Saturday, May 3, 2025

রমেডি অপেরার প্যাকেজ, চমকে দিল ব্রাত্যর ‘দেবদাস’; কুণাল ঘোষের কলম

Date:

Share post:

কুণাল ঘোষ

শরৎবাবুর আমলে পার্বতীর সঙ্গে প্রেম দিয়ে শুরু।

আর এই আমলে দশতলার এককামরা ফ্ল্যাটে চন্দ্রমুখীর সঙ্গে সংসার পাতা দিয়ে শেষ।

দেবদাস।

রোমান্স+ কমেডি+ স্যাটায়ার+ গান = এখন দেবদাস।

একটি অসাধারণ ‘রমেডি অপেরা’ দেখে এলাম।

মূল কাহিনি নিশ্চয়ই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু বহুব্যবহৃত ‘দেবদাস’কে ব্রাত্য বসুর অভিভাবকত্বে ‘দমদম ব্রাত্যজন’ যেভাবে টাইম মেশিনের যাত্রী করে বড়দিনের সন্ধেতে মিনার্ভার মঞ্চে এনে ফেলল, যা দেখার পর মন ভরার পাশাপাশি বিস্ময়ের ঘোর থাকবে, এমনও হতে পারে !

উদ্ভাবনী শক্তির সফল প্রয়োগ কাহিনির মোচড়ে, সময়ের রূপান্তরে, সার্বিক উপস্থাপনায় এবং বিশেষভাবে গানের ব্যবহারে।

দেবদাস মানে একটা বিরহ, মাতলামি আর মহা কান্নাকাটির প্যানপ্যানে গতিহীন ব্যাপার, সেই ধারণা চুরমার।
এই দেবদাস প্রেম, বিরহ, নেশাটেশার মূল ঘেরাটোপে থেকেও ফুলটুস বিনোদনপ্যাকেজ।
সঙ্গে সমকালীন উপসর্গ ও উপদ্রব।
দেবদাসের বাবা গ্রামে মোবাইল টাওয়ার বসাচ্ছেন, তাই নিয়ে বিবাদ।
দেবদাস কলকাতা যাওয়ার আগে পার্বতীকে মোবাইল সিম দিয়ে যাচ্ছে, ফোনে কথা হচ্ছে।
পার্বতীর বাবা 1971সালের আগের নথিপত্র বার করে রাখতে বলছেন স্ত্রীকে।
চুনিলাল বলছে তার নাম রুবি রেড।
চন্দ্রমুখী 2000 টাকার নোট নিয়ে চিন্তিত, যদি হঠাৎ বাতিল হয়ে যায়! চিন্তা তাদের পেশায় জিএসটি নিয়েও!!
এদিকে মাঝেমধ্যেই দুমদাম এনকাউন্টার করছে পুলিশ।

সংলাপ বা পরিস্থিতিগত কমেডির সঙ্গে স্যাটায়ার মিশে তাকে আরও তীক্ষ্ণ করেছে।

দেবদাস শহরে পোস্টার দেখে অবাক, “গোয়েন্দা দেবদাস” বা ” বিরহকাতর হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে দেবদাস” বায়োপিক !! প্রযোজকদের নামও দেখার মত, ইঙ্গিতবাহী।
গোয়েন্দা সিরিজ আর বায়োপিকের হুজুগে থাকা সিনেমা নির্মাতাদের পশ্চাৎদেশে একটি প্রবল চিমটি !!

