Thursday, August 28, 2025

বইমেলায় বইচুরি ? একটা শুধু শর্ত আছে

Date:

Share post:

অপু দে

[ দেশের পাঁচটি বৃহত্তম বাংলা গ্রন্থ প্রকাশনার একটি দে’জ পাবলিশিং-এর কর্ণধার সুধাংশুরঞ্জন দে’র সুযোগ্য পুত্র৷ ইতিমধ্যেই গ্রন্থ প্রকাশনার জগতে বিশিষ্ট স্থান অর্জন করে ফেলেছেন অপু৷
কলকাতা বইমেলার প্রাক্কালে তাঁর মজার অভিজ্ঞতার কথাই বলেছেন ]

বইমেলায় বইচুরি ? মোস্ট ওয়েলকাম ।

শুধু একটা ছোট্ট শর্ত আছে । যদি বই চুরি করতে গিয়ে চোর ধরা পড়ে , তাকে বইচুরির ওপর নির্ভুল বাংলা বা ইংরেজিতে একপাতার আর্টিকেল লিখতে হবে । কেন সে বই চুরি করে , এ-ব্যাপারে স্পষ্টভাবে তার নিজের বক্তব্য জানাতে হবে । তা হলেই সাতখুন মাফ । আর্টিকেল লেখো , জমা দাও , চুরির বই বগলদাবা করে বাড়ি চলে যাও । খেল খতম , পয়সা হজম ।

বইচোরদের শায়েস্তা করতে কয়েক বছর আগে ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড ‘ – এর তরফে এমনই একটা নিয়ম করা হয়েছিল । এবং প্রকাশক হিসেবে এই মজার নিয়মটাকে আমি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেছিলাম । সব দিক থেকেই এটা বেশ ভালো বন্দোবস্ত বলে মনে হয়েছিল আমার । বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে , আহা! কর্তৃপক্ষ কত সহৃদয় পদক্ষেপই না নিয়েছে , কোনও হুজ্জুতি নেই , অথচ ভেতরে ভেতরে ব্যাপারটার মধ্যে পুরোদস্তুর ভয়ের আবহাওয়া গমগম করছে৷ অনেকটা পরীক্ষায় ফেল করার মতো । আর্টিকেল লেখার এই আচমকা চ্যালেঞ্জ উতরাতে না পারলে জনসমক্ষে আত্মসম্মান নিয়ে টানাটানির সম্ভাবনাও উজ্জ্বল । ভেবেছিলাম , এই নিয়ম প্রতি বছর বইমেলাতেই প্রযোজ্য হবে৷ সেই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়নি ।

◾◾

অনেক বইচোর দেখেছি । অনেক বইচোরকেই বামাল-সহ ধরেছি । হিসেব করলে, এখনও পর্যন্ত , হাফ-সেঞ্চুরি নিঃসন্দেহে হয়ে গিয়েছে । মনে আছে, জীবনের প্রথম বইচোর-কে পাকড়েছিলাম কলকাতা বইমেলায়, আমাদের দে’জ পাবলিশিং-এর স্টলে। তখন আমার বয়স তেরো-চোদ্দো হবে।
খুব ছোটোবেলা থেকেই আমি বইমেলার স্টলে বসতাম৷ প্রথম-প্রথম আমার কাজ ছিল ক্যাশ মেমোতে ডেলিভারি স্ট্যাম্প মারা৷ আস্তে আস্তে অন্য পোস্টে প্রোমোশন হয় । বইমেলায় আমাদের স্টলে কোথায় কী বই রাখা আছে সে-সব আমার মুখস্থ থাকত । লেখকের নাম বা বইয়ের নাম শোনামাত্রই বলে দিতে পারতাম স্টলের কোন দিকে সেই বইটা সাজানো রয়েছে । লোকজন আশ্চর্য হয়ে যেত । অনেকে আবার বিশ্বাসই করত না যে , এতটুকু একটা ছেলে স্টলে বসতে পারে । কেউ কেউ ভাবত , আমি বুঝি কোনও অভিভাবকের সঙ্গে দে’জ- এর স্টলে বই দেখতে বা কিনতে এসেছি । বইচোরদের এই অনভিজ্ঞতা , এই দুর্বলতার জায়গাটাই আমি কাজে লাগাতাম । আমি যে ‘ওয়াচম্যান’ এই সন্দেহটা তারা করত না । তাছাড়া , আমার ভেতরে কেমন একটা ‘ইনস্টিংকট’ কাজ করত । যাকে দেখে একবার সন্দেহ হত এই লোকটা বই চুরি করতে পারে , তার পিছু ছাড়তাম না । অলক্ষ্যে নজর রেখেই চলতাম এবং ঘটনাচক্রে দেখা যেত সেই লোকটা সত্যিই বইচোর ।

