Saturday, August 23, 2025

কেরলে হাতির মৃত্যু ঘিরে আবেগের বন্যা বইছে। ফলের ভেতর (মিডিয়া বলছে আনারস) বাজি বা বোমা ছিল। সন্তানসম্ভবা হাতিটি সেই ফল খেতেই বিস্ফোরণ এবং মৃত্যু সাতাশে মে। ঘটনাটি কবে কোথায় ঘটেছিল জানা যায়নি। কারণ হাতি প্রচুর হাঁটে। তাই এই মর্মান্তিক মৃত্যুর পেছনে কারা আছে, সেটা জানা সম্ভব কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থাকছেই। বিরাট কোহলি থেকে পাড়ার দিদিমা-সবাই বলতে লেগেছেন, ব্যাটাকে ধরে জব্বর সাজা দে। সব জিনিসে রাজনীতি জুড়তে ওস্তাদ আমরা প্রশ্ন তুলছি বাম-রাজত্ব কেরলে কী করে ঘটল এমন ঘটনা? বামেরা অনেকে একটু ঢোঁক গিলে সাফাই দিচ্ছেন, আরে বাবা, তদন্তের নির্দেশ তো দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন।

জানা যাচ্ছে, এপ্রিলেও ওই এলাকায় এ ভাবে আরও একটি হাতির মৃত্যু হয়েছিল। হয়, বন্যপ্রাণী খুন হয় বারবার।চোরাশিকারীদের হাতে হয়। গ্রামের লোকের হাতে হয়। সব সময় হইচই হয় না। এবার এক IFS আবেগময় কয়েকটি লাইন লিখে হাতির মৃত্যুকালীন ভিডিওটি পোস্ট করায় গণআবেগের বিস্ফোরণ ঘটেছে। তার উপর হাতিটি আবার সন্তানসম্ভবা ছিল।

কথা হল, ফলের ভেতর বাজি বা বোমা রাখল কে? উত্তর হল, গ্রামের লোক। কেরল, তামিলনাড়ু, কর্ণাটকে এরকম হয়। শ্রীলংকাতেও হয়। বুনো শুয়োর আর শুয়োর ঠেকাতে গ্রামের লোক এই ব্যবস্থা করেন। বেআইনি তবু করেন। কারণ তাঁদের বাঁচতে হবে, ফসল বাঁচাতে হবে। তেমন কোনও ফল হাতি খেয়ে ফেললে তার মৃত্যুও হতে পারে, যেমন এ ক্ষেত্রে হয়েছে।

এখানেই কাহানি মে টুইস্ট। আমাদের রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলোর লোকেদের সঙ্গে কথা বললেও জানা যাবে কাহিনীর অন্য দিকটা।

উনিশশো সাতাশি থেকে দলমার হাতিরা দক্ষিণবঙ্গে আসতে শুরু করে। ঝাড়খণ্ড, ওডিশার জঙ্গলের কুড়ি থেকে পঞ্চাশটি হাতির দল সেপ্টেম্বরে শুরুতে এসে শীতের শেষে চলে যেত। গ্রামের লোক তখন তাদের দেবতা ভেবে পুজো করত। ভাবত, যেখানে হাতি দেখা গেছে সেখানে ফলন ভাল হবে। হাতি ফসল নষ্ট করলে ক্ষতিপূরণও চাইত না গ্রামের লোক।

পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলে বিরাট শাল জঙ্গল ছিল। মোটামুটি উনিশশো সাল থেকে পরের আশি বছর টানা ওই জঙ্গল কাটা হয়েছে। জঙ্গলে থাকা হাতিরা উদ্বাস্তু হয়েছে। আবার রাজ্যে সামাজিক বনসৃজন প্রকল্পে বড় বড় জঙ্গল তৈরির পর দলমার হাতিরা সেখানে আসা শুরু করে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যাচ্ছে ১৯৮৮-১৯৯১ সালের মধ্যে তৎকালীন মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলায় জঙ্গল বেড়েছে ৩১৫ বর্গ কিমি।

পর্যাপ্ত খাবার পাওয়ায় ক্রমশ হাতির সংখ্যা বাড়তে থাকে। পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রামে যত হাতি আসে তার দুই তৃতীয়াংশই আবার থেকে যায়। দলমার হাতিরা এখন দক্ষিণবঙ্গের হাতি হয়ে গেছে। ওডিশার হাতিদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে হাতির দল বর্ধমান, হুগলিতেও ছড়িয়ে পড়ছে।
ওই হাতিদের খাদ্যাভ্যাসও পাল্টে গেছে।
ধান-গম-লাউ-বাঁধাকপি-ফুলকপি-টম্যাটো-বেগুন-কচু-কলা-আখ-কাঁঠাল খেতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া হাতিরাই এখন গ্রামের লোকের শত্রু হয়ে গেছে। অত ফসল নষ্ট করলে শত্রু তো হবেই। বন দফতরের হিসেবে, ২০১৫ সালে শুধু বাঁকুড়া জেলাতেই ১৫৯৮ হেক্টর জমির ফসল আর ১৬৭৭টি বাড়ি হাতির হামলায় নষ্ট হয়েছে। সে বছর রাজ্যে হাতির হামলায় ১০৮ জন (দক্ষিণবঙ্গে ৭১ জন) মারা যান। মারা যায় ১৪টি হাতি।