তবে কৃতিত্ব এটাই, সমকালীন বিষয়গুলি আনতে গিয়ে কখনও মূল গল্পটি বিব্রত হয় নি; উপাদানগুলিকে বোঝা মনে হয় নি; দর্শকের সাড়া বলে দিয়েছে তাঁরা উপভোগ করছেন। দেবদাস এখন আমাদের আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে। দেখছে এবং দেখাচ্ছে।

এবং গান। অসাধারণ ভাবনা ও প্রয়োগ। কালজয়ী হিন্দি গানের বঙ্গানুবাগ ও বাংলা গান, পরিস্থিতি অনুযায়ী বারবার নতুন মাত্রা দিয়েছে। যে তরুণ তরুণী আগাগোড়া মঞ্চে বিবেক বা পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় থেকে নাচে গানে অপেরা ফিলিংস দিয়ে গেল, সেই দুই গায়েন অরুণাভ দে ও সুচন্দ্রা ভট্টাচার্য একশোয় একশো। মাঝে মাঝে তারা মঞ্চে না থাকলে চোখ তাদের খুঁজতে বাধ্য হচ্ছিল। এরা এই গোটা আয়োজনের অন্যতম দুই স্তম্ভ। নাচ এবং গানেও তুখোড়।

নাটক সুদীপ সিনহা। পরিচালনা প্রান্তিক চৌধুরি। অন্ত্রপ্রণর প্রদীপ মজুমদার। মঞ্চ ও আলো পৃথ্বীশ রানা। আবহ দিশারী চক্রবর্তী। কোরিওগ্রাফি ও ফাইট প্রসেনজিৎ বর্ধন। আরও যার যার যা দায়িত্ব ছিল, সফল নিশ্চিতভাবে। ফ্ল্যাশব্যাক বা হ্যালুসিনেশন যেভাবে এসেছে মঞ্চে, তাতে পরিচালক ও তাঁর টিম চূড়ান্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

অভিনয় প্রাণবন্ত। বিশেষভাবে বলব দেবদাস সুমিত কুমার রায়। গোটা মঞ্চজুড়ে সব রকম শেডে ফাটিয়ে অভিনয় করে ছেলেটি। এ লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। অল্প বয়সের প্রেম, বিরহ, ভুলবোঝা, দূরত্ব, ফিরে পেতে চাওয়া, ধাক্কা, চন্দ্রমুখীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, সেখানেও গোলমাল, বাবা মায়ের কাছ থেকে আঘাতে তীব্র অভিমান- সুমিত অবাক করা অভিনয় করেছে। সাবলীল, স্বচ্ছন্দ।
পার্বতী দেবলীনা সিংহ ও চন্দ্রমুখী দেবযানী সিংহ এমনিতে দুই বোন। সুন্দর যথাযথ এবং কিছু ক্ষেত্রে সাহসী পারফরমেন্স দেখালো। বাল্যপ্রেম থেকে শেষদিকে নতুন সংসারের চৌকাঠ থেকে দেবদাসকে তাড়ানো; স্কুলড্রেস থেকে গৃহবধূ এবং মা; দেবলীনা পার্বতীকে এঁকেছে অতিযত্নে। আবার বাইজির পোশাক থেকে স্বপ্ন দেখা সালোয়ার কামিজের তরুণী, দেবযানী অবাক করে দিয়েছে। দুই বোন বাংলা নাটককে সমৃদ্ধ করবে, সেই ছাপ স্পষ্ট। চুনিলাল চরিত্রটিতেও যে ছেলেটি অভিনয় করল, সুমন্ত রায় ছকভাঙা, দারুণ।

বাড়াবাড়ি ভাববেন না, দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এই চরিত্রগুলি সায়গল, সৌমিত্র বা শাহরুখের ছবির কপিবুক ক্যারেকটার নয়। নির্দেশক ও কারিগর সময়ের ভাঙাগড়ায় এদের কাজ অনেক কঠিন করে দিয়েছেন। সেই পরীক্ষাতে এরা উত্তীর্ণ। বাংলা বা হিন্দি ছবি ভাবুক কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা গেলে বিদেশে শুটিং না করেও, কম্পিটারের খেলা না খেলেও মস্তিষ্কের ধূসর অংশের ব্যবহারে শুধু একটা টিমের পারফরমেন্সেও দর্শককে চমকে দেওয়া যায়।

প্রথমার্ধ যখন শেষ হচ্ছে তখনও গ্রামীণ পরিবেশ।
বিরতির পর পর্দা উঠতে ডিস্কো থেকে সানগ্লাস পরা দেবদাস, যাকে তাড়াচ্ছে বাউন্সার!