তো , এমনই সন্দেহের বশে সেবার দুটো ছেলেকে অনেকক্ষণ ধরে ‘ফলো’ করছি । তাদের বয়স আমার চেয়ে সামান্য বেশি৷ স্টলের এখানে – ওখানে গিয়ে তারা নানারকম বই উল্টেপাল্টে দেখছে । নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে । একসময় একজন টুক করে একটা বই তার ঝোলায় ভরে নিল । যদ্দূর খেয়াল হচ্ছে , বইটা ছিল গায়ক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান নিয়ে লেখা । অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনায় ছেলে দুটো খেয়াল করেনি , আমি ওদের ঠিক পিছনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছি । অপারেশন সেরে তারা যেই না স্টলের অন্যদিকে যাবে , আমি শান্ত করে বললাম, দাদা , বইটা ফেরত দিন । ওরা তো ঘাবড়ে গিয়েছে৷ একজন তোতলাতে – তোতলাতে বলল , কোন বই ?
আমি আরও ঠান্ডা গলায় বললাম , যে বইটা এক্ষুনি ঝোলায় ভরেছেন ।
এরপর বেচারা আর কী করে ! কাঁচুমাচু মুখে বইটা বের করে দিল । আমি বইটা নিয়ে সোজা ক্যাশ মেমো করতে দিয়ে দিলাম৷ এটা একটা অলিখিত নিয়ম । বই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে বইটা আপনাকে কিনতে হবে । পরে , এই নিয়মটাকে আমি আরেকটু কড়া করেছি । এখন বই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে আপনাকে বই তো কিনতেই হবে , উপরন্তু কোনও ডিসকাউন্ট পাবেন না । যাই হোক , ক্যাশ মেমো করতে দেওয়া ছাড়া আমি কিন্তু সেবার বাড়তি কোনও হইচই করিনি । পাঁচজনকে জড়ো করে সালিশি বসাইনি । একবারও জিগ্যেস করিনি – ভাই , কেন বই চুরি করলে ? আমার আচরণে চোর ছেলেটাও হয়তো একটু অবাক হয়েছিল । টাকা পেমেন্ট করে বই নিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে আলতো ভঙ্গিতে বলেছিল, সরি , এই লাইনে প্রথমবার তো , তাই !
আজও মাঝে – মাঝে কথাটা মনে পড়ে ।
আরেকবার একজন ধোপদুরস্ত প্রৌঢ়কে ধরার পর যেই না বলতে যাব বইটা আপনাকে কিনতে হবে কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই তিনি বলেছিলেন ‘ বইটা চট করে বিল করে দিন তো ! ‘ বিল মিটিয়ে তিনি হুড়মুড়িয়ে স্টল থেকে বেরিয়ে যান । স্মৃতি যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে , সেবারের বইমেলায় ওই ভদ্রলোককে আর আমাদের স্টলে দেখিনি ।

