কেন্দ্রীয় আইন৷ শত চিৎকারেও তা থামানো যাবে না৷ মুখ্যমন্ত্রীকেই এ দিকটা মাথায় রাখতে হবে৷ কারন কেন্দ্র এমন সুযোগই খুঁজছে৷

🕳 তৃণমূলের হয়তো বোঝানোর চেষ্টা করছে বা করবে যে, দেশের সব মুসলমানেরই ভারতীয় নাগরিকত্ব চলে যাবে। কিন্তু সেই ব্যাখ্যা ঠিক নয়৷ এই যুক্তি বিশেষ এক সম্প্রদায়কে প্ররোচিত করতে পারে৷ তেমনটা হলে মাশুল দিতে হবে রাজ্য সরকারকে৷ বিতর্কিত হয়ে ওঠা রাজ্যপাল সাহেব যেন কেন্দ্রের বিশেষ নির্দেশে ‘শক্তিশালী’ না হয়ে ওঠে, তা দেখতে হবে রাজ্যের শাসক দলকেই৷

এবার ‘আসল’ কথা৷

🕳 একটাই প্রশ্ন, কেন্দ্রীয় আইন কোনও অঙ্গরাজ্যের সরকার কি অমান্য করতে পারে? উত্তর, পারে না৷ সংবিধানের 256 ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইন রাজ্যকে লাগু করতে বাধ্য করার ক্ষমতা রয়েছে কেন্দ্রের। ফলে,শুধুই রাস্তায় নেমে মানছি না, মানবো না বলে আগুন লাগালেই কেন্দ্র CAA প্রত্যাহার করে নেবে, এমন তো নয়৷ এতে দেশজুড়ে তৃণমূল প্রচার পাবে ঠিকই, কিন্তু ওই পর্যন্তই৷ আসল কাজে এসবে একআনাও লাভ নেই৷

🕳 প্রচার রাজনীতির অঙ্গ৷ সে সব চলতেই পারে৷ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে, রাজ্য কি এই ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’-এর সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যাবে ?

🕳 সংবিধান বিশেষজ্ঞ তথা আইনজ্ঞদের ব্যাখ্যা, ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকত্ব ইস্যুটি একদমই রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। এটি পুরোপুরি কেন্দ্রীয় তালিকার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কেন্দ্রীয় আইন কোনও রাজ্য সরকার অগ্রাহ্য করতে পারে না। এমন আইন নেই৷ কেন্দ্রীয় আইন অগ্রাহ্য করতে হলে উপযুক্ত আইনি বর্ম চাই রাজ্যের৷ সেই ‘বর্ম’ রাজ্যকে একমাত্র দেশের শীর্ষ আদালতই দিতে পারে৷ পথে নেমে, বিবৃতি দিয়ে, বনধ ডেকে, মিছিল-মিটিং করে এ অধিকার মিলবেনা৷ বরং কেন্দ্র নানা ছুতোয় এ রাজ্যে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পেয়ে যাবে৷

🕳 সুতরাং প্রশ্ন, বাংলার সরকার কি যাবে সুপ্রিম কোর্টে? যদি যায়, যেতে হবে ‘রাজ্য’ হিসেবেই৷ তৃণমূলের কোনও পদাধিকারী,কোনও সাংসদ বা অন্য কেউ এই মামলা করার পর রাজ্য সরকার সেই মামলায় ‘অ্যাডেড পার্টি’ হয়তো হতে পারে, কিন্তু তাতে গোটা মামলাই দুর্বল হবে৷ রাজ্য সরকার তৃণমূল পরিচালিত হতেই পারে৷ কিন্তু তৃণমূলের কোনও পদাধিকারী বা কোনও সাংসদ-বিধায়ক বা অন্য কেউ সরকার কী করবে, কোন আইন মানবে, নাকি মানবেনা, তা নির্ধারণ করতে পারে না৷ সরকার চলে নিজস্ব সরকারি বিধি- রীতিতে৷ সরকারের ভূমিকা নিয়ে, দায়-দায়িত্ব নিয়ে কোনও ব্যক্তির মামলার গুরুত্বই নেই। কোনও রাজ্য যদি নতুন নাগরিকত্ব আইন মানতে না-চায়, তাহলে এখনই ‘সরকার’ হিসাবেই সু্প্রিম কোর্টে আবেদন জানাতে হবে। তৃণমূল সরকার কি মামলার পথে হাটঁতে তৈরি ?

