Sunday, November 9, 2025

স্ত্রী’কে বলেছিলেন, ৩০ বছরের মধ্যে সেনেটর, তারপর প্রেসিডেন্ট, কথা রাখলেন জো বাইডেন

Date:

Share post:

বিশ্ব রাজনীতিতে সর্বাধিক শক্তিধর রাষ্ট্রপ্রধান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ৷ দীর্ঘ লড়াইয়ের পর সেই আসন দখল করে নিলেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী জোসেফ রবিনেট জুনিয়র বাইডেন৷ নিজেই নিজের নামটা খুবই ছোট করে ‘জো বাইডেন’ বানিয়ে নিয়েছেন অনেকদিন আগেই৷

প্রয়াত স্ত্রী নেইলিয়া’কে একদিন বাইডেন বলেছিলেন, তাঁর স্বপ্ন ৩০ বছর বয়সের মধ্যে সেনেটর হওয়ার। সেনেটর হওয়ার পরের লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এই ২০২০ সালে বাইডেন প্রমান করলেন, তিনি তার লক্ষ্যে কতখানি অবিচল৷

প্রয়াত প্রথম স্ত্রী নেইলিয়া এবং তিন সন্তানের সঙ্গে জো বাইডেন ||

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শুরু থেকেই প্রচারে এবং প্রভাবে বাইডেন কার্যত নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পকে৷ একের পর এক বাঁধনহারা ঝড় তুলে ট্রাম্পের কপালের ভাঁজ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রথমদিন থেকেই৷ গণনা নিয়ে দীর্ঘ টালবাহানার পর অবশেষে ৪ বছরের জন্য হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হওয়ার ছাড়পত্র পেয়ে গেলেন জো বাইডেন৷

আমেরিকার আগামী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত৷ রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে বাইডেন ছিলেন ওদেশের অন্যতম সফল একজন অ্যাটর্নি৷ ডেমোক্র্যাটিক দলের সদস্য হয়ে এরপর বাইডেন আমেরিকায় রাজনীতিতে পা রাখেন । ডেলাওয়ার প্রদেশের সেনেটর ছিলেন সর্বাধিক সময় ধরে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন ৮ বছর।

জো বাইডেনের জন্ম ১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর পেনসিলভানিয়ার স্ক্রানটনে। ৪ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় বাইডেন বেড়ে ওঠেন স্ক্রানটন, নিউ ক্যাসল কাউন্টি ও ডেলাওয়ারে। বাবা জোসেফ রবিনেট বাইডেন সিনিয়র আর আইরিশ বংশোদ্ভূত মা ক্যাথরিন ইউজেনিয়া ফিনেগান। বাবা জোসেফ বাইডেন সিনিয়র ছিলেন একজন ফারনেস-ক্লিনার। গাড়ির সেলসম্যান হিসাবেও কাজ করেছেন বাইডেন সিনিয়র৷ ছোটবেলা থেকেই জুনিয়র বাইডেন খুব কাছ থেকে দেখেছেন প্রবল দারিদ্র্য ৷ নিম্নবিত্ত পরিবারের আর পাঁচটা শিশু যেভাবে বড় হয়, বাইডেনের বড় হওয়া ঠিক সেভাবেই৷ বিশ্ব রাজনীতিতে এই মুহুর্তে অসীম ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা বাইডেনের লড়াকু মানসিকতাও তৈরি হয় ওই ছোটবেলাতেই, দারিদ্র্যের সঙ্গে অসম লড়াই চালাতে চালাতেই৷ ভোটপ্রচারে বার বার বলেছেন, তাঁর জীবনে বাবা-মায়ের অবদান, পারিবারিক দারিদ্র্যকে বার বার কুর্ণিশ জানিয়ে বলেছেন, গরীব পরিবারে বড় হওয়ার জন্যই তাঁর রক্তের সঙ্গে মিশে আছে লড়াই করার তেজ এবং অফুরান সততা৷ অসংখ্য সাক্ষাৎকারে বাইডেন বলেছেন, হাতে টাকাপয়সা না থাকার কারনেই কঠিন জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন৷ তিনি দাবি করেছেন, ওই জীবনই তাঁকে পোক্ত, অভিজ্ঞ এবং অনুভূতিসম্পন্ন এক পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে তৈরি করেছে।