◾◾

প্রতি বছর বইমেলাতে যখন বই নিয়ে যাই , মেনে নিই যে , যত টাকার বই নিয়ে যাচ্ছি তার এক – দু ‘ পার্সেন্ট ক্ষতি হবেই । মানে , কিছু বই চুরি যাবে৷ শতচেষ্টা করেও আটকাতে পারব না । আমি কেন , সব প্রকাশকই এই হিসেবটা মাথায় রাখেন । কিন্তু এরকম মানসিক প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও একবার মেজাজ সংবরণ করতে পারিনি । রাগে – হতাশায় বইচোরের গায়ে হাত তুলেছিলাম , যা আমার স্বভাববিরুদ্ধ ।
সে-বছর , পরে হিসেব করে দেখেছি , আমাদের স্টল থেকে প্রায় ৩০ হাজার বই চুরি গিয়েছিল৷ এবং চুরির ঘটনাটা ধরা পড়ে বইমেলার শেষদিন , তাও মেলা শেষ হওয়ার ঘণ্টা চার – পাঁচেক আগে ।
একটি ছেলে একক প্রচেষ্টায় এই দুঃসাহসিক কাণ্ড ঘটিয়েছিল ।
তার চুরির টেকনিক এত বুদ্ধিদীপ্ত , প্রশংসা না করে পারা যায় না ।
ভিড়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে , বইমেলাতে সাধারণত একাধিক কাউন্টার খোলা হয় । স্টল থেকে বই কিনলে , সংলগ্ন কাউন্টারের স্টাফ সঙ্গে সঙ্গে ক্যাশ মেমো করে দেবে । সেই ক্যাশ মেমো থাকবে আপনার কাছে , আর বই চলে আসবে মূল কাউন্টারে ।
এবার যখন আপনি মূল কাউন্টারে আসবেন , তখন ক্যাশমেমো অনুযায়ী আপনার থেকে টাকা নেওয়া হবে এবং পাশের ডেলিভারি কাউন্টার থেকে আপনার কেনা বই আপনাকে বুঝিয়ে প্যাক করে দেওয়া হবে । এই চোর-ছেলেটা করত কী, ‘In’ লেখা দরজা দিয়ে স্টলে ঢুকে র‍্যান্ডম বই কিনত । আমাদের টেম্পোরারি কাউন্টারের স্টাফ সেইসব বইয়ের বিল করে দিত । বই চলে আসত মূল কাউন্টারে । ক্যাশ মেমো থাকত ছেলেটার হাতে । কিন্তু ছেলেটা ক্যাশ মেমো নিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে আসত না । ও ক্যাশ মেমোগুলো পকেটে ভরে ‘Out’ লেখা দরজা দিয়ে সোজা স্টলের বাইরে চলে যেত । ‘Out’ গেটে যে রক্ষী আছে , সে তাকে আটকাতো না । কারণ ছেলেটার কাছে তো কোনও বই নেই । পকেটে ক্যাশমেমো রয়েছে , কিন্তু পকেট সার্চ করার প্রশ্ন আসে না । এভাবে , একবার বাইরে যেতে পারলেই কেল্লা ফতে ।

কীরকম ?

না, বাইরে গিয়ে ছেলেটা ক্যাশমেমোগুলোর ওপর দে’জ – এর নিজস্ব ‘Paid ‘ লেখা রবার স্ট্যাম্পের ছাপ মেরে নিত । কী করে জানি না আমাদের দোকানের হুবহু ‘Paid ‘ স্ট্যাম্প ও জোগাড় করেছিল । তারপর ‘Paid ‘ স্ট্যাম্প মেরে , ক্যাশমেমোগুলো পকেটে ভরে সে ‘ In ’ গেট দিয়ে ফের আমাদের স্টলে ঢুকত এবং সোজাসুজি ডেলিভারি স্টলে গিয়ে বই চাইত । আমরা ‘Paid ‘ লেখা ক্যাশমেমো মিলিয়ে ওকে বই দিয়ে দিতাম । সংশয়ের অবকাশ কোথায়! এই ফন্দি করে ছেলেটা আমাদের প্রায় পথে বসিয়েছিল । রাতে হিসেব মেলাতে গিয়ে আমরা জেরবার । দেখছি যত টাকার বই বিক্রি হয়েছে , সেই পরিমাণ ক্যাশ আমাদের হাতে জমা পড়েনি । অথচ নিয়মে কোনও গরমিল নেই । কী করে হচ্ছে তবে চুরি ?

