কিছু নেতার ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় বিরক্ত উত্তরবঙ্গ

কিশোর সাহা

কত কিছুই না করেছেন তিনি। তবুও উত্তরের পাহাড়-সমতলের আকাশ-বাতাস মুখ ফেরাচ্ছে তাঁর দলের থেকে। তিনি মানে তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

সোজা কথায়, এখনও উত্তরবঙ্গের ৭ জেলার পরিস্থিতি কিন্তু তৃণমূলের পক্ষে সুবিধাজনক নয়। গত লোকসভা ভোটের হিসেব তাই বলছে। অষ্টম জেলা মানে দার্জিলিং পাহাড় ও সমতল শিলিগুড়ির কথা না হয় বাদই দেওয়া যাক। পাহাড়ে এত বোর্ডের ঘনঘটার পরেও পাহাড়ি মানুষ কিন্তু অদেখা-অচেনা রাজু বিস্তকে রেকর্ড ভোটে জিতিয়ে দিয়েছেন। শিলিগুড়িতেও সত্তরোর্ধ্ব অশোক ভট্টাচার্যের বিকল্প এখনও খুঁজে পায়নি তৃণমূল। না হলে শিলিগুড়ি পুরবোর্ডের মেয়াদ ফুরানোর পরে নিজেদের দেওয়া বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করে অশোকবাবুর দাবি মেনে তাঁর দেওয়া নামগুলি দিয়েই প্রশাসক বোর্ড তৈরি করতে হয়!

অথচ ২০১১ সাল থেকে মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরের পরিসংখ্যান দেখলে চমকে উঠতে হয়! কতবার যাতায়াত করেছেন ভাবা যায় না। কথায়-কথায় প্রশাসনিক মিটিং। রাজনৈতিক জনসভা। বালুরঘাট, মালদহ, রায়গঞ্জ, ইসলামপুর, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়িতে প্রায় দু-তিন মাস পর পরই দেখা মিলত মুখ্যমন্ত্রীর।

সর্বোপরি দার্জিলিং পাহাড়ে গিয়ে ঘনঘন থাকা। ২৩ জানুয়ারির মূল অনুষ্ঠান কলকাতা থেকে সরিয়ে দার্জিলিং পাহাড়ের ম্যালে নিয়ে যাওয়া। উত্তরকন্যা, ডুয়ার্সকন্যা তৈরি করা। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর তৈরি করা। বালুরঘাটে নাট্য উৎকর্ষ কেন্দ্র তৈরি করা। সব জেলায় কলেজ বাড়ানো, তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরিও হয়েছে। অনেক হাসপাতালের নাম বদলে সুপার স্পেশালিটি হয়েছে। কন্যাশ্রী, যুবশ্রী ইত্যাদি প্রকল্পে সুবিধাপ্রাপ্তদের সংখ্যাও কম নয়। কমবেশি উত্তরবঙ্গের অর্ধেক গ্রাম থেকেই –দু-চার জন সিভিক ভলান্টিয়ার বা সিভিক পুলিশের কাজ পেয়েছেন।

এতসবের পরেও উত্তরবঙ্গের নানা প্রান্তের চায়ের দোকান, রাজনীতির আড্ডায় কান পাতলে কিন্তু তৃণমূলের স্থানীয় বড় মাপের নেতা কিংবা মন্ত্রীদের ধন্য-ধন্য করার মতো কোনও কথা তেমন শোনা যায় না। বিরোধী শিবিরের কথা পরে হবে। আগে তৃণমূলের খুচরো নেতাদের একাংশের আলোচনায় কান পাতা যাক।

যেমন, বালুরঘাটে যদি কান পাতেন তা হলে শুনতে পাবেন, কেন অর্পিতা ঘোষকে এতটা প্রাধান্য দিয়ে বিপ্লব মিত্রকে গ্যারেজ করে বিজেপিতে যেতে বাধ্য করা হল তা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া দরকার। আবার হিরামপুর, গঙ্গারামপুরে বাস স্ট্যান্ডের অদূরে আড্ডায় তৃণমূলের দু-চারজন নেতা একান্তে বলে ফেলবেন, আমাদের মন্ত্রী বাচ্চু হাঁসদার রাজপ্রাসাদটার জন্যই তো মানুষ মুখ ঘোরাচ্ছে হয়তো। পরক্ষণেই বাচ্চু শিবিরের একজনের কটাক্ষ, দক্ষিণ দিনাজপুরের অমুক নেতা কম কামিয়েছেন নাকি! এর পরেই গোটা সাতেক নেতার নাম ধরে কার কত সম্পত্তি হয়েছে তা নিয়ে চুলচেরা আলোচনা, বিস্তর অভিযোগ।

