
প্রয়োজনের তুলনায় করোনার টেস্টিং অনেক কম হচ্ছে। করোনা ধরা পড়লে চিকিৎসার সুষ্ঠু বন্দোবস্ত নেই। যথেষ্ট বেড নেই। বেড থাকলেও তুলনায় ভেন্টিলেটরের সংখ্যা হাতে গোনা। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করোনার চিকিৎসা প্রায় হচ্ছেই না। ব্যাপক ধরাধরি করলে অথবা রাজনৈতিক অথবা প্রশাসনিক কোনও কেষ্টবিষ্টু হলে নামী নার্সিংহোম চিকিৎসা করছে। ফলে, যা হওয়ার তাই হয়েছে। করোনার প্রকোপ হু হু করে বাড়তে থাকায় উৎকণ্ঠায় রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছে উত্তরের আট জেলার আমজনতার অনেকেরই।

ঘুম না হওয়ারই কথা! চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষে উত্তরবঙ্গের একমাত্র কালিম্পঙে একজন করোনা আক্রান্তের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু, ১৮ জুলাই অবধি উত্তরবঙ্গে সেই মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩১ জন। এটা সরকারি ওয়েব পোর্টালের তথ্য। কো-মর্বিডিটিতে আরও কতজনের মৃত্যু হয়েছে তার হিসেব আলাদা করে অবশ্য মেলেনি।
এখনও অবধি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দার্জিলিং জেলায়। সেখানে ১৪ জন মারা গিয়েছেন। তার পরেই মালদহ। সেখানে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। দক্ষিণ দিনাজপুরে ৪ জন, জলপাইগুড়িতে ৩ জন ও বাকি জেলায় একজন করে মারা গিয়েছেন। ইদানিং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে শিলিগুড়ি ও মালদহের শহরাঞ্চলে। তাতেই আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হয়েছে। কারণ, মালদহ শহরের ইংরেজবাজার ও শিলিগুড়ি শহর, দুটিই ঘিঞ্জি এলাকা। যেখানে সংক্রমণ রাতারাতি বাড়ার সবরকম আশঙ্কা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই মত।

রাজ্য সরকারের হিসেব অনুযায়ী, জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহেই উত্তরবঙ্গের আট জেলায় অন্তত ৮ হাজার জন করোনা আক্রান্ত। সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা মালদহে। সংখ্যাটা প্রায় ২ হাজার জন। দার্জিলিং জেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার জন। জলপাইগুড়ি প্রায় ১ হাজার ছুঁইছুইঁ। উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরও পাল্লা দিয়ে যথাক্রমে ৬০০ ও ৮০০ জন আক্রান্ত। কোচবিহারে প্রায় সাড়ে ৪০০ জন। যে কালিম্পঙে উত্তরবঙ্গের প্রথম করোনায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল, সেখানে করোনার প্রকোপ এখন সরবচেয়ে কম। আক্রান্তের সংখ্যা ১০০ জনের নীচেই রয়েছে।
সরকারি হিসেব আপাত স্বস্তিদায়ক মনে হতে পারে অনেকের কাছে। কিন্তু, মনে রাখতে উত্তরবঙ্গে কোভিড-১৯ পরীক্ষা কিন্তু রাজ্যের অন্যান্য জায়গার তুলনায় কম হচ্ছে। উপরন্তু, উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থা করাতে মে-জুন গড়িয়ে গিয়েছে। গোড়ার দিকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজই ছিল ভরসা। যেখানে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ অবধি করোনা চিহ্নিত করার পরীক্ষা হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার জনের। তুলনামূলক পরে শুরু হয়েছে মালদহে পরীক্ষা। সেখানে এযাবৎ প্রায় ৪৩ হাজার জনের পরীক্ষা হয়েছে। তারও পরে সরঞ্জাম পেয়েছে রাজয়গঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কোচবিহার, চাঁচল, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, গঙ্গারামপুরের হাসপাতাল। সেখানে কোথাও পরীক্ষার হার দেড়শো ছাড়ায়নি।

আর পর্যাপ্ত সংখ্যক করোনা টেস্ট না হলে বিপদ যে ক্রমশ বাড়বে তা বলাই বাহুল্য। সে জন্যই করোনা পরীক্ষা করার জন্য আরও সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্যকর্মী উত্তরবঙ্গে দরকার হয়ে পড়েছে। রাজ্যের তরফে উত্তরবঙ্গে করোনা কন্ট্রোলের জন্য নোডাল অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে। কলকাতা থেকে বিশেষজ্ঞদের হেলিকপ্টারে উত্তরবঙ্গে যাতায়াতের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ঘনঘন মিটিং, টেলি কনফারেন্স হয়েছে। আয়োজনের কোনও ত্রুটি কিন্তু সরকারি তরফে দেখা যায়নি। এ সব কপ্টার ওড়াওড়ি, মিটিং ও পরিদর্শন মানে গাড়ি নিয়ে ঘোরাঘুরি বাবদ কত খরচ-খরচা হয়েছে, তার কতটা যুক্তিসঙ্গত সে প্রশ্ন না হয় করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে তোলা যাবে। এই মুহূর্তে যে বিষয়গুলি সামনে এসেছে তা হল, উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত দুই জেলা দক্ষিণ দিনাজপুর ও কোচবিহারে কেন করোনা পডিটিভদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত বন্দোবস্ত করা হয়নি! যদি ভেন্টিলেটর সহ কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস চালানোর জন্য দুই জেলায় যথেষ্ট বন্দোবস্ত থাকত তা হলে সেখানকার আক্রান্তদের ছোটাছুটি করতে হতো না।

