
দিল্লিতে বঙ্গ-বিজেপির ম্যারাথন বৈঠক চলছে৷ বাংলায় ‘চালিয়ে খেলার’ স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতেই নাকি এই বৈঠক৷

রাজনীতি, বিশেষত ভোট-রাজনীতি কপি-পেস্ট করে হয় না৷ ত্রিপুরায় রাজ্য প্রভারী সুনীল দেওধর সফল হয়েছেন৷ সেই কপি বাংলায় পেস্ট করলেই সাফল্য মিলবে বলে অনেকে মনে করছেন৷ আবার অনেকের ধারনা, কেন্দ্রে যখন সরকার আছে, তখন সব কিছু করা সম্ভব৷ রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা যাবে৷ অথবা সব কটা এজেন্সিকে মাঠে নামিয়ে টপাটপ একের পর এক তৃণমূল নেতাদের হাজতে নেওয়া যাবে অথবা রাজ্যের সব বুথ কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনা হবে অথবা মোদিজি- শাহজি বাংলাতেই ক্যাম্প করে দিনের পর দিন থাকবেন, ওই চাপেই কাজ হয়ে যাবে৷ এতেই কেল্লা ফতে৷ এসব ভাবনা নেহাতই শিশুসুলভ৷ এ ধরনের যুক্তি সাজিয়ে বিজেপি বাংলা ‘দখল’ করার ‘স্কিম’ করলে, ভরাডুবি নিশ্চিত৷
আগে হয়তো ছিলো না, কিন্ত ইদানিং বঙ্গ- বিজেপির উপরের দিকে এমন কিছু লোকজন যোগ দিয়েছেন, যারা জানেন ভোট কীভাবে হয়৷ এই লোকজনের মধ্যে বিজেপি বিরোধী দলের নেতা-বিধায়করা আছেন, অভিজ্ঞ সাংবাদিক আছেন, পুলিশের কিছু প্রাক্তণ পদস্থ অফিসার আছেন৷ এনারা জানেন রাজ্যে ভোট কীভাবে হয়৷ কেন্দ্রের শাসক দল ইচ্ছা করলেই ভোটের মাধ্যমে কোনও রাজ্যে সরকার বদল করতে পারেনা৷ বিধায়ক ভাঙ্গিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে সরকার গঠন আর সরাসরি ভোটে জিতে সরকার গঠন করার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে৷ ২০১৪ থেকে আজ পর্যন্ত দেশের যতগুলি রাজ্যে ভোট হয়েছে, তার ফলাফল দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে৷ দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকলেই যদি রাজ্যে ক্ষমতায় আসা যেত, তাহলে এ রাজ্যে টানা ৩৪ বছর বামফ্রন্ট মহাকরণে থাকতো না৷ ২০১১-র আগেই কেন্দ্রের মদতে কংগ্রেস রাজ্যে সরকার করে ফেলতো৷ কেন্দ্র তো মদত দিয়েছিলো, কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস ফসল ঘরে তুলতে পারেনি৷ কেন হলো না, কেউ ভেবেছেন? অনেকে এখন বলতে পারেন, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তো বিজেপি ১৮ আসনে জিতেছে, এর কোনও মূল্য নেই ? তাদের সবিনয়ে জানাই, ১৯৮৪-র লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে কংগ্রেস ১৬ টি আসনে জেতার পর কী হলো ? রাজ্যে ১৯৮৪-র পরের বিধানসভা ভোট হয় ১৯৮৭ সালে৷ সেই ভোটে কংগ্রেস ২৯৪ আসনে প্রার্থী দিয়ে জিতেছিলো ৪০ আসন৷ উল্টোদিকে সিপিএম ২১২ আসনে প্রার্থী দিয়ে একাই পায় ১৮৭ আসন৷ সুতরাং লোকসভা ভোটের ফলাফল সামনে এনে তর্কে নামা অর্থহীন৷ পরিসংখ্যান এবং দিল্লি প্রদেশ কংগ্রেসকে গোলের সামনে বল বাড়ালেও, রাজ্য নেতারা সেই বল গোলে পাঠাতে পারেনি৷ এটাই ইতিহাস ৷