জেলায় জেলায় একই ছবি। একই অভিযোগ। কোচবিহারে গেলে শুনতে পাবেন রবি ঘোষের নামে। তিনি তাঁর ছেলেকে রাজনীতিতে তুলে ধারার জন্য পার্থপ্রতিম রায়কে গ্যারেজ করার চেষ্টায় কোমর বেঁধেছিলেন বলে দলের মধ্যেই অভিযোগ। সেই পার্থপ্রতিমই এবার জেলা সভাপতি হয়ে গিয়েছেন। সেখানে সাগরদিঘির পাড়ে সান্ধ্য আড্ডায় যদি শুনতে পান, কাকা কত সম্পত্তি কামিয়েছেন, কোথায় রেখেছেন, কাকার হয়ে কে কে কী কী কালেকশন করেন, সে সব ভাইপো শিবিরের তরফে ফিসফাস করে বলে সাগরদিঘির বাতাস ভারী করে দেওয়া হয়।

আলিপুরদুয়ারে কান পাতলে তো চা বলয়ের কোন নেতার হাতে প্রায় ২০ লক্ষ টাকার আংটি, গলায় ৫ লক্ষ টাকা দামের চেন ঝোলে সেটা বলে আক্ষেপ করবেন তৃণমূলের খুচরো কর্মীরা। কিছুদিন আগে দলের দায়িত্বে থাকা এক নেতার পারিবারিক অনুষ্ঠানে খরচের বহর নিয়েও কম কানাঘুঁষো নেই। জলপাইগুড়িতে তৃণমূলের সাইড লাইনে থাকা এক নেতা জানান, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারে নেতাদের কয়েকজন কামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়াতেই দলের বাকিদের মধ্যে প্রভাব পড়েছে।

শিলিগুড়িতে যেমন কয়েকজন কাউন্সিলরের সম্পত্তির পরিমাণ নিয়ে এনফোর্সমেন্ট বিভাগের তদন্ত হওয়ার দাবি উঠেছে তৃণমূলের অন্দরে। নামে-বেনামে টাকা-সম্পত্তি বাড়ানোর প্রতিযোগিতা দেখে তৃণমূলের বসে যাওয়া কয়েকজন নেতা সুযোগ পেয়ে নাকি পিকের সমীক্ষা টিমের কাছে নাম উল্লেখ করে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে, শিলিগুড়িতে অর্থ ও সম্পদশালী নেতাদের প্রতিযোগিতায় এখনও পিছনের সারিতে থাকা নেতাদের একাংশকেই এবার সামনে রাখা হয়েছে।

ঘটনা হল, উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের যে সংগঠন রয়েছে তার অর্ধেকও বিজেপির নেই। বরং, চা বলয়ে বামেদের এখনও কিছুটা শক্তি রয়েছে। রায়গঞ্জ, মালদহে কংগ্রেসের একটা জোরালো ঘাঁটি এখনও রয়েছে। তবুও তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের একাংশের আচার-আচরণ ও অস্বাভাবিক ভাবে রাতারাতি আরও ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতার ছবিটাই ভোটের হিসেব বদলে দিচ্ছে বলে অনেকরই ধারনা।

