Saturday, November 15, 2025
কণাদ দাশগুপ্ত

এই কাজটা এতদিন অমিত শাহ-ই করতেন৷ গত কয়েকদিন যাবৎ সেই কাজটাই করছেন প্রধানমন্ত্রী৷ বাংলার ‘মন বুঝতে’ রাজ্যের বিজেপি সাংসদদের সঙ্গে পর পর বৈঠক করছেন প্রধানমন্ত্রী৷ ৫-৬ জনের সঙ্গে বসা হয়ে গিয়েছে, বসবেন বাকিদের সঙ্গেও।

হাজারো কাজে ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রী৷ CAA-NRC- NPR তো আছেই, দিল্লির সাম্প্রতিক হিংসা নিয়ে বিতর্ক এখনও তাজা৷ চলছে একাধিক মোকদ্দমা৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা-ভাইরাস৷ আন্তর্জাতিক স্তরে একাধিক ইস্যুতে চাপ বাড়ছে ভারতের। পরিস্থিতি সামাল দিতে রোজই বিবৃতি দিয়ে কিছু না কিছু বলতে হচ্ছে বিদেশ মন্ত্রককে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশনার সিএএ-বিরোধী মামলায় আদালতবান্ধব হিসেবে শামিল পর্যন্ত হতে চেয়েছে। ওদিকে নতুনভাবে চাপ বাড়িয়েছেন ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতোল্লা আলি খোমেনই। টুইট করে দিল্লির হিংসার ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন ইরানের এই রাষ্ট্রনেতা৷ ওদিকে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি পুরোপুরি তলানিতে না ঠেকলেও একদম ঝিমিয়ে আছে৷ সরকারি সম্পত্তি, সংস্থা বিক্রি করে, ব্যাঙ্ক- ইপিএফে সুদের হার কমিয়ে, বেসরকারি হাতে সরকারি সংস্থার ভার বা মালিকানা তুলে দিয়েও ঘুমিয়ে থাকা অর্থনীতিকে জাগিয়ে তোলা যাচ্ছেনা৷ দলীয় রাজনীতি বা সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও বাজছে হতাশার সুর৷ প্রধানমন্ত্রীর সেই ২০১৪ সালের ভাবমূর্তি তো কবেই ডুবেছে৷ ২০১৯-এর বিশ্বাসযোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতাও এখন বড় প্রশ্ন চিহ্নের সামনে৷ শুধুই পাকিস্তান দেখিয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে আনার খেলাও ধরা পড়ে গিয়েছে৷ স্রেফ প্রশাসনকে ব্যবহার করে নিজেদের ঠাট-বাট বজায় রাখতে হচ্ছে৷

ওদিকে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের দেরি প্রায় একবছর৷ তাহলে এখনই এত ধরনের জটিল ব্যস্ততার মাঝেও সাত তাড়াতাড়ি বাংলার সাংসদদের সঙ্গে
প্রধানমন্ত্রীর দফায় দফায় বৈঠক করার কারন কি ? ভোট হবে তো বিহারেও৷ ওই রাজ্য নিয়ে তো প্রধানমন্ত্রী এতখানি চিন্তিত বা সিরিয়াস নন! তাছাড়া এ সব বৈঠক তো প্রিলিমিনারি-স্তরের৷ প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন কোনও মন্ত্রী বা দলের কোনও পদাধিকারীকেও তো এই বৈঠকের ভার দিতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী৷ তেমন যোগ্য লোকের অভাব অবশ্যই আছে৷ অরুন জেটলি, সুষমা স্বরাজ নেই৷ ছক কষে রাজনাথ, গড়কডিদের পিছনের বেঞ্চে পাঠানো হয়েছে৷ সেখান থেকে তাঁদের সামনে এনে গুরুত্ববৃদ্ধি করার মতো ‘হারাকিরি’ করবেন না প্রধানমন্ত্রী৷ রাজ্য রাজ্য এ ধরনের কাজে এতদিন উপযুক্ত ভূমিকা নিতেন অমিত শাহ৷ শাহের ব্রিফিং-এর ভিত্তিতেই পদক্ষেপ করতেন প্রধানমন্ত্রী ৷ তাহলে এবার সলতে পাকানোর পর্যায় থেকেই কেন এত সক্রিয় প্রধানমন্ত্রী? শাহের কাজ নিজের ঘাড়ে কেন নিলেন তিনি ?
বাংলার সাংসদদের সঙ্গে
পর পর বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রী রাজ্যের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিস্থিতি এবং বঙ্গ- বিজেপির প্রকৃত অবস্থা শুনছেন প্রধানমন্ত্রী৷ দিনকয়েক আগে অমিত শাহ এবং বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা রাজ্যে এসে বৈঠক করে গিয়েছেন দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে৷ রাজ্য নেতারা এই দুই শীর্ষনেতাকে সব ধরনের কথাই বলেছেন৷ সেই বৈঠকেই তো ধরা গিয়েছে, এ রাজ্যের ক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যে বঙ্গ-বিজেপি ঠিক কী চাইছে দিল্লির কাছে৷ সেই একই কথা ফের কেন শুনছেন প্রধানমন্ত্রী ? তাহলে কী শাহ-নাড্ডা প্রধানমন্ত্রীকে পরিস্থিতি ব্রিফ করেননি ? নাকি, সেই ব্রিফিংকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনছেন না প্রধানমন্ত্রী?