🕳 দেশের যে ক’টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী “নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন” মানবেন না বলেছেন, তাঁদেরও সবাইকেই মামলায় যেতে হবে, হয় একসঙ্গে অথবা আলাদা আলাদা ভাবে৷
মমতা, বিজয়ন, কেজরি, ভূপেশ বাঘেল, কমলনাথ বা অমরিন্দর সিং-রা যদি সত্যিই CAA মানতে না চান, তাঁদের সরকার হিসাবেই সু্প্রিম কোর্টে আবেদন জানাতে হবে। এর কোনও বিকল্প নেই৷

🕳 তবে CAA-র সঙ্গেই দেশজুড়ে NRC লাগু করার যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, সে ব্যাপারে রাজ্যগুলোর অধিকার অনেকটাই বেশি। NRC -তে অ-নাগরিক চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন তুলে এড়াতে পারে রাজ্য। আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টি এখনও পর্যন্ত রাজ্য- তালিকাভুক্ত থাকায়, সে সুবিধা রাজ্য পাবে। NRC-র কাজ শুরু হলে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হবে, এ কথা বলার সুযোগ আছে রাজ্যের হাতে।

🕳 বাংলা বা অন্য কোনও রাজ্য “নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন”-এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলে যদি শীর্ষ আদালতে সওয়াল করে, এই নয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারার পরিপন্থী, সেক্ষেত্রে মোদি-শাহের CAA আদালতে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেই৷ এমনই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷

🕳 CAA-বিরোধী আগুন আর আন্দোলনে দলের প্রচার হবে যেমন, তেমনই কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হবে৷ ওই পর্যন্তই৷ কাজের কাজ কিছুই হবে কি ?

🕳 এ ধরনের “প্রতিবাদ” চললে কেন্দ্রের লাভ৷
নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা CAA-এই বাংলাতেও লাগু হয়ে যাবে৷

🕳 ঠেকানোর পথ একটাই, আদালতে যাওয়া৷ তাই বাংলা বা অন্যান্য প্রতিবাদী মুখ্যমন্ত্রীদেরই এখন ঠিক করতে হবে তাঁরা কী করবেন৷ সাধারন মানুষকে জানাতে হবে সত্যিই তাঁরা কী চাইছেন ?

##########

JDU-র জাতীয় সহ সভাপতি প্রশান্ত কিশোর শুক্রবার এক টুইটে বলেছেন, “বিচারবিভাগ ছাড়া ভারতের আত্মাকে রক্ষা করার দায়িত্ব ১৬ জন অ-বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর৷ কারণ ওই ১৬ রাজ্যকেও এই আইন কার্যকর করতে হবে। CAA এবং NRC-কে না করে দিয়েছেন তিন পাঞ্জাব, কেরল ও বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। অন্য মুখ্যমন্ত্রীদেরও নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার সময় এসেছে”৷

তাহলে কি প্রশান্ত কিশোরের ডাকে সাড়া মিলছে৷ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে সুর মিলিয়ে এই ৬ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও এখন বলছেন, নতুন নাগরিকত্ব আইন কোনও ভাবেই তাঁদের রাজ্যে লাগু হবে না। উল্লেখযোগ্যভাবে মহারাষ্ট্র সরকারের শরিক কংগ্রেসের এক মন্ত্রীও বলেছেন, সে রাজ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রয়োগ হবে না।

এসব দেখে এবং শুনে সিঁদুরে মেঘ দেখছে কেন্দ্র৷ আশঙ্কা করছে ‘বড়’ কিছুর৷ নাহলে স্রেফ ছেলেমানুষি করে তড়িঘড়ি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কেন সবার জানা কথাটাই ফের সামনে এনে জানালো, “এটি একটি কেন্দ্রীয় আইন। তাই ওই আইন সব রাজ্যেই প্রযোজ্য হবে। কোনও রাজ্য সরকারের তা আটকানোর অধিকার নেই”৷ এটা কখনই স্বাভাবিকত্বের লক্ষন নয়৷ আপাতত দেখা যাচ্ছে, মমতা-সহ ৬ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই দাবি করেছেন, NRC এবং CAA, একটিও তাঁরা প্রয়োগ হতে দেবেন না। মমতা একধাপ এগিয়ে
রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের ঘোষণা করেছেন৷

আরও পড়ুন-মানুষের ভোগান্তি বরদাস্ত নয়: মুখ্যমন্ত্রী

 

Previous article“এভাবেই উঠে আসবে আগামির কৃশানুরা”, মেয়র্স কাপের উদ্বোধনে গিয়ে আশাবাদী মেয়র
Next articleসিএএ, এনআরসি প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল কংগ্রেসের