যদি ছেলেটা আরেকটু মাথা ঠান্ডা রাখতে পারতো , আমরা হয়তো এত বড় জোচ্চুরিটা কোনওদিন ধরতেই পারতাম না । এখানে বলে রাখি , ছেলেটা কিন্তু কোনও দিগগজ পড়ুয়া বা অর্থাভাব-পীড়িত বইপ্রেমী নয় । সে একজন সাদামাটা চোর । যে কোনও বই চুরি করে চোরাবাজারে বেচতে পারাটাই ওর চৌর্যবৃত্তির লক্ষ্য । বই ডেলিভারি নেওয়ার সময় ও প্রতিদিন একসঙ্গে পাঁচ-ছ ‘ টা করে ক্যাশ মেমো নিয়ে আসতো ৷ প্রত্যেকটা ক্যাশমেমোতে আবার সাত – আটখানা করে বই । উদ্দেশ্য সহজ । একদানে যতগুলো সম্ভব বই হাতিয়ে নেওয়া । কিন্তু একসঙ্গে অনেকগুলো ক্যাশমেমো যখন থাকে , তখন সব দোকানেই গ্র্যান্ড টোটাল-টা প্রথম পাতায় যোগ করে দেওয়া হয় ।
সেবার বই ডেলিভারি দেওয়ার সময় আমাদের স্টাফ হঠাৎ দ্যাখে যে, একাধিক ক্যাশমেমো থাকা সত্ত্বেও গ্র্যান্ড টোটাল-টা প্রথম ক্যাশমেমোতে যোগ করে দেওয়া হয়নি । কী ব্যাপার ! এমন হওয়ার তো কথা নয় ! তার মনে সন্দেহ হয় । ছেলেটাকে জিগ্যেস করে, ‘ দাদা , আপনি যেন কত টাকা দিয়েছেন ? ’ দেখা গেল , ছেলেটা যে উত্তর দিচ্ছে , তার সঙ্গে গ্র্যান্ড টোটাল মিলছে না । মানে গ্র্যান্ড টোটাল যদি বারোশো হয় , ছেলেটা বলেছে, আমি হাজার টাকা দিয়েছি । কখনও বলছে , পনেরোশো দিয়েছি । অর্থাৎ একেক বার একেক রকম কথা । সেটাই স্বাভাবিক । বইমেলা আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে, এই সময় একজন চোর কোমর বেঁধে বইচুরি করবে , না ক্যাশ মেমো-তে গ্র্যান্ড টোটালের হিসেব করবে ! ছেলেটার অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে আমাদের সন্দেহ বদ্ধমূল হয় । সবাই মিলে ভালমতো জেরা করতেই চুরির ব্যাপারটা ধরা পড়ে গেল । ওকে যখন হাত মুচড়ে গিল্ডে এর অফিসে নিয়ে যাচ্ছি , তখন ছেলেটা চেষ্টা করেছিল চুপিসাড়ে জামার ভেতর থেকে নকল রবার স্ট্যাম্প ফেলে দিতে, পারেনি । দিতে পারলে ওর ধারাবাহিক কুকীর্তি প্রমাণ করা কঠিন হত । ছেলেটাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম । কয়েকদিন শ্রীঘরেও ছিলো৷ কিন্তু টাকার গচ্চাটা আমাদের মেনে নিতে হয় । এরকম গেরোয় যাতে আর না পড়ি সেজন্য বইমেলাতে এখন নতুন নিয়ম চালু করেছি । ‘Paid ’ লেখা নকল রবার স্ট্যাম্প দিয়ে এবার আমাদের ঠকানো মুশকিল ।

