বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৮ বছর পার.. ফিরে দেখা ইতিহাস

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসের এক কালো দিন। ২৮ বছর আগে এই দিনেই সাম্প্রদায়িক আগুনে জ্বলে উঠেছিল গোটা দেশ। সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়েও বারবার সামনে এসেছে এই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রসঙ্গ। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হাজার হাজার কর সেবকদের হাতে ধ্বংস হয় বাবরি মসজিদ। সশস্ত্র হামলায় একে একে উপড়ে ফেলা হয় মসজিদের তিন-তিনটি গম্বুজ। সাম্প্রদায়িক হিংসার বলি হয়েছিল কয়েক হাজার মানুষ। এই দিনের পর থেকে আমূল বদলে গিয়েছিল ভারতীয় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট।

আজ আরও এক ৬ ডিসেম্বর। ৬ ডিসেম্বর, ২০২০। কিন্তু ২৮ বছর আগের সেই দিন এখনও যেন টাটকা। রাম মন্দির না বাবরি মসজিদ? এই নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। অনেক মামলা-মোকদ্দমার পর এই বাবরি মসজিদের জায়গায় এখন তৈরি হয়েছে রাম মন্দির। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, সেই অভিশপ্ত দিন থেকে আজ পর্যন্ত ঠিক কী কী ঘটেছে?

• ১৫২৮ সালে মুঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে তৈরি হয়েছিল এই মসজিদ।

• ১৮৫৩ সালে নির্মোহী আখড়ার অনুগামীরা হামলা চালায় বাবরি মসজিদে।

• ১৮৮৫ সালে ফৈজাবাদ আদালতে প্রথম মামলাটি করেন মোহন্ত রঘুবীর দাস নামে অযোধ্যার এক পুরোহিত ও রামায়ণ বিশেষজ্ঞ। মামলার সারমর্ম ছিল এই যে, বাবরি মসজিদের ওই স্থানে আগে মন্দির ছিল। সেই কারণে তিনি সেখানে মন্দির গড়তে চান। কিন্তু তত্কালীন সেক্রেটারি অব স্টেট (লর্ড উডহাউজ) সেটি বাতিল করে দিয়েছেন। তাই তিনি তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন। যদিও সেই সময়ে বিশেষ এগোয়নি মামলা।

• ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর, স্বাধীনতার দু’বছর পর। রাতের অন্ধকারে একদল কট্টরপন্থী মসজিদে ঢোকেন। মসজিদের ভিতরে রামের বিগ্রহ রেখে দেন। ২৪ ডিসেম্বর: ওই জমিকে বিতর্কিত ঘোষণা করে মসজিদে তালা ঝুলিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার।

• ১৯৫০ সালে ১৬ জানুয়ারি, মন্দির পক্ষের নেতা গোপাল সিং বিশারদ ফৈজাবাদ কোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন। বাবরি মসজিদ সংলগ্ন স্থানটিতে- যেখান থেকে মূর্তিটি উদ্ধার হয়েছে, সেখানে পুজোপাঠের অধিকার চাওয়া হয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখে সাময়িকভাবে জন্মস্থান থেকে মূর্তি সরানো যাবে না বলে নির্দেশ জারি করে ফৈজাবাদ আদালত। এলাহাবাদ আদালতেও তার পক্ষেই সায় দেওয়া হয়।

• সেই বছরেরই এপ্রিলে উত্তরপ্রদেশের গোবিন্দবল্লভ পন্ট শাসিত কংগ্রেস সরকার আদালতের এই ইঞ্জাকশান তোলার জন্য মামলা করেন।

• ১৯৫০ সালের ডিসেম্বরে বিতর্কিত স্থানে পুজোপাঠ চলতে থাকার অনুমতি চেয়ে মামলা করেন রাম জন্মভূমি মন্দির ট্রাস্টের প্রধান পরমহংস রামচন্দ্র দাস। এই ট্রাস্ট আবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যদিও তিনি নিজেই আবার মামলা তুলে নেন।

• ১৯৬১ সালের ১৮ ডিসেম্বর, অযোধ্যার মুসলিম বাসিন্দাদের ডেকে এনে বিতর্কিত চত্বরটির দখল নেন উত্তরপ্রদেশের সুন্নি সেন্ট্রাল বোর্ড অব ওয়াকিফ-এর সদস্যরা।

• ১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় বাবরি মসজিদ অ্যাকশান কমিটি।