প্রাক্তণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও প্রাক্তন মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ||

বাইডেনের শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিলো স্ক্রানটনের সেন্ট পলস এলিমেন্টরি স্কুলে৷ এরপর ১৩ বছর বয়সে বাইডেন সিনিয়র সপরিবারে ডেলাওয়্যারে চলে আসেন। কথা বলার ক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকেই বাইডেনের কিছু সমস্যা ছিলো। এই দুর্বলতার জন্য স্কুলজীবনে সহপাঠীরা তাঁর সঙ্গে প্রতিনিয়তই মশকরা করতো৷ কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে কীভাবে শুধরে নিয়েছেন তা আজ বিশ্ব দেখছে। অসাধারণ এই বাগ্মীর ভাষণ শুনতে মার্কিনিরা ভেঙ্গে পড়তেন তাঁর সভায়।
ডেলাওয়্যারে এসে প্রথমে সেন্ট হেলেনা স্কুল, পরে বার্চমেরে অ্যাকাডেমির পড়ুয়া হিসাবে শিক্ষকদের নজর কাড়েন খুবই কৃশ চেহারার অথচ ফুটবলে আগ্রহী কিশোর বাইডেন। স্কুল ও কলেজ জীবনের পর ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠও একসময় শেষ করেন বাইডেন। পরে আইন পাস করেন সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ওই সময়েই বাইডেন আকর্ষিত হয়ে পড়েন জন এফ কেনেডির রাজনৈতিক কার্যধারার । সেই আকর্ষণেই ১৯৬১-তে রাজনীতির দিকে ঝুঁকতে থাকেন।

সস্ত্রীক নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ||

এদিকে, রাজনৈতিক জীবন শুরু হওয়ার সময়ই বাইডেনের সঙ্গে পরিচয় হয় নেইলিয়া হান্টারের৷ ১৯৬৬ সালে সিরাকিউজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বাইডেন, নিলিয়া হান্টারকে বিয়ে করেন। তিন সন্তান জোসেফ ‘বিউ’ বাইডেন, রবার্ট হান্টার ও নাওমি ক্রিস্টিনা। ১৯৭২ সালে বড় দিনের আগে ক্রিসমাস ট্রি কিনতে গিয়ে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নেইলিয়া নিহত হন। তার মেয়ে নাওমিও দুর্ঘটনায় মারা যান। ১৯৭৭ সালে ফের বিয়ে করেন বাইডেন। দ্বিতীয় স্ত্রী জিলের ঘর আলো করে কন্যা সন্তান অ্যাশলে জন্মগ্রহণ করে ১৯৮১ সালে।

জো বাইডেন ১৯৭০ সালে ডেলাওয়ারের নিউ ক্যাসল কাউন্টির কাউন্সিলম্যান নির্বাচিত হন ৷ এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ৩০ বছর বয়সের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটর হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয় তার। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে তৎকালীন জনপ্রিয় রিপাবলিকান সেনেটর স্যালেব বগসের বিপক্ষে ডেমোক্রেটিক দল থেকে প্রার্থী হন তিনি। তারপর বাইডেন ঢুকে পড়েন ইতিহাসে। মাত্র ৩০ বছর বয়সেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবথেকে কম বয়সী পঞ্চম সেনেটর নির্বাচিত হন।
ডেলাওয়ার থেকে মোট ৬ বার সেনেটর নির্বাচিত হন জো বাইডেন৷ সেনেট-এর বিচার সাব-কমিটিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধ আইনসহ যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি আইন চালু করেন তিনিই।

২০০৭ সালে ফের নির্বাচনে দাঁড়ান। সেবার বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘রানিংমেট’ হিসেবে বেছে নেন বাইডেনকে। এরপর একদিন ফোন আসে খোদ ওবামার কাছ থেকে। রিপাবলিকান সেনেটার জন ম্যাকেন, ও আলাস্কার গর্ভনর সারাহ পালিনকে হারিয়ে ২০০৯ সালে ২০ জানুয়ারি বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭ তম ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। ২০১২ সালেও একই পদ তিনি ধরে রাখেন। জো বাইডেন’ই যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত প্রথম কোন রোমান ক্যাথলিক বিশ্বাসী।