আগাগোড়া চমক রাখা আছে, যাকে একবারও আরোপিত বলে মনে হয় নি।

দর্শকাসনে প্রথম সারিতে বসেই প্রদর্শন দেখলেন মুখ্য কারিগর ব্রাত্য, সঙ্গে পৌলমী। একজন নাট্যকার বা অভিনেতার ব্যান্ড ব্রাত্যজন যখন ফ্যানচাইজিগুলিকেও প্রতিষ্ঠা করে ফেলে, তখন সেই বিরলতম ঘটনার কারণ খুঁজতে দমদম ব্রাত্যজনের দেবদাসকে সামনে রাখা যেতেই পারে।

চোদ্দবছর আগে লন্ডনের স্যাফটসবেরি থিয়েটারে দেখেছিলাম ‘ দি ফার প্যাভিলিয়ন।’ কাহিনি অবশ্যই আলাদা। কিন্তু মিনার্ভার বড়দিনের মঞ্চের সফল নতুন আঙ্গিকের উপস্থাপনা মনে করিয়ে দিল বিলেতসন্ধের স্মৃতি।

অথচ এতসবের মধ্যেও প্রেম আর বিরহের যন্ত্রণাটা হারিয়ে যায় নি। সবরকম ভাঙচুর আর পরীক্ষানিরীক্ষাতেও সেই চিরন্তন অনুভূতিটা আগলে রেখেছে এই দেবদাস।

সায়গল, সৌমিত্র, শাহরুখকে শেষ দৃশ্যে মরতে হয়েছে।
এখানে দেবদাস চন্দ্রমুখীর হাত ধরে দশতলার এককামরার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে আকাশ দেখে। আজকের দেবদাস মরে না, সব যন্ত্রণা বুকে নিয়েও বাঁচার পথেই হাঁটে।

সায়গল, সৌমিত্র, শাহরুখকে কিন্তু 2020র প্রাকমুহূর্তে এসে হারিয়েই দিল শ্রীমান সুমিত।

অভিনন্দন ব্রাত্য।

আমি নাট্যবিশেষজ্ঞ নই। তবে সচেতন দর্শক বটে। সেই পরিচয়ই অনুরোধ থাকল, দেখে আসুন নতুন দেবদাসকে। গ্রুপ থিয়েটার যে কতটা শক্তিশালী, তারা যে এখন যে কোনও মাধ্যমের বিনোদনকে টক্কর দিচ্ছে, তার ঝলমলে প্রতীক হিসেবে দেখে আসুন আজকের দেবদাসকে।

spot_img

Related articles

একনজরে আজ পেট্রোল-ডিজেলের দাম 

৩ মে (শনিবার), ২০২৫কলকাতায় লিটার প্রতি পেট্রোলের দাম ১০৫.০১ টাকা, ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ৯১.৮২ টাকাদিল্লিতে লিটার প্রতি...

জেলে যৌন নির্যাতনের শিকার ইমরান! রিপোর্ট ঘিরে শোরগোল

রাওয়ালপিণ্ডির আদিয়ালা জেল বন্দি প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান (Imran Khan)। আর সেখানেই না কি তিনি যৌন নির্যাতনের...

রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্র! গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় ভারতকে টপকালো বাংলাদেশও

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারে সরব হয়েছিল ভারত। অথচ দেখা যাচ্ছে ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়া বাংলাদেশেও গণমাধ্যমের (mass media) স্বাধীনতা...

বিবাহ বিচ্ছেদের পথে যিশু! সারা-নীলাঞ্জনাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আনফলো অভিনেতার

দীর্ঘ একুশ বছরের দাম্পত্যে কি তাহলে পাকাপাকিভাবে বিচ্ছেদের সিলমোহর পড়তে চলেছে? যীশু সেনগুপ্ত (Jishu Sengupta)ও নীলাঞ্জনা সম্পর্ক নিয়ে...