শেষ দু’টি লোকসভা ভোটে দেশজুড়ে বিজেপি প্রচার করেছে, নরেন্দ্র মোদির বিকল্প গোটা দেশে নেই৷ সত্যিই ছিলো না৷ দেশবাসীও তেমনই ভেবেছিলো৷ ফলে দিল্লির ভোট জিততে বিজেপির অসুবিধা হয়নি৷ তেমনই ২০১৬-র ভোটের মতোই ২০২১-সালের ভোটেও তৃণমূল প্রচার করছে, এ রাজ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপযুক্ত কোনও বিকল্প এখনও রাজ্যে নেই৷ এই কথা শুনে গেরুয়া-বাহিনী নিশ্চিতভাবেই হাসছেন৷ ঠিকই, বিশেষ কিছু মানুষ তিনবার হাসেন৷ লোকসভা ভোটে বিজেপির “মোদির বিকল্প নেই” প্রচারে তৃণমূলও রাজ্যে সেদিন অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলো৷ আর ১৩ মে ফলপ্রকাশের পর ডাকতে হয়েছে প্রশান্ত কিশোরকে৷ দেওয়ালের লিখন পড়তে না পারার দৈন্যতা প্রকট হয়েছিলো৷ তাই, ২০২১-এর ভোটের আগে বিজেপির নেতা- কর্মী- সমর্থক-ভোটার- তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা আজ থেকেই হাসতে চাইলে হাসতেই পারেন৷ ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে “মোদি- বিকল্পহীন” যদি দেশের মানুষ ভাবতে পারেন, তাহলে ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে রাজ্যের মানুষ যদি ভাবেন ‘বাংলায় মমতার বিকল্প এখনও নেই’, তাহলে কোন যুক্তিতে সেই ভাবনা অমূলক হয় ? বিষয়টা তো ঠিকই৷

আসলে, ক্ষমতায় আসতে বঙ্গ-বিজেপির যা যা করা দরকার ছিলো, তার কিছুই এখনও করে উঠতে পারেনি গেরুয়া-ব্রিগেড৷ স্রেফ চটুল কথা বলে মিডিয়া ফুটেজ খাওয়া ছাড়া বঙ্গ-বিজেপি এ পর্যন্ত ভোটে জেতার জন্য আর কী কী করেছে, কেউ পয়েন্ট ধরে ধরে বোঝাতে পারবেন? কংগ্রেস বা তৃণমূল কংগ্রেসের চিরাচরিত গোষ্ঠী- কোন্দলের উপসর্গ আজ বঙ্গ-বিজেপির সর্বাঙ্গে ফুটে বেরিয়েছে, ক্ষমতার ত্রিসীমানায় না এসেই৷

বঙ্গ-বিজেপির নেতা বা কিছুটা বাস্তববোধ-সম্পন্ন শুভানুধ্যায়ীরা এখনও ধরতে পারছেন না রাজ্যে বিজেপিকে প্রতিদিন আন-পপুলার করে চলেছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় একাই৷ তাঁর অযৌক্তিক অতি- সক্রিয়তার ফায়দা তুলছে তৃণমূল৷ ধনকড় তাঁর আচরণে স্পষ্ট করছেন, তিনি যতখানি না রাজ্যপাল, তার থেকে বেশি রাজ্য বিজেপির সভাপতি৷ এই কয়েকদিনের মধ্যে এত অবান্তর কথা বলেছেন বা টুইট করেছেন যে তিনি নিজেই নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন৷ আজকাল তৃণমূলের চতুর্থ সারির নেতারাও প্রকাশ্যে চোখা চোখা ভাষায় রাজ্যপালকে তোপ দাগছেন৷ এই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন রাজ্যপাল নিজেই৷ আর বঙ্গ-বিজেপির কিছু নেতা রাজ্যপালকে থামতে না বলে, তাঁর কাজকর্মে ধুনো দিয়ে চলেছেন৷ ফলে খেলাটা চলে গিয়েছে তৃণমূলের হাতে৷ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্যপাল কী করতে পারেন, সেই ধারনার অভাব থেকেই যে এসব হচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে৷ অতীতে বি ডি পাণ্ডে,
এ পি শর্মা, উমাশঙ্কর দীক্ষিত, এ আর কিদোয়াই,গোপাল গান্ধী বা এম কে নারায়ণন-রা বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে কী কী করতে পেরেছিলেন ? অথচ কংগ্রেস অনেকখানি “ভরসা” করেছিলো ওনাদের উপর৷ ধনকড় সাহেবের কিছু “করার” থাকলে দিল্লির সঙ্গে ফাইল চালাচালি করুন৷ তা না করে এত ‘ভোকাল’ হয়ে ‘লোকাল’ বিজেপি-র সমান্তরাল সংগঠন চালাচ্ছেন কেন ? এতে বঙ্গ-বিজেপি লাভবান হচ্ছে ? এটা গেরুয়া শিবির বুঝতে পারছে না কেন, সেটাই বিস্ময়ের৷

প্রতিটি স্তরেই রাজ্য-বিজেপির শূন্যতা ফুটে বেরিয়ে আসছে৷ একটি প্রতিবেদনে তা বলা সম্ভব নয়৷ আজ এইটুকুই৷ আগামীকাল বিজেপি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়৷