উত্তরবঙ্গের প্রবীণ কংগ্রেস নেতা একান্তে একজন তৃণমূল নেতার নাম করে অভিযোগ করেন, ও আমার পরে রাজনীতি শুরু করেও এখন কত কোটি টাকার মালিক তা কল্পনা করা যায় না! কোনও প্রমাণ আছে! ওই নেতা হাসতে হাসতে জানান, কাট মানির টাকা কি রসিদ দিয়ে নিয়ে ব্যাঙ্কে জমা দেব! নামে তেমন কিছু নেই, সবটাই বেনামে কলকাতা, শিলিগুড়ি সহ নানা এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ।
বস্তুত, বিজেপি কিন্তু এ সব নিয়ে তেমন প্রচার করেনি। এখন করছেও না। নামকে ওয়াস্তে যতটা প্রতিবাদ, মিটিং-মিছিল না করলে নয় ততটুকুই বিজেপির তরফে উত্তরবঙ্গে হয়ে থাকে। তবুও গত লোকসভা ভোটে বিজেপির ঝুলি ভরাট করা দিয়েছিল উত্তরবঙ্গ। তার একটা কারণ যে তৃণমূলের অন্দরের ক্ষোভ সেটা একান্তে দলের অনেক নেতাই মানছেন। এটাও তাঁরাই বলছেন, উত্তরবঙ্গে বামেদের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা তেমন নেই এবং কংগ্রেসের হাল আরও খারাপ বলেই খানিকটা বাধ্য হয়েই অনেকে বিজেপির ভোটবাক্সে ঝুঁকেছেন।

বাস্তবতা মানেন যে নেতারা, তাঁদের অনেকেই একান্তে স্বীকার করেন, নানা সম্প্রদায়কে আলাদাভাবে কাছে টানার চেষ্টার রাজনীতি এখন ততটা কাজে দেয় না। কারণ, একজন নেতার কথাই শিরোধার্য এমন ইদানীং হয় না। যেমন আদিবাসী সকলেই বিরসা তিরকের কথা শুনবেন অথবা জন বার্লার কথা মানবেন এটা হয় না। তেমন রাজবংশীরা অতুল রায়ের কথা শুনবেন, নিখিল রায়ের কথা শুনবেন না তাও হতে পারে না। তই সম্প্রদায় ভিত্তিক ভোট ভাগাভাগির হিসেবটা ইদানিং খাটছে না। সব সম্প্রদায়ই চোখের সামনে দেখছে, কে বাম আমলে ফুলেফেঁপে উঠেছেন, কে তৃণমূল জমানা তরতরিয়ে বাড়ি-গাড়ি, চাকরি, জমি বাড়িয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে গিয়ে বড় নেতা হয়েছেন।

গ্রাম স্তর থেকে এ সব নজরে পড়ে। তা শহরেও আরও বেশি চোখে পড়ে। জেলা সদরে তা আলোচনার বিষয় হয়ে যায়। ক্রমশ কানাকানি হয়ে তা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কখনও কোনও যতটা না ধনী তার চেয়ে কয়েকগুণ বাড়িয়েও বলে দেওয়ার ঘটনাও থাকে।

এ সব আটকানোর উপায় নেই। তাই নানা এলাকায় ইতিমধ্যেই চিহ্নিত হয়ে যাওয়া বাছাই কয়েকজন নেতাকে শিক্ষা দিতে ভোটের দিনটি বেছে নেন অনেকেই। যেমন লোকসভা ভোটে নিয়েছিলেন। তেমনই বিধানসভা ভোটেও হতে পারে।

সম্ভবত, এ সব খবরের অনেকটাই পৌঁছেছে কালিঘাটে। তাই বড় টুর্নামেন্টের আগে সব দলই যেমন জবরদস্ত টিম বানাতে চায়। তেমন টিম বানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। ঝাড়াই-বাছাই করে টিম তৈরির পরে খেলোয়াড়দের একসঙ্গে প্র্যাকটিসের সুযোগ দেওয়াও নিয়মের মধ্যেই পড়ে। সেই প্র্যাকটিসের উপরেই নির্ভর করে অনেক কিছুই।

মনে রাখতে হবে, চূড়ান্ত দলে সুযোগ না পাওয়া খেলোয়াড়রা কিন্তু মাঠের বাইরেই নানা খেলা খেলবে। বাম-কংগ্রেস, পদ্ম শিবির কিন্তু সে জন্য মুখিয়ে রয়েছে।

Previous articleসংঘাত তুঙ্গে: মুখে-চোখে যাই বলুন, দিল্লি থেকে জোর ধাক্কা খেয়েই ফিরেছেন মুকুল
Next articleব্রেকফাস্ট নিউজ