২০১৫ সালে ফের প্রিয়জন হারান। মস্তিষ্কের ক্যান্সারে বড় ছেলে বো বাইডেনের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন জো। ২০১৬-র প্রেসিডেন্ট ভোটে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন পাবার আগেই সরে যান।ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে নানা ওঠানামার পর ঘুরে দাঁড়ান জো বাইডেন। প্রথমবার সেনেটে পা রাখার পর ১৯৭৮, ১৯৮৪, ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০২ এবং ২০০৮ সালে পর পর জয়লাভ করেন সেনেটর নির্বাচনে৷ নিজের কার্যকালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ইরাক নিয়ে পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সব থেকে বেশি সরব ছিলেন এই বাইডেনই।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ফার্স্ট লেডি ডঃ জিল বাইডেন ||

বাইডেন পররাষ্ট্র- বিষয়ক আমেরিকান সেনেট কমিটিতে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন। সেনেটের পররাষ্ট্র- বিষয়ক কমিটির সভাপতি হিসেবে ২০১২ সালের অক্টোবরে আমেরিকার রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের ইরাক- যুদ্ধের বিষয়টিকে অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল বাইডেনেরই৷ এর ১১ বছর আগে, উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার মুখে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে, সাদ্দাম হুসেনের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অনুমোদনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন এই বাইডেন। বাইডেনের হুঁশিয়ারির পরেও উপসাগরীয় যুদ্ধের পক্ষেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷এরপর থেকেই আমেরিকাজুড়ে প্রচার শুরু হয় বাইডেন পররাষ্ট্র ও জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতির প্রণেতা হিসাবে দুর্বলচিত্ত৷ ব্যাপক সমালোচিত হবার পরের কয়েক বছর বাইডেন আন্তর্জাতিক বিষয়ে কট্টর সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেন৷বলকান গৃহযুদ্ধে আমেরিকান অবস্থান, ইরাকে বোমা হামলা এবং আফগানিস্তানে মার্কিন হানাদারি অনুমোদনে বড় ভূমিকা পালন করেন৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ যখন অভিযোগ তোলেন ইরাকের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে, এবং এই ইস্যুতে ইরাকে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর প্রস্তাব করেন, তখনও বাইডেন তাতে জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন। ইরাক যুদ্ধের পর বাইডেন কিছুটা বামপন্থার দিকে ঝোঁকেন। ইরাকে আমেরিকান সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির বিরোধিতা করেন এবং সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। চলতি বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হয়ে লড়াইয়ে নামার ঘোষণা করার পর তিনি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের প্রতি আমেরিকার সমর্থন বন্ধ করার পক্ষেও মত দিয়েছিলেন৷

আর এই ২০২০ সালে জো বাইডেন হলেন ৪৬-তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ক্ষমতায় থাকবেন আগামী ২০২৪ পর্যন্ত৷

 

spot_img

Related articles

বালিচকের প্লাটফর্মে ধাক্কা মালগাড়ির, অল্পের জন্য বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা

রবিবার সকালে খড়্গপুর ডিভিশনে রেল দুর্ঘটনা। নটা নাগাদ বালিচক স্টেশনে বিকট আওয়াজে একটি মালগাড়ির ইঞ্জিন ধাক্কা মারে প্ল্যাটফর্মে।...

তারকেশ্বরে শিশুকন্যাকে অপহরণ করে যৌন নির্যাতন, গ্রেফতার দাদু!

চার বছরের ঘুমন্ত শিশুকন্যাকে মশারি কেটে বের করে নিয়ে গিয়ে যৌন নির্যাতন। তারকেশ্বর স্টেশন (Tarkeswar Station) সংলগ্ন ড্রেন...

রবিবাসরীয় সকালে চাঁদনী চকের CESC অফিসের ট্রান্সফর্মারে বিস্ফোরণ!

সাতসকালে মহানগরীতে ফের অগ্নিকাণ্ড (Fire incident in Kolkata)। সকাল ৭টা ১০ মিনিট নাগাদ চাঁদনী চকের CESC অফিসের একটি...

গ্রিন লাইনে ট্র্যাফিক ব্লক, রবির শেষ মেট্রোসূচিতে বদল!

ছুটির দিনে মহানগরীর পাতাল পরিষেবায় বদল। হাওড়া ময়দান - সেক্টর ফাইভ (Howrah Maidan to Sector V) রুটে শেষ...