◾◾

মাস দুয়েক আগের ঘটনা৷ কলেজ পড়ুয়া দুজন বইচোর ধরেছি৷ থুড়ি ধরেছিলাম আসলে একজনকে ! যে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে । জেরার মুখে সে স্বীকার করল , তার সঙ্গীও একটা বই চুরি করেছে । কোথায় সেই সঙ্গী ? বােঝা গেল , হাওয়া গরম দেখে সে পিঠটান দিয়েছে । ঝগড়াঝাটি না করেও এই ধরনের পরিস্থিতি কী করে সামলাতে হয় , এতদিনে সেই অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে । ঠান্ডা মাথায় ছেলেটাকে বললাম , তোমাকে বইটা কিনতে হবে । সে বলল , টাকা নেই । এটাই যে বলবে , জানতাম। ওকে এবার বললাম , তা হলে বন্ধুকে ডাকো । দ্যাখো , দুজনে মিলে যদি কেনা সম্ভব হয় । ফার্স্ট ইয়ারের বইচোর ফোন করে তার বন্ধুকে ডাকল । বন্ধুটি তুলনায় বড় , থার্ড ইয়ারে পড়ে । অভিজ্ঞতাতেও কিঞ্চিৎ সমৃদ্ধ । সে প্রথমেই আমার সঙ্গে তর্ক জুড়ল । তার প্রতিপাদ্য সে বই চুরি করেনি । তখন আমি প্রয়োগ করলাম ব্রহ্মাস্ত্র । বললাম , হতে পারে । হয়তো তুমিই ঠিক বলছ । কিন্তু তুমি যদি ঠিক বলো , তা হলে তোমার বন্ধু ভুল বলছে । মানে , ও নিজে ফেঁসেছে বলে তোমাকেও কেস খাওয়ানোর চেষ্টা করছে । আর যদি তোমার বন্ধু ঠিক বলে , তবে তুমি মিথ্যে বলছ । ভাল করে ভেবে দ্যাখো , তোমাদের মধ্যে কে ঠিক বলছে । ভেবেছিলাম , ওরা নিজেদের মধ্যে কাজিয়া শুরু করবে । কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম , এরকম কঠিন পরিস্থিতিতেও ছেলে দুটির পারস্পরিক নির্ভরতা টোল খেল না । ওরা সত্যিকারের ভাল বন্ধু । কেউই চায় না , তার জন্য বন্ধুর অসম্মান হয় ।

শেষে থার্ড ইয়ারের ছেলেটি স্বীকার করল যে , সে বই চুরি করেছে । বইটা বনসাই চর্চা সংক্রান্ত । কেন চুরি করেছ ? উত্তরে জানাল , এই বইটা সে বাবাকে উপহার দেওয়ার জন্য চুরি করেছিল । পকেটে যথেষ্ট টাকা থাকলে চুরি করত না , কিনেই বাবাকে দিত ।
সব জেনে , সব শুনে আমি সেদিন একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম । আজ আমাদের প্রকাশনা যে – স্তরে উন্নীত হয়েছে , আমাদের ব্যবসার পরিধি যত দূর সম্প্রসারিত হয়েছে — সেই সাফল্য | কিন্তু একদিনে আসেনি । এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে কঠিন আর্থিক যুদ্ধ , হার – না – মানা জেদ এবং সদিচ্ছা । আমি সেই ইতিহাস জানি । ‘পকেটে টাকা থাকলে বনসাই – এর বইটা কিনেই বাবাকে দিতাম ’ এটা শোনার পর আমি ছেলে দু ‘টোকে প্রতিশ্রুতি দিই যে , ভবিষ্যতে কোনও বই পড়তে বা কিনতে হলে তারা যেন চুরির পথে না হাঁটে । যেন আমাকে এসে একবার বলে । ওদের ইচ্ছে কতটা মেটাতে পারব জানি না , তবে একটা চেষ্টা করে দেখব ।
বই চুরি করে ধরা পড়েও , ছেলে দু ’ টো সেদিন হাসতে হাসতে ফিরে গিয়েছিল ।
ওদের স্বপ্নময় মুখ আমি অনেকদিন ভুলতে পারব না ।

