Sunday, November 16, 2025

মানবসেবার সংকল্পে মাত্র ৫০ টাকায় ডায়ালিসিস করছেন “কমিউনিস্ট চিকিৎসক” ফুয়াদ হালিম

Date:

সোমনাথ বিশ্বাস

করোনা আবহ। আমফান বিপর্যয়। তলানিতে অর্থনীতি। এমন দুর্মূল্যের বাজারে বড় অসুখের চিকিৎসা সাধারণ গরিব মানুষের কাছে কার্যত অলীক কল্পনা। সেখানে মাত্র ৫০ টাকায় ডায়ালিসিস! ভাবছেন রসিকতা? একেবারেই নয়, গল্প মনে হলেও এটাই সত্যি! তাও আবার কলকাতার মতো শহরে। যেখানে বিড়ালে আঁচড় দিলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে লাখ টাকার বিল হয়। সেখানে কিনা ৫০ টাকায় ডায়ালিসিস!

হ্যাঁ, এমনই আসাধ্য সাধন করেছেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ফুয়াদ হালিম। কলকাতা শহরের বুকে চিকিৎসক হিসেবে যেমন পরিচিতি, ঠিক একইভাবে আরও একটি পরিচয় আছে তাঁর। তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রয়াত হাসিম আব্দুল হালিমের সুযোগ্য পুত্র। হাসিম আব্দুল হালিম ১৯৮২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাম জমানায় দীর্ঘ ২৮ বছর বিধানসভার অধ্যক্ষ-এর আসন অলঙ্কৃত করেছেন। ডাক্তারির পাশাপাশি বাবার পথ ধরেই ফুয়াদ হালিমও সক্রিয় কমিউনিস্ট রাজনীতিতে এসেছেন। সিপিএমের হয়ে ভোটেও লড়েছেন।

রাজনীতি যেমন সমাজসেবার অংশ, ঠিক একইভাবে চিকিৎসাও পেশার পাশাপাশি মানবসেবার সংকল্প। তাই পেশাদার চিকিৎসক হওয়া সত্বেও ফুয়াদ হালিম ভুলে যাননি মানবসেবার দিকটিও। যাকে বলে খাঁটি কমিউনিস্ট। ফুয়াদ হালিম তেমনই একজন “কমিউনিস্ট চিকিৎসক”। যাঁর কাছে পেশার চেয়েও মানবসেবাই অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। আর সেই কারণেই কলকাতার মতো বেসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয় বহুল এক শহরে মাত্র ৫০ টাকায় ডায়ালিসিস করে “দুঃসাহসিকতা” দেখাতে পারেন ফুয়াদ হালিমের মতো চিকিৎসকরা। হ্যাঁ, খোদ পার্ক স্ট্রিটে (১২ নম্বর কিড স্ট্রিট, এমএলএ হোস্টেল গলি) “কলকাতা স্বাস্থ্য সংকল্প”-এ লকডাউনের পর থেকেই ফুয়াদ হালিমের তত্ত্বাবধানে চলে আসছে ৫০ টাকায় ডায়ালিসিস। যেখানে মানুষ আসছেন, চিকিৎসা করাচ্ছেন, সুস্থ হয়ে নিজে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন।

কিন্তু অর্থনীতি বলে একটা বিষয় আছে। সেটাকে তুড়ি মেরে এটা কীভাবে সম্ভব? খুব সহজ অঙ্কে হিসেব বুঝিয়ে দিলেন ফুয়াদ হালিম। তাঁর কথায়, প্রথম শর্তই হলো পেশার পাশাপাশি চিকিৎসাকে সেবা হিসেবে নিতে হবে। তাহলে এই দুনিয়ায় কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।

ফুয়াদ হালিমের কথায়, “কলকাতা স্বাস্থ্য সংকল্প” কোনও বড় হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত নয়। কোনও কর্পোরেট গোষ্ঠীর সঙ্গেও এর কোনও যোগ নেই। তাই কর্পোরেট খরচও নেই। অর্থাৎ, এখানে প্রচুর স্টাফ, সিইও, ঝাঁ-চকচকে ব্যাপার নেই। নেই বাতানুকূল ব্যবস্থাও। শুধুমাত্র চিকিৎসার জন্য যেটুকু না হলেই নয়, তেমনটাই পরিকাঠামো এই চিকিৎসা কেন্দ্রের। ফুয়াদ হালিমের দাবি, ডায়ালিসিস করতে গেলে বাতানুকূল পরিবেশের প্রয়োজন নেই। ফলে এমন সব বাড়তি খরচ এখানে নেই। অন্য জায়গায় কর্পোরেট চার্জ নেয়, তাই তাদের বিল লম্বা হয়।

একইসঙ্গে তিনি জানান, এই সংস্থার সঙ্গে তাঁর ছোটবেলার স্কুলের সঙ্গীরও জড়িত। যাঁরা এখন সমাজে নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের সকলের প্রচেষ্টায় অনেকটাই অর্থ সংস্থান হয়। পাশাপাশি, অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা “কলকাতা স্বাস্থ্য সংকল্প”-এর সঙ্গে যুক্ত। যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।