• ১৯৮৯ সালের ১ জুলাই এলাহাবাদ আদালতের লখনউ বেঞ্চে মামলা করেন ভিএইচপি-র সহ-সভাপতি এবং এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি দেবকীনন্দন আগড়ওয়ালা।
এর পরেই রাজীব গান্ধী শাসিত কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সরকার ভিএইচপি-কে রামমন্দিরের শিলান্যাসের অনুমতি দেয়। রামমন্দিরের প্রথম ইঁটটি স্থাপন করা হয়।

• ১৯৯২ ৬ ডিসেম্বর: সকাল সাড়ে ১০টা.. মসজিদে ঢুকতে শুরু করেন করসেবকরা। হাজার হাজার করসেবকে ঢেকে যায় বাবরি মসজিদ। মসজিদের তিনটি গম্বুজই ভেঙে ফেলা হয়। অস্থায়ী ভাবে গড়ে ওঠে রামলালার মন্দির।

ঘটনায় দু’টি এফআইআর দায়ের করা হয়। প্রথমটি, অজ্ঞাতপরিচয় করসেবকদের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়টি, লালকৃষ্ণ আডবাণী, এম এম জোশী-সহ কিছু বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে। তদারকি করতে বিচারপতি লিবেরহ্যানের অধীনে তৈরী হয় বিশেষ কমিটি। রিপোর্ট দিতে বেঁধে দেওয়া হয় ৩ মাসের সময়সীমা। জারি করা হয় রাষ্ট্রপতি শাসন। ভেঙে দেওয়া হয় কল্যাণ সিং শাসিত বিজেপি সরকার।

• ১৯৯৩: আডবাণীদের বিরুদ্ধে সিবিআই চার্জশিট পেশ করে।

• ১৯৯৪ : ৬৭.৭ একরের মধ্যে ২.৭৭ একরের বিতর্কিত জমিটুকু অধিগ্রহণ করে সরকার।

• ৪ মে, ২০০১: সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতে আডবাণীদের বিরুদ্ধে মামলা বন্ধ হয়ে যায়

• ২০০২ : এলাহাবাদ হাইকোর্টে শুরু হয় শুনানি। বিতর্কিত স্থানে হিন্দুদের দাবিমাফিক আগে মন্দির ছিল কিনা তা খুঁড়ে দেখে যাচাই করার ভার দেওয়া হয় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে।

• ২০০৩ : জুনে খননকাজ শুরু করার পরেই হিন্দুদের দাবিকে সমর্থন জানায় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রত্নতত্ত্ববিদরা।
২২ অগস্ট: গড়ে তোলা বাবরি মসজিদের নীচে মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ রয়েছে, রিপোর্ট জমা দেয় এএসআই।

• ২ নভেম্বর, ২০০৪: আডবাণীদের বিরুদ্ধে মামলা বন্ধে ইলাহাবাদ হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ সিবিআইয়ের। সিবিআইয়ের আর্জি খারিজ হয়ে যায়। পরে সুপ্রিম কোর্টে যায় সিবিআই।

• ২০০৯ : প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর কাছে রিপোর্ট পেশ করল লিবেরহান কমিশন। উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবাণীসহ ৭ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করে সিবিআই।

• ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১০ : বিতর্কিত জমিটি তিনভাগে ভাগ করে এলাহাবাদ হাইকোর্ট। একটি দেওয়া হয় সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে, একটি নির্মোহী আখড়াকে ও অন্যটি রামলাল্লার দলকে।

• হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা ও সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড।

• ২০১১ : হাইকোর্টের রায়ই বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট।

• ২০১৯ : সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন।

• ৯ নভেম্বর ২০১৯ : রামজন্মভূমি কেসে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। জানানো হয়, হিন্দুরা তাদের জন্য দেওয়া জমিতে মন্দির করতে পারবে।

• ৫ অগস্ট ২০২০ : রামমন্দিরের ভূমিপুজো করা হয়।

প্রসঙ্গত, এদিনটি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের পক্ষ থেকে ‘‌শৌর্য দিবস’‌ হিসাবে পালন করা হয়। অন্যদিকে মুসলিমরা ৬ ডিসেম্বরের দিনটিকে ‘‌ইয়াম ই গম’‌ (‌দুঃখের দিন)‌ হিসাবে পালন করে।

Previous articleবিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তুলে আজ ভোট প্রচারে নামছেন বিমল গুরুং, বিপাকে বিজেপি, কিশোর সাহার কলম
Next articleফের রাজনীতির ময়দানে, দলীয় কর্মসূচিতে তথাগত রায়