◾◾

কেন লোকজন বই চুরি করে ?
কারণটা আমার কাছে আজও স্পষ্ট নয় । হয়তো মজা পায় বলে , হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে বাজি লড়েছিল বলে , হয়তো সত্যিই টাকা ছিল না কিন্তু বইটার দরকার ছিল । হয়তো , এটা একটা মানসিক নেশা । জানি না সত্যি কী জন্য বইচোর বই চুরি করে । তবে অন্যান্য চুরির থেকে বই চুরির একটা আলাদা মর্যাদা রয়েছে । চোরকে ধরতে পারলে প্রথমে রাগ হয় । পরে , সেই রাগ পড়েও যায় ।
একবার যেমন , একজন বন্ধুর মারফত একটা ছেলের সঙ্গে আলাপ হল । কিছুক্ষণ কথা বলার পর নতুন | ছেলেটি জানাল তোর দোকান থেকে কত বই যে ঝেড়েছি তুই জানিস না ! চুরির কথা স্বয়ং মালিককে কেউ যে এমন বুক বাজিয়ে বলতে পারে , এমন ধারণা ছিল না । শুনে প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম । অথচ ছেলেটার ওপর রাগ করতে পারিনি । দিব্যি হাসি – ঠাট্টা করে বাকিটা সময় কাটিয়েছিলাম । | কেন রাগ করতে পারিনি ? শক্ত – শক্ত দু ‘ চার কথা কেন সেদিন বলতে পারিনি ? বহুবার নিজের মনে – মনে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি । শেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে — তুমি যত বড় ব্যাসটম্যান – ই হও , শূন্য রানে তোমাকেও একদিন আউট হতে হবে । আমি হয়তো বইচোর ধরার ম্যাচে হাফ – সেঞ্চুরি করেছি , কিন্তু এমনও তো দিন গিয়েছে যেদিন একটাও রান পাইনি , আমার উপস্থিতিতে আমার দোকান বা স্টল থেকে বইচোর কাজ সেরে সটকে পড়েছে ।
এটাই আমাদের জীবন , আমাদের বেঁচে থাকা । এখন , নিজের বেঁচে থাকার ওপর কত আর রাগ করা যায় ।

spot_img

Related articles

আজ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসে মেগা সমাবেশ, শহরে ঢল পড়ুয়াদের

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মহানগরীর রাস্তায় ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়, সকলের গন্তব্য গান্ধী মূর্তির পাদদেশ। আজ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (TMCP) প্রতিষ্ঠা...

সাত লুকের ‘বহুরূপ’ সোহমের, চ্যালেঞ্জ নিয়ে চমকে দিলেন অভিনেতা

যা কখনও হয়নি তা এখন হবে, এবার হবে। সেলিব্রেটিদের রিল - রিয়েলের আলাদা রূপ আর লুক নিয়ে কম...

উন্মুক্ত শৌচমুক্ত ৯৪ পুরসভা, স্বচ্ছতার শংসাপত্র বাংলাকে

শহরাঞ্চলে আর খোলা শৌচের দৃশ্য নেই। পুরসভাগুলির উদ্যোগ এবং পুর দফতরের তদারকিতে উন্মুক্ত শৌচমুক্ত হয়েছে কলকাতা সহ রাজ্যের...

ফাঁকা কেন্দ্রগুলিতে দ্রুত ইআরও–এইআরও নিয়োগের নির্দেশ কমিশনের 

ফাঁকা পড়ে থাকা একাধিক বিধানসভা কেন্দ্রে দ্রুত ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন আধিকারিক (ইআরও) এবং অ্যাসিসটেন্ট ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন আধিকারিক (এইআরও) নিয়োগের...