এছাড়াও যে সকল কোম্পানি ডায়ালিসিসের সামগ্রী সরবরাহ করে, তারাও ডাক্তার ফুয়াদ হালিমের সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। ফলে সেক্ষেত্রে সামগ্রীর দাম অনেকটাই কম পড়ে।

সর্বোপরি, এখানে যে সকল চিকিৎসকরা আছেন, তাঁরা সকলেই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কার্যত স্বেচ্ছাশ্রম দেন। তবে প্রায় ৬০ জন টেকনিশিয়ান ও অন্যান্য স্টাফদের বেতন দেওয়া হয় যোগ্যতা অনুসারেই। সব মিলিয়ে একটা পরিবার এই “কলকাতা স্বাস্থ্য সংকল্প”। জানালেন ফুয়াদ হালিম।

তবে শুরু থেকেই ৫০ টাকায় নয়, এখানে ডায়ালিসিস চার্জ ছিল ৩৫০ টাকা। তাহলে কমলো কেন? ফুয়াদ হালিমের সোজাসাপটা উত্তর, লকডাউনে কলকাতার প্রায় সর্বত্র ডায়ালিসিস চার্জ বেড়ে গিয়েছে। তাই তাঁরা কমিয়েছেন। কারণ, এই কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষের গাড়ি ভাড়া করে এসে চিকিৎসা করোনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তাই সেই পরিস্থিতি থেকে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াতেই এমন ভাবনা তাঁদের। এবং সেই কারণেই লকডাউনের পরদিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ থেকে ডায়ালিসিস চার্জ ৩৫০ টাকা থেকে কমিয়ে মাত্র ৫০ টাকা করা হয়েছে।

ফুয়াদ হালিম আরও জানান, প্রতিদিন এখানে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ জন মানুষের ডায়ালিসিস হয়। লকডাউন পর্বেই এখনও পর্যন্ত সবমিলিয়ে প্রায় ২ হাজারেরও বেশি মানুষের ডায়ালিসিস হয়েছে। শুধু তাই নয়, করোনা আক্রান্ত রোগীর ডায়ালিসিসও করেছেন তিনি। যখন অবশ্য সেইসব মানুষ করোনা জয় করে ফিরেছেন, তখনই এই পরিষেবা দেওয়া হয়েছে। এবং প্রোটোকল মেনে কোনও সক্রিয় করোনা রোগীর চিকিৎসা বা ডায়ালিসিস তাঁরা করেননি। এবং সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা পরিচালিত হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের কোনও সদস্যকে এখনও পর্যন্ত করোনা স্পর্শ করতে পারেনি।

সবশেষে “কলকাতা স্বাস্থ্য সংকল্প” নিয়ে ফুয়াদ হালিম জানান, তাঁর কয়েকজন ভাই এবং একদা স্কুলের কিছু বন্ধু মিলে ২০০৮ সালে নিজের বাড়িতেই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মাত্র ৫ শয্যা বিশিষ্ট এই চিকিৎসা কেন্দ্রের সূচনা করেছিলেন তিনি। আর আজ একযুগ পেরিয়ে “কলকাতা স্বাস্থ্য সংকল্প” শহরের বুকে একটি স্বনামধন্য চিকিৎসা কেন্দ্র। বাকিটা ইতিহাস। তাই চিকিৎসক যদি ঈশ্বরের রূপ হয়, তাহলে আজ এই প্রতিষ্ঠান সেই ঈশ্বরের মন্দির-মসজিদ অথবা গির্জা!

Related articles

২৮ নম্বর ওয়ার্ডে বিজয়া-সন্ধ্যায় কৃতী সংবর্ধনা ও এডুকেশন হেলথ কার্ড উদ্বোধন

উত্তর কলকাতার ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে বিজয়া সম্মিলনীকে কেন্দ্র করে রঙিন সাংস্কৃতিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হল সংবর্ধনা ও সমাজসেবামূলক এক...

কলকাতা দর্শন: ডিসেম্বরেই শহর ভ্রমণে নতুন উদ্যোগ! চালু হচ্ছে বিশেষ পর্যটন বাস পরিষেবা

শীতের মৌসুমে কলকাতার পর্যটন শিল্পকে তেজ দিতে নতুন পদক্ষেপ নিল রাজ্য পরিবহণ দফতর। ডিসেম্বরের শুরু থেকে চালু হতে...

কাপড়ের ব্যবসা করে জীবন কাটাচ্ছেন ধর্ষণের দায়ে জেল খাটা বলিউড নায়ক!

বলিউডের (Bollywood) একসময়ের নামকরা হিরো এখন রিয়েল লাইফে জিরো। 'গ্যাংস্টার'-এর মতো সুপারহিট সিনেমায় অভিনয়ের পর ধর্ষণের দায়ে সাত...

ডিসেম্বরেই সম্পন্ন হবে নিয়োগ প্রক্রিয়া! এসএসসির তালিকা প্রকাশ হতেই জানালেন শিক্ষামন্ত্রী

কারা ডাক পেলেন একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ইন্টারভিউ তালিকায়, এবার সেই নাম প্রকাশ করল এসএসসি। শনিবার ২০ হাজার নামের এক...
Exit mobile version