কেন লোকালয়ে এত হাতি ঢুকে পড়ছে? প্রথম কথা, মানুষের উন্নয়নের ধাক্কায় জঙ্গলে খাবার ও জল কমে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, উন্নয়নের রাস্তা গিলে খাচ্ছে জঙ্গল, গিলে খাচ্ছে হাতিদের যাতায়াতের করিডর। তার ওপর দিয়ে তৈরি হচ্ছে জাতীয় সড়ক, রেললাইন। যেমন ধরা যাক, ঝাড়খণ্ডে বিরাট এলাকার জঙ্গল কেটে খনি হচ্ছে। সুবর্ণরেখা খাল হয়েছে। হাতিরা উদ্বাস্তু হয়ে যাচ্ছে, তাদের যাতায়াতের রাস্তা পাল্টে ফেলতে হচ্ছে।

এ তো গেল এই রাজ্যের হাতি বনাম মানুষের লড়াইয়ের কথা। এ লড়াই সারা দেশেই আছে। সারা দেশে ১৫-১৮ সালে ১৭১৩ জন (পশ্চিমবঙ্গে ৩০৭) মানুষ ও ৩৭৩ হাতি মারা গেছে। বাঘ, রয়্যাল বেঙ্গল, চিতাবাঘ, বাইসনের সঙ্গেও মানুষের এই লড়াই দেখা যায়।

ফসল-বাড়ি নষ্ট হচ্ছে, প্রাণ যাচ্ছে। ওইসব এলাকার মানুষের মনে তখন কাব্য আসে না। ভাবনা আসে। বন্যজন্তুকে ঠেকিয়ে নিজেদের বাঁচানোর ভাবনা।

হাতির মৃত্যুতে চোখের জল ফেলছি, রক্ত গরম করা লেখা লিখছি যাঁরা, তাঁরাই হয়তো অতি সম্প্রতি জঙ্গল কেটে বাড়ানো জাতীয় সড়ক দিয়ে গরুমারায় ঢুকে হাতির পিঠে চড়ে ঘোরার প্ল্যান করব। বেমালুম ভুলে যাব, সভ্যতার দম্ভ, মুনাফার লোভ কী ভাবে প্রজাতির পর প্রজাতি বন্যপ্রাণকে লোপাট করেছে। বন্যপ্রাণের সঙ্গে টিকে থাকার লড়াইয়ে ঠেলে দিয়েছে গরীব মানুষকে (প্রাচীন রোমের সেই লড়াই মনে পড়ছে নাকি?)।

ফসল বাঁচাতে-প্রাণ বাঁচাতে ছড়িয়ে রাখা বোমাভরা ফল খেয়ে হাতির মৃত্যুর পরে বড় বড় কথার ফুলঝুড়ি ছোটাচ্ছি, ওই লোকগুলো কত নারকীয় তার কাটাছেঁড়ায় ড্রইংরুম মাত করছি। কিছু দিনের মধ্যেই ভুলে যাব। বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু নাকি বড়জোড় এক বছর (কবিতায় লিখেছিলেন নাজিম হিকমত)।

অনেক শতাব্দী তো কেটে গেল। একটু পা চালিয়ে, বন্ধু!

Related articles

সঠিক পরিকল্পনাই ডায়মন্ডহারবারের সাফল্যের চাবিকাঠি, মনে করছেন আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

মাত্র তিন বছরের ক্লাব। কিন্তু কী অসাধারণ সাফল্য। কলকাতা লিগ, আইলিগ থ্রি থেকে আইলিগ টু জিতে এবার আইলিগের...

অসংগঠিত শ্রমিক-ক্ষেত্রে পথ দেখাচ্ছে বাংলা: সাহায্য পেলেন ৭২০ শ্রমিক

একের পর এক নতুন প্রকল্প, অসংগঠিত শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে লাগাতার আলোচনা, তাঁদের পরিবারের প্রতি নজর রাখার ব্যাপারে তৎপর...

প্রাপ্য চায় বাংলা, উপহার না: মোদিকে জবাব তৃণমূলের

বাংলার মানুষ উপহার চায় না, প্রাপ্য চায়। উপহার দিয়ে বাংলার মানুষকে অপমান করবেন না। বাংলায় বরাদ্দ নিয়ে শুক্রবার...

অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ব্যর্থ শাহ, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা মোদির: কটাক্ষ তৃণমূলের

অনুপ্রবেশ ইস্যুকে বার বার জাগিয়ে তুলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আদতে নিজেদের ভুল নিজেরাই চোখ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।...
Exit mobile version