কদিন আগে করোনা আক্রান্ত হয়েছে কোচবিহার পুরসভার প্রশাসক (প্রাক্তন চেয়ারম্যান) তথা তৃণমূল নেতা ভূষণ সিংহ। তাঁকে চিকিৎসার জন্য শিলিগুড়ির উত্তরায়ণের বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়েছে। একই ভাবে শিলিগুড়ি পুরসভার প্রশাসক তথা সিপিএম বিধায়ক অশোক ভট্টাচার্য যখন করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁকেও সরকারি হাসপাতালে না নিয়ে উত্তরায়ণের বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ফলে, সরকারি স্তরে ক্রিটিক্যাল কেয়ার নেওয়ার পরিকাঠামো উত্তরবঙ্গে কতটা রয়েছে তা খতিয়ে দেখে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আট জেলায় সরকারি হাসপাতালে ভেন্টিলেটর পাঠানোর ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে রাজ্যকে।

তেমনই আরও ভেন্টিলেটর দিতে হবে সব কটি জেলা হাসপাতালেও। কদিন আগে কংগ্রেসের প্রাক্তন দার্জিলিং জেলা সভাপতি উদয় দুবের করোনায় মৃত্যু হয়। শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে। সেখানে প্রয়োজনের তুলনায় ভেন্টিলেটর অনেক কম। তেমনই জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, রায়গঞ্জ, বালুরঘাট, মালদহেও আরও ভেন্টিলেটর জরুরি ভিত্তিতে পাঠানোর বন্দোবস্ত করতে হবে রাজ্যকে।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আইডি হাসপাতাল। যা কি না উত্তরবঙ্গে নেই। মনে রাখতে হবে, অতীতে ভয়ঙ্কর ফ্লুর প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে কলকাতায় আইডি হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছিল। তা এখন কলেবরে বেড়ে গবেষণা কেন্দ্র হয়ে রাজ্যের পক্ষে গর্ব করার মতো প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুদুরপ্রসারী চিন্তাভাবনার প্রতিফলন হল বেলেঘাটা আইডি। তা হলে করোনা-কালে উত্তরবঙ্গের মানুষ কি বর্তমান রাজ্য সরকারের কাছে এমন একটা পদক্ষেপ আশা করতে পারে না!

প্রয়োজনে রায়গঞ্জই হোক না রাজ্যের দ্বিতীয় আইডি হাসপাতাল। রাজ্য সরকার চাইলে সে কাজটা শুরু করে দিতেই পারে। বিশেষত, এই পরিস্থিতিতে একটা আইডি হাসপাতাল উত্তরবঙ্গে গড়ার কাজ শুরু হলে স্থানীয়দের অনেক আক্ষেপ কমে যাবে। সেই সঙ্গে দ্রুত ছোট আকারের পরিকাঠামো তৈরি করলে সেখানে জরুরি ভিত্তিতে করোনা আক্রান্তদের পরিষেবাও ব্যবস্থাও করা যাবে। রায়গঞ্জে তো জায়গার অভাব নেই।

মনে রাখতে হবে, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির উদ্যোগে রায়গঞ্জে যে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল তৈরির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছিল তা কল্যাণীতে চলে যাওয়ায় উত্তরের জনমনে একটা গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে। তাই আগামী দিনে করোনার তাণ্ডবে যদি বড় মাপের কোনও বিপর্যয় ঘটে তা হলে উত্তরবঙ্গের সেই ক্ষত অদূর ভবিষ্যতে ভরাট করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াতে পারে। তখন মনে হতে পারে প্রায় দু-দশক আগে শিলিগুড়িতে অজানা অথবা মারণ জ্বরে ৫২ জনের মৃত্যুর পরেও বামফ্রন্টের নেতা-মন্ত্রীরা উত্তরবঙ্গে ছোঁয়াচে রোগের জন্য আলাদা একটা হাসপাতাল গড়তে উদ্যোগী হননি। সে সময়ে মহাকরণের আলোচনায় উত্তরবঙ্গে আইডি হাসপাতাল গড়ার কথা প্রাসঙ্গিক মনে করেননি অনেকেই।

তারপরে তিস্তা-আত্রেয়ী-মহানন্দা-তোর্সা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। আমজনতা কিন্তু সেই বামেদেরই উত্তরবঙ্গেও অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে।