রহস্য এখানেই৷ রহস্য একাধিক৷

এক) দিল্লি-ভোট এবং দিল্লি-হিংসা মোকাবিলার দায়িত্বে ছিলেন অমিত শাহ৷ দু’টি ক্ষেত্রেই ল্যাজে-গোবরে হতে হয়েছে বিজেপিকে৷ ভোটে দলের স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণে একের পর এক ভুল করেছেন শাহ৷ এক আঞ্চলিক দলের নেতার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী-সহ গোটা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা, ৯জন মুখ্যমন্ত্রী, গোটা দেশ থেকে তুলে আনা বাছাই করা হাজারখানেক নেতাকে দিল্লিতে নামিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে মহীরুহ বানিয়ে দিয়েছিলেন শাহ৷ কেজরি এত নম্বর পাওয়ার যোগ্য নন৷ শাহ নিজে সব কাজ ছেড়ে দিল্লি নিয়েই ছিলেন৷ তবুও কাজের কাজ কিছু হয়নি৷ বিজেপির ঝুলিতে যায় ৭আসন৷

দুই) দিল্লি-হিংসা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৷ অথচ দিল্লির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত এই শাহই৷ পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্দেশ দিয়ে আসরে নামান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালকে৷ নিজে ফোনে এবং সরাসরি কথা বলেন কেজরির সঙ্গে৷ ততদিনে বিশ্বজুড়ে ভারতের যতখানি ফেস-লস হওয়ার হয়ে গিয়েছে৷

এবং ততদিনে নিজের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যোগ্যতা সম্পর্কেও স্বচ্ছ একটা ধারনাও তৈরি হয়ে গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর৷ তিনি সম্ভবত বুঝেছেন
তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা ‘দক্ষিণহস্ত’-র চেহারার সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মস্তিষ্কের ফারাক আছে৷ আসলে সরকারি ক্ষমতার জোরে, সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে এদেশে কংগ্রেস-সহ প্রায় সব দলে সব সময়ে কিছু সুপার-লিডার দেখা গিয়েছে৷ ক্ষমতা অন্তর্হিত হলে যাদের আর খোঁজ মেলেনি৷ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই গোত্রের কি’না, তা ইতিহাস বলবে৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আর ঝুঁকি নিতে রাজি নন৷ তাই দেশের মানচিত্রে গেরুয়া রংয়ের পরিধি বাড়াতে নিজের হাতেই স্টিয়ারিং নিয়েছেন৷ বঙ্গের বিজেপি সাংসদদের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করছেন। প্রত্যেকের কাছ থেকেই লিখিত ভাবে বেশ কিছু প্রস্তাব ও পরামর্শ প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন৷ ৬ জন সাংসদ ইতিমধ্যেই তা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলেও দিয়েছেন। কথা হয়েছে
বাংলার সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের ‘এবিলিটি’ নিয়েও৷ বঙ্গ-বিজেপির অন্দর যে পুরোপুরি ‘সুস্থ’ নয়, তাও জেনে নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী৷ ‘ওয়ান টু ওয়ান’ অনেক বিস্ফোরক কথা বলার ‘সাহস’ও সাংসদরা পাচ্ছেন৷

একাধিক রাজ্যের বিধানসভা ভোটে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি জোর ধাক্কা খেয়েছে। দিল্লির ভোটের ফল সম্ভবত এখনও মানতে পারেননি তিনি৷ ২০২০-এ ভোট হতে পারে বিহারে। ২০২১-এ ভোট হতে পারে বাংলায়। এই দুই গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে দল জিততে পারলে, তাঁর হারিয়ে হওয়া ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ফিরবে বলে নিশ্চিত প্রধানমন্ত্রী৷ এটাই এখন একমাত্র লক্ষ্য তাঁর৷

আর এই ‘মিশন’-এ তিনি ফের বেলতলায় না যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷ সে কারনেই শত ব্যস্ততার মাঝেই প্রধানমন্ত্রী সময় বার করতে বাধ্য হচ্ছেন৷ নিরুপায় তিনি, গোটা দেশের বিজেপি কর্মী, সমর্থক, ভোটাররা তো একমাত্র তাঁর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছেন৷ সেই আশা ও ভরসার মর্যাদা তো প্রধানমন্ত্রীকে দিতেই হবে৷

ভরসাযোগ্য, দক্ষ, বিচক্ষণ এবং সর্বজনের কাছে গ্রহনযোগ্য মুখের অভাব কি সত্যিই প্রকট হয়ে উঠছে গেরুয়া শিবিরে !

Related articles

রবীন্দ্র সরোবরের ছয় ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি: সম্পূর্ণ আইনি পথে কর্পোরেশন

প্রায় পাঁচ দশক পর রাবীন্দ্র সরোবর চত্বরে অবস্থিত ছ’টি ক্লাবের সঙ্গে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক ভাড়ার চুক্তি করল কলকাতা...

বিহারে কমিশনের কারচুপি, তোপ অখিলেশের: ঘুরিয়ে কংগ্রেসকে কটাক্ষ ওমরের

বিহারে এসআইআর প্রয়োগ করে ভোটারদের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কংগ্রেস-আরজেডির (RJD) মহাজোটের এটাই ছিল বিহার নির্বাচনের মূল...

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কে: ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট JD(U)-এর!

বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ২৪৩ টি আসনের মধ্যে বিজেপি ৮৯ আসনে জয়ী। নীতীশ কুমারের জেডিইউ জিতেছে ৮৫ টি আসন।...

জাদুসম্রাটের বাড়িতে বিয়ের আসর! বিজ্ঞাপন দেখে পাত্র পছন্দ মৌবনীর

জিনা বন্দ্যোপাধ্যায় জনে জনে বার্তা রুটি গেল ক্রমে, বিয়ে করছেন মৌবনী শীতের মরশুমে! মেয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন পিসি সরকার, সেখান থেকেই পাত্র...
Exit mobile version